ক্যাম্পাসে গিয়েই আমি একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম, বলা বাহুল্য একটি বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে। বাম হইলে কেন জানি, পিতামাতাবোনভ্রাতাবন্ধুস্বজন সবাইরে বাম বানাইতে ইচ্ছে করে। আমিও সেই সুবাধে আমার শৈশবের সব বন্ধুরে বাম বানানোর প্রজেক্ট হাতে নিলাম। ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হিসেবে আলম-কেও বাম বানালাম, কিন্তু পীরের নাতি বাম হইলেই কী আর না হইলেই কী! ওর ধান্দা কীভাবে জাহাঙ্গীরনগরের কথা বইলা মানিকগঞ্জ যাবে। তবুও আমার সঙ্গে দেখা হলে ওর ডায়লগ থাকতো- "তোমাদের সংগঠনের খবর কী? থুক্কু আমাদের সংগঠনের খবর কী?" এই জাতীয়।
এইবারে যখন প্রেম, নারী এবং রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম, ও সাথে সাথে ব্যাপারটাকে রিলেট করে ফেলতে পারলো। "ও! এই বিষয়েই না গত ফেব্রুয়ারিতে একবার কী ঝামেলা হইছিলো, তোমাদের সম্মেলনের সময়, থুক্কু আমাদের সম্মেলনের সময়?"
হ্যা, যদিও সংগঠনের সম্মেলন প্রতি বছরই হয় না, কিন্তু হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মীনার জন্মদিন চার বছরে একবারই আসে। ফলে একটি সন্ধ্যা ওর সাথে কাটাবার ইচ্ছে হয়েছিলো আমার। ইচ্ছেটা একসময় তাড়নায় এবং শেষ পর্যন্ত জেদে রূপ নেয়- আমি যাবোই। কমরেডরা যতই 'না' বলুক, সংগঠনের গতি যতই বাধাপ্রাপ্ত হোক- বের হবার, বেড়ে ওঠার আকাঙ্খাকে শৃঙ্খলিত করে বনসাই হবো না আমি! ইউনিটের কমরেডকে ব্যাপারটা জানাই আমি- আসাদ ভাই, কটা দিন আপনার পাশে থাকতে পারবো না।
শুনে তিনি রেগে যান। জন্মদিন? সম্মেলন রেখে জন্মদিন? এবং অতঃপর জন্মদিন বিষয়ে লেনিনের কোনো এক সমালোচনা 'নিজের ভাষায়' শুনিয়ে দেন, লেনিনের প্রবন্ধটি যোগাড় করা গেলে সম্মেলনের পর এ বিষয়ে একটা পাঠচক্র করা হবে।
আসাদ ভাইকে পাত্তা না দিয়ে আমি ব্যাগ গোছাতে থাকি। কমরেড জি.এস.-এর সঙ্গে দেখা করতে তার হলে যাই। "অঞ্জনদা' চললাম"।
তিনি কিছু বলেন না প্রথমে। এবং যখন বলেন তখন বলেন, কিছু বলবো না আমি। সিদ্ধান্ত তোমার।
বরং আমার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয় এমন একটি গল্প শোনান তিনি। সেই কমরেডের গল্প, যিনি পরম ভালবাসায় সংগঠনের কাজে এমনি মিশে গিয়েছিলেন, কাজ করতে করতে পার্টি অফিসেই তিনি মারা গেলেন। মজার ব্যাপার হলো মরার এগারো মাস পর এক মহিলা এসে বললেন, কমরেড শরীফুল ইসলাম তার স্বামী, যিনি বছরের কয়েকটা মাত্র দিনই বাড়ি থাকেন। কমরেড শরীফের খোঁজ তিনি করতেন না, যদি তার শ্বাশুড়ি মৃত্যুপথযাত্রী না হতেন। কান্নাহীন, সম্ভবত বেদনাহীন, নির্লিপ্ত মিসেস শরীফ জানতে চান, বুড়িকে কিভাবে কমরেড শরীফের হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলবেন।
অঞ্জনদা' গল্প বলেন হাসিমুখে; কিন্তু ভরাট গলায়, কান্না জমানো। আমি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি। সূর্য ডুবছে আনমনে। আমি সেন্ট্রাল মাঠে শুয়ে ভাবি, যাবো? শেষ শীতের হাওয়া গলার ভেতরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। যাবো? দূরে দিগন্তের কালশিরা- যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। যাবো?
মীনাই সব কিছু নয়। সব হলেও- হারাতে ভয় নেই। জন্মদিন কিছুই না, বছর বছর আসে। একটা লাল সন্ধ্যা, লাল পতাকার চেয়ে লাল নয়। আর ইচ্ছে? কিছু ব্যক্তিক ইচ্ছে, ব্যক্তিবাদিতা বাদ না দিলে বিপ্লব হয়? উই শ্যাল ওভারকাম সামডে...।
পথে পথে শত শত ঘরে ফেরা মানুষের মিছিল ভাবনার পথ বদলে দেয়। মানুষ- শ্রমজীবী মানুষ; মেহনতী। দিনভর প্রাণান্ত খেটে যায়, জীবনভর যুদ্ধ করে যায়। তারপর জীবনের যুদ্ধটা অসমাপ্ত রেখেই প্রকৃতি তাকে ছুটি দেয়, মাইনে বকেয়া রেখেই। ইতিহাসে তার নাম থাকে না, কারণ জীবনে তার সুখ থাকে না।
আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর
উড়িবার ইতিহাস
তবু উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস।
No comments:
Post a Comment