Monday, November 16, 2009

একটি জনজাদুঘরের সন্ধানে

গণচাঁদার মাধ্যমে বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ কাজে সাফল্যের পর (অন্য স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি) এবারে আমরা হাতে নিয়েছি জনজাদুঘর স্থাপনের একটি কাজ। জনজাদুঘর প্রত্যয়টি (পিপলস মিউজিয়াম বা কম্যুনিটি মিউজিয়াম) গত এক-দেড় দশক ধরেই জাদুঘরবিদ্যায় জনপ্রিয় একটি ধারণা হয়ে উঠছে। মানুষের (জনগণ) যা কিছু আছে সেগুলোকে মানুষ যেভাবে “উপস্থাপিত” দেখতে চায়, সেভাবে হাজির করাটাই এই ধরনের জাদুঘরের মূল লক্ষ্য। প্যালেস্টাইনের এই জনজাদুঘরটি একটু দেখুন, এই ধরনের জাদুঘর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পেতে পারেন।

প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর
প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর ১
প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘর ২

দাতাসংস্থাগুলোর টাকায় বাংলাদেশে এনজিও-দের করা জনজাদুঘর বা গণজাদুঘর নামে বেশ কিছু জাদুঘর আছে। এমন কয়েকটি জাদুঘরের খোঁজ পেয়ে আমি সেগুলো দেখতে গিয়েছিলাম, প্রথম প্রথম যে অভিজ্ঞতাটি হতো তা হলো- জাদুঘর জিনিসটা যে উন্মুক্ত একটা ব্যাপার এই ধারণাও প্রতিষ্ঠাতাদের ছিল না। প্রায়শই আমাকে শুনতে হতো- এখন জাদুঘর খোলা যাবে না, অফিস থেকে অর্ডার দিলেই কেবল খোলা হবে। কবে সাধারণত খোলা হয় জাদুঘর? যখন বিদেশ থেকে কেউ আসেন।

এরপর থেকে যে এনজিও-র জাদুঘর দেখতে যাই, তাদের একজন কর্তাকে সাথে নিয়ে যাই। সে অভিজ্ঞতাও হতাশাব্যঞ্জক। প্রথমত, সংগৃহীত/উপস্থাপিত নিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ (কমন) হলো- ধান ও ধানচাষ সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিসপত্র। এরপর থাকে যেগুলো তা হলো, কিছু গেরস্থালী জিনিস যা বিলুপ্তির পথে, শিলপাটা, ঢেঁকি, কাসার বাসনকোসন ইত্যাদি টাইপের জিনিসগুলো। তারপর এনজিও-টির কিছু প্রকাশনা- পোস্টার, লিফলেট, বইপত্র ইত্যাদি। আর কিছু যে থাকে না, তা না (দুএকটা ব্যতিক্রমী জাদুঘর আমাকে অবাক করে দিয়ে অফিস খোলা দিনগুলোতে খোলাই ছিল)। তবে মোটের ওপর এই ধরনেরই।

জনজাদুঘর করার জন্য জনগণের যে অংশগ্রহণ প্রয়োজন সেটি ওই জাদুঘরগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রে একেবারেই ছিল না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- জনজাদুঘর মানেই যে একটা উৎসব উৎসব ভাব, একটা প্রাণে প্রাণ মেলানোর ব্যাপার থাকে এইসব জাদুঘরে সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত।

একটি জনজাদুঘরের পরিকল্পনা আমরা করছিলাম গত ৪/৫ বছর ধরেই। সত্যিই আমরা জানি না, যেমন একটি জাদুঘরের স্বপ্ন আমরা দেখছি, তেমনটি করতে পারবো কিনা; তবে আমাদের দলের ছেলেমেয়েদের স্পৃহা অসীম। এই স্পৃহাই আমাদের নিরন্তর প্রেরণা জোগাচ্ছে একটি প্রাণবন্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে। খুঁটিনাটি পরিকল্পনা সব সেরে ফেলেছি, এমন নয়। তবে তো আর কোনো কথাই থাকতো না। ধান, পাট থাকবে আমাদের জাদুঘরে- হয়তো; তবে প্রাণের ঐকতানটাকেই আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।

এই জাদুঘরটি আমরা জনসচেতনতার জন্য করতে চাই না; বিশ্বশান্তি- নিদেনপক্ষে ওই এলাকাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও না; দেখো আমাদের কী সম্পদ আছে, এই অহমিকা তৈরির জন্যেও না। আমরা এটি করতে চাই, মানুষের শক্তি ও দুর্বলতা, মানুষের অর্জন ও অপরাধ, পরিবেশ ও ইতিহাসের সাথে মানুষের অভিযোজনশীলতা, মানুষের প্রকাশের আনন্দ ও অপ্রকাশের বেদনা- মোট কথা মানুষের অনুভূতিকেই অনুভব করার একটা জায়গা তৈরি করতে চাই। প্যালেস্টাইনের জনজাদুঘরটিতে এক বৃদ্ধ নারী তার উদ্বাস্তু জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন অন্যদেরকে। প্যালেস্টাইনের মানুষের কাছে উদ্বাস্তু জীবনের গল্প? মা-র কাছে মামাবাড়ির গল্পের মতোই ব্যাপার! তবু কিশোরকিশোরীরা তো বটেই, ওই উদ্বাস্তু নারীর অনেক সহযাত্রীও বার বার তার গল্প শুনে আপ্লুত হয়েছেন, আয়নাতে যেন নিজেকেই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে “মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো” প্রকল্পটি তাই এতো জনপ্রিয় হয়েছিল)

জাদুঘরের কাজ আসলে খুব কঠিন। বিশেষ করে টাকাপয়সার কথা ভেবে ব্যাপারটা আমাদের কাছে এক সময় খুব অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিলো। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার আমাদেরকে বার বার আমাদের স্বপ্নের কাছে ফিরিয়ে আনে। টিমমেটদের স্পৃহা-টা তো আছেই, বাইরের কিছু প্রভাব-ও আছে। শিল্পকলা একডেমীর কনজারভেশন ল্যাবরেটরিতে যখন কাজ করতাম, অফিস সহকারী মীজান ভাই করতেন আমাদের দশগুণ কাজ। অফিসে বসে ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করলেই তার চলতো, কিন্তু কিছু লোক আছেন যারা আরেকটু বেশি কিছু করেন, তিনি তেমন-ই একজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও, অনেক কাজেই তিনি এখনও আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। জনজাদুঘরের জন্য নগর থেকে কিছুটা দূরে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো এমন একটা জায়গা খুঁজছিলাম আমরা। মীজানুর রহমান আমাদের সেই সমাধান দিয়েছেন, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পূর্ণিমাগাতীতে পাঁকা রাস্তার ধারে তার ৮ শতাংশ জমি এই জাদুঘরের জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার ভাই আমাদের জানিয়েছেন, আমরা যদি সত্যিই জাদুঘরের কাজ শুরু করি, তাহলে তিনি তার অংশের ৮ শতাংশ জমিও দান করবেন।

মীজান ভাইয়ের জমি আর আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমের সঙ্গে এবার আপনার একটু সাহায্য চাই; এখনও জাদুঘরের নামে কোনো একাউন্ট আমরা খুলিনি, সুতরাং টাকাপয়সা চাচ্ছি না (ভবিষ্যতে লাগলে জানাবো); যা চাচ্ছি তা হলো পরামর্শ। অনেকেই আছেন যারা দেশবিদেশের অনেক জাদুঘরেই গেছেন এবং/অথবা জানাশোনা/পড়াশোনাও অনেকের অনেক ভালো। সুতরাং আপনার মতামত খুবই কার্যকরী হতে পারে এই জনজাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে।

আর একটা অনুরোধ-ও এর পাশাপাশি করি। তা হলো- আপনাদের কারো কাছে যদি “পুরনো দিনের আবর্জনা” ধরনের জিনিস কিছু থাকে, বাপদাদার আমলের লোটাবদনা, ঘড়ি-ছড়ি, পুরনো বইপত্র, যা-ই হোক, যা ভাগাড়ে ফেলে রেখেছেন, ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চান তাড়াতাড়ি, আমাদের খবর দিন। আমরা আপনার কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করবো।

Sunday, November 15, 2009

বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ : গুইসাপ

Align Left

এই ছবিগুলো আজ (২ নভেম্বর ২০০৯) দুপুরে তোলা, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদের সংরক্ষণ কাজ করতে করতে আমরা যেসব প্রাণীকুলের দেখা পেয়েছি, তার মধ্যে উনাদের জ্ঞাতি-স্বজনরাও ছিলেন। আমরা উনাদেরকে নিকটস্থ কবরস্থানে পুনর্বাসনের জন্য চেষ্টা করেছি। এই পুনর্বাসন প্রকল্পের (!) বিরোধিতাকারী কিছু দখলবাজ পুঁজিবাদী অথবা সকল সম্পত্তিতেই সকলের অধিকার আছে এমন কম্যুনিস্ট অথবা তোমাদের সম্পত্তিতে আছে অসহায়দের অধিকার এমন আয়াতের ভুল ব্যাখ্যাকারী মৌলবাদী অথবা জানিনা কোন্ মতবাদে বিশ্বাস এমন- যাই হোক, উনি আমাদের কথা রাখলেন না, উনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। বাংলার ঐতিহ্য যে ভবন সেই ভবন দখল আর বাংলার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোনো না কোনো অর্থে তো সমান হতেও পারে। বিস্তর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে আমরা যেসব লুকায়িত হানাদার বাহিনীকে পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছি, তাদের মধ্যে আজকের উনিও একজন।

উনার গ্রেফতারের কাহিনী সাদ্দামের গ্রেফতারের কাহিনীর মতোই রোমাঞ্চকর। একটি হন্তারক ব্যাঙ পথ হারিয়ে আমাদের ভবন-অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে, তার বিশাল বপু নিয়ে সে বেশি লাফাতেও পারছিল না, ইতোমধ্যে যে দু'চারটি ঘাসফড়িং হত্যা করে এসেছে, এটা তার ঠোটে লেগে থাকা ঘাসফড়িংয়ের রক্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু বাবার-ও বাবা আছে, দাদার-ও দাদা। যেই না এই খুনি ব্যাঙ আমাদের ভবনে প্রবেশ করে, তৎক্ষনাৎ প্রায় শূন্যে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে দখল করে বক্ষমান গুইসাপ। প্রথম ছবিটিতে গুইসাপের পাশে যে মৃত ব্যাঙটিকে দেখতে পাচ্ছেন, সেটিই ছিল ওই হতভাগা ব্যাঙ। এই অতি লোভাতুর হত্যাকাণ্ডের কারণেই আজ গুইসাপের এই পরিণতি। আমাদের সংরক্ষণ কাজের একজন শ্রমিক ছিল এই হত্যার রাজসাক্ষী। নিধিরাম সর্দার হিসেবে অচিরেই এই শোক সংবাদ আমি পাই এবং ক্যামেরা নামক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে তাকে অচিরেই তাকে পিছু হটতে বাধ্য করি এবং কবরস্থানে প্রেরণ করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিজরতকালে তিনি ব্যাঙটি ফেলে যান। এখানে উল্লেখ্য যে, মান দেবো তবু জান দেবো না নীতিতে বিশ্বাসী এই বর্বর গুইসাপটি সদর পথে প্রস্থান না করে ছাদ বেয়ে পেছনের পথে প্রস্থান করে। দ্বিতীয় ছবিতে তার সেই প্রস্থানের চিত্রই প্রস্ফুটিত হয়েছে।

জাতের নামে বজ্জাতি সব

আমি শুনেছি ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকে নাকি এখনো বাংলাদেশ-কে পাকিস্তানের অংশ মনে করেন, কেউ কেউ ভারতের একটা প্রদেশ-ও ভাবেন। বাংলাদেশের মানুষকে অবলীলায় ইন্ডিয়ান বা অন্য কোনো জাতীয় হিসেবে চালিয়ে দেন। কিংবা অনেক বাংলাদেশিও নিজেকে বাংলাদেশি না বলে প্রথম পরিচয়টা ইন্ডিয়ান বা এই ধরনের কিছু বলেন। আর মুসলিম? ‘দুইপাতা ইংরেজিপড়া' মুসলমানদের অনেকেই ইসলামী রীতি তো দূরের কথা পারলে বাংলার ইতিহাস থেকে মুসলিম শাসনের ৭০০ বছর-ও মুছে দিতে চান।

অবস্থা কতোটা ঘোরতর বুঝবেন, যখন সরকারপ্রধান '৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তনকেই এইদেশের উন্নয়নের জন্য জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দেখুন প্রথম আলোর সংবাদ। ব্যক্তিগতভাবে আমি '৭২-এর সংবিধান পছন্দ করি না, তবে আমার পছন্দ করার চেয়েও অনেক বেশি করে সেটি পছন্দ করেন না এই দেশের অবাঙালিরা। কারণ এখানে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে, মহান নেতা বলেছেন- তোমরা সব বাঙালি হ'য়া যাও। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলামিয়া কলেজের নাম বদলে হবে নজরুল কলেজ কিন্তু নটরডেম, হলিক্রস, রামকৃষ্ণ কলেজের নাম থাকবে যেমনছিলতেমন। যেন বাঙালিত্বেই সব জাতীয়তাবাদ, যেন অনৈসলামেই সব ধর্মনিরপেক্ষতা।

জাতীয়তা আসলে কি? সমাজবিজ্ঞান এমন এক অদ্ভুত বিজ্ঞান যা কোনো কিছুর স্থির ব্যাখ্যা দিতে পারে না। জাতীয়তার ধারণা এমনভাবে বদলে গেছে বিভিন্ন সময়ে, এক সময়ের ধারণা অন্য সময় প্রায় উল্টো। তিনটি সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারণার কথা আমরা বলি প্রায়ই- একটা হলো মৌলবাদী, আরেকটা যন্ত্রবাদী আর তৃতীয়টা নির্মাণবাদী। মৌলবাদী ধারণাটা এখন সমাজবিজ্ঞানে সবচেয়ে অচল, কিন্তু ওইটাই আমরা সবচেয়ে বেশি বলি। আমার বাপ-দাদা যেই জাত আছিলো, আমি কি সেই জাত না? আমি কি এই দেশের আদিবাসী না? মণিপুরীরা তো আইছে বিদেশ থেকে, আমার দাদা-পরদাদারা এই দ্যাশের আসল আদিবাসী ইত্যাদি ইত্যাদি এটিই মৌলবাদী ধারণা। অর্থাৎ প্রধানত রক্তের সম্পর্ককে ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদী ধারণা গড়ে উঠেছে, সেটিই হলো মৌলবাদী জাতীয়তাবাদ। অনেকে একে মূলবাদী, অনেকে প্রাথমিকবাদী অনেকে আদ্যবাদী বা আদিবাদী ইত্যাদি ভাবে বঙ্গায়ন করেছেন। এই তত্ত্বে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো- বংশগরিমা। প্রথমে সৈয়দ পরিবার সেরা, পরে সৈয়দ বংশ সেরা, পরে সৈয়দপুরবাসী সেরা, পরে সৈয়দস্তান-এর মানুষ পৃথিবীর সেরা জাতি, তারপর সৈয়দদের গায়ের রঙ যেহেতু কমলা, সুতরাং পৃথিবীর সকল কমলা মানুষ-ই সেরা, এইভাবে এটা একটা পুরা রেসিস্ট জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়। ব্রিটিশদের হাতে রোপিত হলেও জার্মানদের হাতে এই বৃক্ষ ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুস্তাফ কোসিনা এই ক্ষেতের মূল চাষী; হাইনরিখ হিমলার এবং আলফ্রেড রোজেনবার্গ কিছুটা কামলা দিছে।

যন্ত্রবাদী ধারণাটি হলো জাতীয়তা নির্ণয়ের একটা যন্ত্র নির্ধারণ। অর্থাৎ স্বাতন্ত্রসূচক একটা উপাদান (যন্ত্র) খুঁজে বের করে ওইটার সাপেক্ষে জাতীয়তাবাদ নির্ণয়। ওরা যেহেতু বাংলায় কথা বলে সুতরাং ওরা সব বাঙালি, ওরা যেহেতু সব বাইবেল পড়ে সুতরাং ওরা খ্রিস্টান জাতি, ওরা যেহেতু সব লাল পুঁতির মালা পরে সুতরাং ওরা সব লালমালা* জাতি। এইভাবে একটা কিছু খুঁজে বের করে ঐক্য তৈরি করা। কাঠামোবাদী, উপযোগিতাবাদী ইত্যাদি নানা নামে একে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নামের সাথে মিলিয়ে সংজ্ঞার সামান্য হেরফের আছে, মূল ঘটনা এক-ই। যাই হোক এই সংজ্ঞাও কার্যত অকার্যকর। কারণ দেখা গেছে, একই ভাষায় কথা বললেও ইংরাজগুলা মোটেই এক জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। অথবা এক ধর্ম হইলেও মুসলমানগুলা সব ফাঁক পাইলেই স্বাধীন হইয়া যায়। এইসব নানা কিসসা কাহিনী দেইখা সমাজবিজ্ঞানীরা কইলো, না থাউক, এইভাবে হইবো না, অন্য রাস্তা দেখি।

নির্মাণবাদীরা এইবার ধরলো ব্যক্তিকে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি কিভাবে সর্বব্যাপী ও সাধারণ ব্যক্তি হয়, তার চেষ্টা। দৈহিক গড়ন, নাম, ভাষা, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি নানা ধরনের যাতাকলে পিষ্ট করে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে কোথায় সবচেয়ে বেশি খাপ খায় সেই বিষয় জানার চেষ্টা করে। এইভাবে ব্যক্তির বিভিন্ন চর্চা, সংস্কৃতি, পরিপ্রেক্ষিত, ইতিহাস ইত্যাদির আলোকে একই সমাজে নানা স্তরায়ন করে জাতীয়তাকে ভাঁজে ভাঁজে সাজাইলো। এর ফলে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলামান, বাংলাদেশি বাঙালি, ভারতীয় বাঙালি, বাংলাদেশি মুসলমান বাঙালি, বাংলাদেশি হিন্দু বাঙালি, বাংলাদেশি নিম্নবর্গের মুসলমান বাঙালি ইত্যাদি নানা ভাবে জাতীয়তাকে চিহ্নায়নের চেষ্টা করে। এর থেকে ‘তোমার দেশ কই?- নোয়াখালী, তোমার জাত কি?- জাইল্যা' এইটা অনেক বেশি যুৎসই মনে কইরা, সমাজবিজ্ঞানীরা কি করি কি করি একটা ধান্দায় পড়ে গেল।

(চলবে)

*লালমালা জাতি নামে আসলেই একটা জাতি চিহ্নিত করা হয়েছিল।

৭৭২ কিস্তির মেগা উপন্যাস : সপ্তম কিস্তি

ডেন্টাল ভাস্করের প্রকৃত নাম ভাস্কর নিবেদন। লাল সালু আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী বলে তার নাম ভাস্কর নিবেদন, নাকি তিনি নিবেদন শব্দটি বেশি উচ্চারণ করেন বলে এই নাম, নাকি এটি তার মাতৃপিতৃপ্রদত্ত নাম, তার কিছুই আমি জানি না। ক্যাম্পাসে আসার পর আমি জেনেছি, তিনি চলে যাচ্ছেন। মানে তার পড়ালেখা শেষ, সুতরাং কয়েকবছরের মধ্যেই তিনি ক্যাম্পাস ত্যাগ করবেন। একজন বিদায়ী কমরেডের নাম-রহস্য উদ্ঘাটন না করে বরং তার কাছ থেকে তার মহোত্তম গুণাবলি অর্জনের চেষ্টাই অধিকতর ফলদায়ী বলে চলমান কমরেডরা পরামর্শ দিলেন।

তার গুণ-রহস্য জানার চেষ্টায় প্রথমেই জানতে পারলাম, তিনি এক মহান দন্ত-বিশারদ। টুথপেস্ট এবং ব্রাশ এ দুটি পণ্য পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক বলে তিনি এই সমস্ত ব্যবহার করেন না। মার্কস ও এঙ্গেলসের মন্ত্রণাগ্রন্থসমূহে দন্তের কোনো মন্ত্র না থাকায় প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব জ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমেই দন্ত-যত্ন-সমস্যার সমাধান করতে হবে, এটিই ছিল তার মত। প্রকৃতির অন্য সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ দাঁতের যত্নে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, মানুষকেও সেই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিই গ্রহণ করতে হবে।

পরে অবশ্য আমি জেনেছি, শেষ দিকে ভাস্কর নিবেদন-এর অপর দু’একটি নাম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, সেগুলো হলো ফোম ভাস্কর, বাবল ভাস্কর ইত্যাদি। কেননা শোনা যায়, বুদবুদ বা ফেনোদ্গম করে (যেমন- টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি) এমন সকল পুঁজিবাদী পণ্যের বিরুদ্ধেই নাকি তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।

শঙ্কু ও শমী বিষয়ক রুদ্ধদ্বার বাহাস যখন ভেতরে চলছিল, হঠাৎ দরোজায় বিকট শব্দে লাথি-ঘুষির শব্দে আমরা চমকিত হলাম। শত্রুলীগ বা শত্রুদলের কে এই অকস্মাৎ আক্রমণ করলো- এই বিষয় নিয়ে কমরেড ন্যান্সি এবং কমরেড পত্তর-এর মধ্যে কিছুটা বিবাদের পর কমরেড মাসুমবাচ্চা দরজা খুলে দেওয়াই শিশুসুলভ কাজ হবে বলে রায় দিলেন। যে কোনো ব্যাপারে শিশুরাই সবচেয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত দিতে পারে বলে কমরেড মাসুমবাচ্চা মনে করেন। তবে বাচ্চা শব্দটি শিশুবান্ধব হয় না বিধায়, কমরেড বাচ্চু বলে তার বিশেষ খ্যাতি ছিল।

এবং ডেন্টাল ভাস্কর। দরজায় দাঁড়িয়েই তিনি নিবেদন করলেন- ‘বিভিন্ন মহল থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে যেসব তথ্য আমার কাছে নিবেদিত হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, এই বিষয়ে আমার কিছু নিবেদন রাখা দরকার’। তিনি আরও নিবেদন করলেন- যেহেতু উভয় কমরেড দৃষ্টিপাত শাস্ত্রের শিক্ষার্থী এবং তিনি নিজেও দৃষ্টিপাত বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সুতরাং এই সমস্যায় তার দৃষ্টি নিবেদন অত্যন্ত জরুরি।

দরজার কাছাকাছি কেদারাসমূহে যেসব কমরেডরা বসেছিলেন, তারা সমস্বরে হাঁচতে হাঁচতে দ্রুত কমরেড নিবেদন-এর জন্য আসন ছেড়ে দিলেন এবং নিজেরা একযোগে দূরবর্তী কমরেড কুদ্দুসের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিষয়টি অস্বস্তিকর দেখালেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এর কোনো বিকল্প ছিল বলে আমার মনে হয় না।

কুদ্দুস পুনরায় মুখ খুললেন- হ্যা শঙ্কু, তুমি বলো- পত্তর অথবা ন্যান্সির সাথে কালুভবনের সামনে বসে না থাকে, কেন তুমি শমীর সাথে বসে থাকো?

কমরেড পত্তর বললেন- এই বিষয়ে শঙ্কুকে একটি কারণদর্শানোর চিঠি দেওয়া হোক।

কুদ্দুস বলেই চললেন- বুঝলাম, তোমরা উভয়েই কালু অনুষদের শিক্ষার্থী, উভয়েই দৃষ্টিপাত বিভাগে একই বর্ষে পড়ো, কিন্তু তাই বলে কালুভবনের সামনে কেন তোমরা একসাথে বসে থাকবা? লাল সালু আন্দোলনে ব্যক্তিবাদের কোনো জায়গা নাই, তোমার যদি কোনো বিশেষ বোধ জাগে, সেই বোধ তুমি ন্যান্সির সাথে আলাপ করো, পত্তরের সাথে আলাপ করো। একটি অষ্টাদশী শিশুর সাথে তোমার আলাপের রহস্য কি? এটি তো শিশু নির্যাতনের সামিল।

পত্তর বললেন- শিশু নির্যাতন বিষয়ে শঙ্কুকে কারণ দর্শানোর জন্য একটি চিঠি দেয়া যেতে পারে।

বাচ্চু এই পর্যায়ে বললেন- এটিকে আপনারা শিশু নির্যাতন না বলে, শিশুদের সাথে সখ্য-ও বলতে পারেন, এবং তাতে আমি তো দোষের কিছু দেখি না।

নূরুল কুদ্দুস হুংকার দিয়ে উঠলেন- কারো ব্যক্তিগত দেখা না দেখা দিয়ে তো আর লালখাতা বাধাই হয়নি। কোটি কোটি বছর ধরে মানুষ তিলে তিলে যে স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্নের দেনাপাওনার হিসেবনিকেশ ওই খাতায়। কোটি কোটি বছর ধরে নির্মিত সেই লালখাতার আমরা ধারক ও বাহক। ব্যক্তিগত ভাললাগা, মন্দলাগা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা এইসব পুঁজিবাদী চিন্তা থেকে আমাদেরকে কোটি কোটি হাত দূরে থাকতে হবে। তুমি একজন মহারাজ হয়ে এমন মহাপাপ করতে পারলে কিভাবে?

এতোক্ষণে আমার বোধোদয় ঘটলো, শঙ্কুর পুরো নাম তো শঙ্কু মহারাজ। তবে কি একদা তিনি অন্য কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন? তাই কি এতো প্রশ্ন? আমাদের রাজ্যে এসেছেন আমাদের রাজকন্যা হরণ করতে? কমরেড কুদ্দুস কতকটা তেমনই ইঙ্গিত দিলেন। এরপর তিনি একে একে বলতে লাগলেন, কি কি পাপাচার তারা করেছে। এক সাথে এক বাসে করে সুদূর ঢাকা পর্যন্ত তারা ভ্রমণ করেছে এবং এই দীর্ঘ ৬* ঘণ্টার ভ্রমণে তারা পাশাপাশি সীটেও হয়তো বসেছে। এবং এটি কি ইঙ্গিত বহন করে? কমরেড চীৎকার করে জানতে চাইলেন- আদিম বিকৃতির প্রকাশ নয় এটা?

পটকা ফাটানোর মতো চীৎকার শুনে ভয়ে, নাকি কথা শুনে লজ্জায়, কেন জানি না এই পর্যায়ে শমী ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল।

*১৯৯৭-৯৯ সালে আরিচা রোড সংস্কারের কারণে ঢাকায় যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগতো।

*** বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই উপন্যাসের ৭ম/৮ম পর্বগুলো সচলে খসড়া আকারে লিখে রেখেছিলাম, আমার নিজের ভুলে না সচলের ভুলে জানিনা, সেগুলো ডিলিট হয়ে গেছে; নতুন করে লেখার কোনো আগ্রহই পাচ্ছিলাম না। ঠাকুরগাঁওয়ে এই মুহূর্তে আমি একটু বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছি, অন্যরা কাজ করছে; কিন্তু আমি অসুস্থতার ভাণ করে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছি। আর সকলেই তো জানেন- অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

রাজকুমার মুরগির বাচ্চা হতে চেয়েছিল

বখতিয়ার খলজি (আসলে ইখতিয়ার খিলজি)-র ‘বঙ্গবিজয়’ বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল মিনহাজ-ই-সিরাজ রচিত তাবকাত-ই-নাসিরি; এই গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক বলছেন- ‘এই গ্রন্থের তথ্যসমূহ একেবার নির্ভুল, অকাট্য ও প্রামাণ্য, কেননা এখানে সরাসরি সেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যিনি এই কাহিনী শুনেছেন তার নানার কাছে এবং তার নানা এটি শুনেছেন সেই ব্যক্তির কাছে, যার সাথে দেখা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তির যিনি বখতিয়ার খলজির কোনো এক অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন’। এতোই প্রামাণ্য সেই ইতিহাস!

রাজকুমারের সোনালী রঙের চামড়ার ব্যাগটার ভেতর কী কী জিনিস আছে, তা নিয়ে আমার জানা বৃত্তান্ত অনেকটা তাবকাত-ই-নাসিরির মতোই, পরম্পরায় শুনেছি ওই ব্যাগের ভেতর নাকি রাজকুমার সাপ পুষতেন, প্রয়োজনের সময় সাপের বিষ জিবের ডগায় নেয়ার জরুরত ছিল। রাজকুমার নিজেও ওই ব্যাগের সাবধানতা বিষয়ে যারপরনাই সচেতন ছিলেন। আমি একবার কি একটা জিনিস খুঁজতে কাছে গিয়ে ওই ব্যাগ ছোঁয়ামাত্র রাজকুমার তেড়ে আসলেন, ব্যাগের ভিতরে কি আছে না জেনে ব্যাগ খুলতে যাস কোন্ সাহসে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং তারপর বৃত্তান্ত শুনে সন্তর্পণে ব্যাগের এক কোণা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আরো সন্তর্পণে জিনিসটা বের করে আনলেন। প্রত্যক্ষদর্শীর মনে হবে, সত্যিই হয়তো ব্যাগের ভেতরে সাপখোপ আছে, না হলে এতো সাবধানতার কারণ কী? আমার সন্দিগ্ধ মন অবশ্য বলে, প্রায় দুই দশক ধরে ব্যবহারের কারণে ব্যাগের চেইনের অবস্থা ছিল শোচনীয়, ফলে একবার খোলা হলে তা লাগাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় বলে রাজকুমার যারপরনাই সতর্কতার সাথে ব্যাগের চেইন খোলা-লাগানোর কাজ করতেন এবং অন্য কাউকে ব্যাগ খুলতে দিতেন না। এবং সেই সাথে ফুটনোট দিয়ে দিচ্ছি, রাজকুমার সম্পর্কে যদি কেউ কখনোও কোনো অভিযোগ আনেও রাজকুমার অলস ছিল, এই অভিযোগ কেউ আনতে পারবে না। ফলে আলস্যের কারণে ব্যাগের চেইন বদলানো হয়নি, ব্যাপারটা তা না। আসলে ব্যাগের চেইন সারানোর মতো ১৫ টি টাকা হয়তো রাজকুমারের হাতে কখনো আসেনি। যদি আসতোও তা দিয়ে যে সে কি করতো তা খোদাই মালুম, কেননা মাত্র ১ টাকা পকেটে নিয়ে এই লোক ঢাকা থেকে ইন্ডিয়া ভ্রমণ করে এসেছেন। সেই গল্পেই যাচ্ছি।

রাজকুমার আর আমি ছাড়াও তখন আমাদের বাড়িতে গরু, ছাগল, বাঞ্ছিত কুকুর ও অবাঞ্ছিত বিড়াল, কবুতর এবং হাঁসের পাশাপাশি একগাদা মোরগ-মুরগিও ছিল। বাড়িতে ডিম খাওয়ার মানুষ নেই দেখে সেই ডিম ফুটে ফুটে বাচ্চা হতে হতে মুরগির পাল-ও হয়েছিল বিশাল। একটা মোরগ তো আমার ঘরেই থাকতো, প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত এবং সন্ধ্যা হলে গৃহপ্রবেশ। মজার ব্যাপার ছিল, ওই মোরগটা কখনও আমার ঘর নোংরা করেনি, লক্ষ্মী ছেলের মতো বসবাস করতো। (এই গল্প পরে অন্য একদিন বলবো)

রাজকুমার আমাকে বললেন, জন্মান্তর হলে মুরগির বাচ্চা হবো রে!
-বাচ্চা? কিন্তু বাচ্চা তো চিলে নিয়ে যায়।
-আরে, মা আছে কি করতে? চিল তো চিল, স্বয়ং ***** আসলেও...। বাচ্চা নেওয়ার সময় মুরগির রি-অ্যাকশন দেখছিস?
-রি-অ্যাকশন দেখে কি হবে? বাচ্চা যদি নিয়েই যায়?
-আরে, সবসময় মুরগির পাখনার নিচে লুকিয়ে থাকবো রে!
-কিন্তু বড়ো তো হয়ে যাবা, রাজকুমারদা!
-আরে না, বড়ো হবো ক্যান্? বাচ্চা হয়েই থাকবো। ভগবানের যদি জন্মান্তর-দানের ক্ষমতা থাকে, চিরকাল তবে বড়ো হতে না দেওয়ার ক্ষমতা-ও থাকা উচিৎ।

বাবরি মসজিদ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডকারখানার পর রাজকুমার পরিবার ভিটেমাটি ও চাষাবাদের জমিজমা বিক্রি করে মামার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলো, দেশমাতা নাকি জন্মদাত্রী মা এই বিতর্ক রাজকুমারের মনে এসেছিলো কিনা জানিনা, তবে তরুণ রাজকুমার তখন বাবা-মা-পরিবার-আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে ইন্ডিয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং সেই থেকে বাংলাদেশে ভূমিহীন, পরিবারহীন এক সংখ্যালঘু পরিণত হলেন।

কিন্তু প্রায়ই রাতের বেলা রাজকুমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে মা বলে চেচিয়ে দেশমাতৃকা না মা দুর্গা না জন্মদাত্রী মাতা, কার কথা ভাবতেন এটা বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি বলে, পকেটে এক টাকার একটা কয়েন নিয়ে একদিন শাহবাগ থেকে রওনা হলেন রাজকুমার। অনেকেই হয়তো জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর আসতে বাসভাড়া লাগে এক টাকা। ভক্ত-বন্ধুদের খাতিরে পকেটের এক টাকা পকেটে রেখেই রাজকুমার ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছুলো এবং তারপর শুরু করলো মানিকগঞ্জ যাবার ভাড়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান, বেশি না মাত্র ১০ টাকা হলেই শুভ যাত্রা বা নবীনবরণে মানিকগঞ্জ যেতে পারে। জন্মভূমিতে শৈশবের বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আরো ১০-১৫ টাকা ম্যানেজ করে আরিচা ঘাট, পদ্মা পেরুলেই রাজবাড়িতে আত্মীয়ঘর। সেখান থেকে কিছু জোগাড় করে কোনো মতে ঝিনেদায় গোলাম রসুলের কাছে যেতে পারলেই সে-ই বেনাপোল হয়ে বর্ডার পাড় হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। অদূরপ্রসারী পরিকল্পনা উপস্থাপনের কৌশলে শামীম, বিশ্বসহ কতিপয় ভক্তঅনুরাগী তার সাথে আরিচা ঘাট পর্যন্ত রওনা হলো; একটা ভ্রমণ-ও হলো, রাজকুমারেরও একটা গতি হলো। আরিচা ঘাটে রাতের আড্ডা সেরে শামীমরা ক্যাম্পাসে আর রাজকুমার পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মায়ের দর্শনে চললো। আমরা শুনেছি, বর্ডারের গ্রামগুলোতে তাকে ২-৩ দিন থাকতে হয়েছিল এবং কোনো কোনো সময় তাকে একটানা ২৪ ঘণ্টাও হাটতে হয়েছিল। এবং প্রথমবার মামাবাড়ি গিয়ে সে দূরে দাঁড়িয়ে তার মায়ের কাছে খবর পাঠায়- রাজকুমার এসেছে। দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের কারণে বাবার প্রতি যে ক্ষোভ ছিল তার, তা প্রথমবার ভারতভ্রমণে প্রকাশ করে রাজকু বাবার সঙ্গে দেখা না করে। মায়ের সাথে ১ ঘণ্টার মতো দেখা করে আবার যে পথে গমন ওই পথেই প্রত্যাবর্তন করে ক্যাম্পাসে। গোলাম রসুল তাকে ব্যাপক সাহায্য করেছে বলে শুনেছি। তবে, এই রীতিতে ভারতভ্রমণের ক্ষেত্রে এরপর সে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে, এমনকি পকেটে কোনো টাকা না থাকলেও তার পক্ষে ইন্ডিয়া গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসাটা পানির মতো সহজ কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। তবে সর্বশেষ ইন্ডিয়া গমন তার দীর্ঘস্থায়ী, সবুজ বাঘের ভাষায় “পরচিম বঙ্গের ডুয়ার্সের চাবাগানে হে নাকি আমোদেই আছে। কুলি কামিনগো নগে চা পাতা ছিড়ে আর মদ গাঞ্জা খাইয়া সাধুর নগাল পইড়া থাকে”।

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি, তুমি কি শেষ পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা হতে পারলে রাজকুমারদা?

আব্দুল করিমের হাড়গুলো কোথায়?

আমি মরলে আমার হাড় নিয়েও বাণিজ্য হবে

"আমি মরলে আমার হাড়গুলি নিয়েও বাণিজ্য হবে"- বলেছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। ২০০৩ এর ১৬ অক্টোবর প্রথমালোতে সেটি ছাপা হয়। এবং মর্মান্তিক হলেও সত্যি, প্রথমালো এই মহান শিল্পীকে যথেষ্ট অত্যাচার করেছে। মারা যাবার কিছুদিন আগেও ভয়াবহ অসুস্থ এই শিল্পীকে তারা বন্ধুসভার মতো একটা চতুর্থশ্রেণীর সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এনে হাজির করেছে এবং অসুস্থ শিল্পীকে গান গাইতে বাধ্য করেছে। এই জঘন্য কীর্তিকে আবার তারা তাদের কাগজে মহান কর্ম হিসেবে ফলাও করে ছাপিয়েছেও।

প্রথমালোই শুধু নয়, আমরা যারা শিল্প-সংস্কৃতির সেবায় জান লড়িয়ে দিচ্ছি, আমরাই বা কম কিসে? গিটার-ড্রাম বাজিয়ে তার ভাটিয়ালি ও বাউল ঘরানার গানগুলোকে রক বানিয়ে ফেলেছি, সেটাও মানা যেত, যদি অন্তত তার কথা ও সুরের মূল দিকটা ঠিক রাখতাম। গান লেখার, সুর করার মুরোদ যদি না-ই থাকে, অন্যের লেখা-সুর করা গান তার মতো করেই তো গাইতে হবে, নাকি?

নাগর শিল্পীরা আব্দুল করিমের গান গাইলেন, লন্ডন নিউইয়র্ক থেকে বিভিন্ন শিল্পী ইংরেজি (অথবা হিব্রু-ও হতে পারে, আমি কিছু বুঝতে পারিনি) কিছু ডায়লগ আর কানঝালাপালানিয়া গোলাগুলির শব্দমিউজিকের সাথ তার গানের অ্যালবাম বের করলেন, শুনলাম অনেক বিক্রিও নাকি হয়েছে। কাগজে আর চ্যানেলগুলোতে বস্তার পর বস্তা আলোচনা হচ্ছে, ফেসবুকে আমরা শত শত স্ট্যাটাস আর লিংক পোস্টাইলাম, ক্যাসেট কোম্পানীগুলো তার ক্যাসেটের হাজার হাজার কপি বের করে তুমুল কামিয়ে নিল, প্রচুর শোকসভা হলো বিধান ও অ-বিধানসভায়, কিন্তু লোকটা মারা গেল না খেয়ে, প্রায় বিনা চিকিৎসায়। ছেলে নূর জালালের ভাষ্যমতে, শেষের দিকে আর জাতীয়/আঞ্চলিক পদক আনতে যেতে চাইতেন না, কারণ পদক নিয়ে বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়া থাকতো না।

ফেসবুকে নজরুল ভাই মন্তব্য করেছিলেন, "এতদিন কিছুই হয় নাই, শাহ্ আব্দুল করিমের গান নিয়ে খেলা এবং ব্যবসা এখন মাত্র শুরু হবে। অপেক্ষা করেন...।"

আব্দুল করিম জানতেন, তাকে নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে এবং আরো অনেক হবে। বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি তিনি ভাল করেই বুঝতেন। বুঝতেন বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে শুরু করে জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি পর্যন্ত সবকিছুই তার গানে উঠে এসেছে। সমকাল থেকে দূরে থেকে এক আধ্যাত্মিক কূপে বসবাস করেননি তিনি, অন্য অনেক মারিফতি বাউলের মতো। আধ্যাত্মিকতা/বাউলিয়ানা তার সঙ্গীতের ভিত্তি হলেও সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি তিনি অনুধাবন করেছিলেন বলেই বলে গেছেন, মরার পর হাড়গোড়গুলো নিয়েও ব্যবসা হবে। তবে সেই ব্যবসা এখনো শুরু হয়নি। নজরুল ভাই, অপেক্ষা করতেছি, সেই ব্যবসাটা কবে শুরু হয়, তা দেখার জন্য।

আগামীকাল রাজকুমারের তামসিক খিচুড়ির মজমা

ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বদান্যতায় সে বার কোনো একজন রাগশিল্পী এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরে। রাগসঙ্গীতের সেই আসরে রাজকুমার ছিলেন এবং পুরো অনুষ্ঠান-ই তিনি মনোযোগ সহকারে উপভোগ করতেন, যদি না রায়হান ভাই এসে তাকে তুলে নিয়ে যেতেন। ঘটনা হলো, রাজকুমারের স্নাতকোত্তরের ভাইবা ছিল ওইদিন। ভাইবা-তে অনুপস্থিত থাকলে বা ফেইল করলে, লিখিত পরীক্ষায় যতো ভালই করুক না কেন- ফেইল। ব্যাপক অনুসন্ধানের পর রায়হান ভাই, পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর রাজকুমারকে খুঁজে পান এবং বলা বাহুল্য সে বারের মতো রাজকুমারকে ফেইল করার হাত থেকে বাঁচান। তবে কতোটুকু বাঁচাতে পারলেন জানি না, কারণ রাজকুমার তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিলেন, এবং এজন্য তাকে যথেষ্ঠ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া খুব কঠিন।

আমরা যারা রাজকুমারের ভক্তকুল, এই তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত একটি মানুষকে তার পরেও পছন্দ করি। কারণ আমরা জানি, এই পুরো সমাজ এবং এই ব্যক্তিকে আলাদা করে ফেলা যায় অনায়াসেই। তৃতীয় শ্রেণী চতুর্থ শ্রেণী এইসব নিয়ে কখনো মাথা নিয়ে ঘামাননি তিনি, রাজকুমার পড়ুয়া ছিলেন এবং তার স্বাতন্ত্র্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে কোনো চাকরি বাকরি করার থেকে কোনো সাধুসঙ্গে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেওয়াটা তার কাছে অনেক লোভনীয় ছিল। অথবা চা বাগানে। কিংবা কোনো আদিবাসী পাড়ায়। সাধারণ পাতার বিড়ি আর দুয়েক কাপ চা- এই হলেই দিন চলে যেতো রাজকুমারের। একটানা কতোদিন শুধু চা আর বিড়ি খেয়ে কাটিয়েছেন রাজকুমার, এই নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত আছে, সর্বনিম্ন ৩০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সেটা, তবে সত্যিটা বোধহয় আরো অনেক কম। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন মানুষটি, তবে বিষয় হওয়া চাই অসূর্যস্পর্শা ধরনের। যে ছবি আগে কেউ তোলেনি এমন বিষয় পছন্দ করতেন তিনি, যদিও তুলেছেন অনেক ঘরোয়া ছবিও।

গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটাকে ব্যাপারটাকে রাজকুমার এক শিল্প-সাধনার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। সাধারণ নেশাখোরদের মতো না, রাজকুমার এটাকে তার ধর্মের মতো পবিত্র মনে করতেন। তিনি এটাকে বলতেন সিদ্ধি এবং এটা তিনি সাধনার অংশ হিসেবে সেবন করতেন, নেশা করার জন্য নয়। টেবিল বাজিয়ে গান করা ছিল তার প্রিয় স্বভাবগুলোর একটি। কফিল ভাই, শামীম ভাই বা অন্য কোনো শিল্পী থাকলে তিনি শুধু টেবিল-ই বাজাতেন, মাতাল রাজ্জাকের বিচ্ছেদী গানগুলো সেই আসরের প্রধান উপজীব্য ছিল।

রাজকুমার ছিলেন একজন সত্যিকারের ভালো সঙ্গী। যেকোনো জায়গায় যেকোনো মুহূর্তে যেতে প্রস্তুত ছিলেন রাজকুমার, আহ্বান মাত্র সম্মতি এবং যাত্রা শুরু। বিভিন্ন বিষয়ে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা ছিল; ভ্রমণে খুব কাজে দিতো। ভ্রমণ হোক আর অন্য যেকোনো জায়গায়, রাজকুমারের মতো একজন সঙ্গী পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। প্রচুর মতবিরোধ সত্ত্বেও পরমতসহিষ্ণুতা ও তানের ঐক্য তাকে আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল।

রাজকুমার ধান্দাবাজ ছিলেন না। অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা অথবা অন্য কোনো মোহ তাকে টানেনি একদম। কোনো রকমে একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা (মানে ঘর হতে হবে এমন না, রাস্তা হলেও চলে) আর পাতার বিড়ি এবং চায়ের সংস্থান- এই ক’টি জিনিসই তার চাহিদা ছিল। এই সারল্য এই যুগে বিরল। এবং সেই সাথে গুরুত্বহীন। কেননা, ক্ষমতাহীন মানুষকে কেউ সঙ্গী করে না। রাজকুমার-ও তাই চিরকাল ছিলেন নিঃসঙ্গ। বিভিন্ন সময় আমাদের বিভিন্ন জনের সাথে তার খুব সখ্য ছিল। হয়তো আমাদের যূথ-এর সাথেও তিনি যূথচারী হয়েছেন অনেক সময়। কিন্তু কেউই আমরা তাকে দেইনি (অথবা আমরা নেইনি) স্থায়ী সান্নিধ্য। কেননা আমাদের চলার পথ অনেক উর্ধগামী, অনেক ক্ষমতা, খ্যাতি ও অর্থমুখী। রাজকুমার আমাদের মোহের অনেক নিচ দিয়ে স্বচ্ছ ঝরনার মতো প্রবহমান থেকেছেন সবসময়, এখনও আছেন।

কিন্তু আমরা সবাই এটা জানি, এই স্বচ্ছতা, এই সারল্য এই নিমোর্হ জীবনের প্রতি আমাদের এক অর্ন্তলীন আকর্ষণ আছে। তাই রাজকুমার যখন পাশে নেই, তখন আমরা স্মৃতিকাতর হই। আমাদের নানা রঙে মাখামাখি জীবনে জলীয় স্বচ্ছতার জন্য আকুল হই।

সবুজ বাঘের আহ্বানে আগামীকাল (শুক্রবার ২৩ অক্টোবর) সারাদিন এবং সারারাত আমরা থাকবো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজকুমার স্মরণ না, আসলে নিজের বিস্মৃতিকেই জাগিয়ে তোলার একটা চেষ্টা; অনেক গাছ কাটা হয়েছে জানবিবি-তে। তবুও এখনো সেখানে গেলে কেন জানি মনে হয়, সারল্য এখনো অপাঙতেয় নয়।

Autobiography- Eight (ইংরেজিতে এখনো অনূদিত হয়নি, দ্রুতই অনূদিত হয়ে বিশ্বকাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করবে)

গৌরচন্দ্রিকা:
হোজ্জার কাছে এক ভদ্রমহিলা আসলেন একটা চিঠি লিখে দেওয়ার অনুরোধ করতে, কারণ তার মেয়ে দূরের গ্রামে থাকে। হোজ্জা বললেন, আমার এখন পায়ে ব্যথা, আমি চিঠি লিখতে পারবো না। মহিলা অবাক হয়ে বললেন, আপনি কি পা দিয়ে লেখেন? হোজ্জা বললেন- চিঠির পাঠোদ্ধার করার জন্য তোমার মেয়ের গ্রামে আমাকে তো পায়ে হেটেই যেতে হবে তাই না?

কবিতার পাঠোদ্ধার আসলে হায়ারোগ্লিফিক্স-এর পাঠোদ্ধারের চেয়ে জটিল। কাব্য-সমালোচকরা যদি কবিতার পাঠোদ্ধারের বদলে সিন্ধুলিপি অথবা উয়ারিলিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করতেন তবে ইতিহাস-সংস্কৃতি কিঞ্চিৎ উপকৃত হতো বলে আমার বিশ্বাস। সুতরাং নিচের কবিতাটি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা না করেই পড়ুন।

মূল কবিতা:
কার্ল মাক্স বলেছিলেন, এক সময় উৎপাদন ব্যবস্থা এতো উন্নতি করবে যে মানুষকে আর কোনো কাজ করতে হবে না। যন্ত্রই করবে সব, মানুষের অন্তহীন অবসর।

আমি সেই দিনটির অপেক্ষা করছি।

যখন পাখিরা ঘরে ফিরলো কি ফিরলো না
নদীর জীবনে বাকি রইলো কোন্ লেনদেন

এইসব জটিল সরল-অংক করতে হবে না আমাকে।

আদার ব্যাপারির মতো এড়িয়ে যাবো দিশেহারা জাহাজীর সবুজ ঘাসের দ্বীপ দেখার উচ্ছ্বাস।

অন্ধকার নামুক অথবা অন্ধত্ব-
মুখোমুখি তোমার- গন্ধ নেওয়ার
থেকে বেশি কিছু করবো না আর।

সারমর্ম:
কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না। (এই অসুস্থতার অজুহাত যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো, তুমি বলোতো?)

সংবিধিবদ্ধ সর্তকর্তা:
কার্ল মার্ক্সের অন্তহীন অবসরের ভ্রান্ত ধারণাটি নিয়ে কাব্য রচনা করলেও ভুলেও ভাববেন না, তার অন্য সব ভ্রান্ত ধারণাও আমি গ্রহণ করেছি।

সংযোজন ১: সুচৌ-র কবিতার পাঠোদ্ধারের জন্য সুচৌ-এর কাছে আপনারা বঙ্গীয় শব্দকোষ ক্রয়ের নিমিত্তে টঙ্ক কামনা করতে পারেন।

সংযোজন ২: এই সিরিজের পূর্ব ৭টি কাব্য ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়েছে, এই কাব্যটিও অচিরেই স্বর্গীয় বর্ণমালায় পরিণতিলাভ করবে। বঙ্গীয় ভাষার মতো একটি পক্ষীভাষা কাব্যসুষমা ধারণের পক্ষে কস্মিন উপযোগী নহে।

আমার ডলফিনগুলো-১

শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম আমার। শৈশব কেটেছে ওই নদীকে কেন্দ্র করেই। বৃষ্টি হলেই কেন যেন নদীটা টানতো আমায়। সবার অলক্ষ্যে একটা পানশি অথবা কোশা (কুশা) নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম নদীতে। জাল থাকতো নৌকাতেই, না হলে নিয়ে যেতাম সঙ্গে করে। তারপর জাল ফেলে মাছ ধরা। তখন মাছ-ও পাওয়া যেত বেশ। জাল ফেললেই মাছ। পুটি আর ছোট চিংড়ি পেতাম বেশ। তবে অন্য মাছ-ও পেতাম। এমনকি রুই কাতলা বোয়ালের মতো পোষা মাছ-ও পাওয়া যেত। একবার তো বিরাট একটা কালো কুচকুচে তেলতেলে মাছ উঠলো জালে। এই মাছ খাওয়া যায় কিনা, এটা সাপ জাতীয় কিছু কিনা, এই নিয়ে আমি আর সহ-জেলে চাচাতো ভাই গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু করলাম। পরে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম, এটা আসলে শিশুর বাচ্চা। সুতরাং আমরা এটাকে নদীতেই আবার ছেড়ে দেওয়া যাক।

শিশু মাছের নামটা কেন শিশু মাছ হলো, এটা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেবার চনপাড়া থেকে ইছাখালি পর্যন্ত নৌকা করে আসছিলাম আমরা। গয়না নৌকা - ছৈ দেয়া। মা, আমরা তিন ভাইবোন আর আমার খালু। যদিও খালু, কিন্তু তিনি আবার আমার নানার ভক্তশিষ্য। আমার নানা ছিলেন বাউল ধরনের মানুষ। নিজেই গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। স্বভাবতই তার কিছু শিষ্য জুটেছিল। চনপাড়া থেকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষন পরেই নতুন চরে এসে মাঝিরা নৌকা ভিড়িয়ে দিল। অনেক দূরের পথ, সুতরাং কিছু খাওয়া দাওয়া করা দরকার। খালু, আমি এবং মাঝিদের একজন চললাম নতুন চরের অস্থায়ী বাজারে। কতো জাতের যে মাছ উঠেছে! শীতলক্ষ্যা যেখানে মেঘনার সাথে মিশেছে, সেটা বেশি দূরে না হওয়াতে সদ্য আহরিত ইলিশ-ও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। আমরা বেছে বেছে শেষমেষ ইলিশ-ই কিনলাম। আরো কিছু বাজারসদাই করে, চরেই রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে আমরা রওনা হলাম। ঠিক তখনই কয়েকটা বিশাল মাছ লাফিয়ে উঠলো নদীতে, মাকে জিজ্ঞেস করলাম- এই মাছের নাম কি? মা বলে, এদের নাম শিশু। এতো বড়ো মাছের নাম কেন শিশু, তার জবাব মা, খালু বা মাঝিরা কেউ দিতে পারলো না। আমরা তিন ভাইবোন ছৈ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু মাছেদের খেলা দেখতে লাগলাম। বিশেষ করে চেইন করে করে যে লাফগুলো দিচ্ছিলো, তা ছিল অসাধারণ। মাঝিরা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছিলো- এতো কিনারে যাইও না, পইড়া যাইবা। মাঝিরা বলে বলে পনেরোটা, বিশটা শিশু আছে নদীতে; আমার অবশ্য পরে মনে হয়েছে শত শত শিশু আছে নদীতে।

তখনো আমরা টেলিভিশনে ডলফিনের ব্যাপার স্যাপারগুলো বুঝে উঠতে পারিনি। ডলফিনের বাংলাই যে শুশুক এবং তার স্থানীয় বিকৃতি যে শিশু তা-ও আমাদের মাথায় ঢোকেনি। তবু এতো বিশাল বিশাল মাছেদের এতো শিশুসুলভ কাণ্ডকারখানা আমাদের মুগ্ধ করতো।

বৃষ্টি হলেই তাই নদীতে ছুটতাম। মাছ ধরা তো আছেই, শিশুগুলোর কাণ্ডকীর্তি দেখাও একটা উপলক্ষ ছিল। একবার তো মাছ ধরে যেই না নদীর এক বাঁকে এসেছি, দেখি কি আমার পচাঁত্তরোর্ধ্ব নানা বৃষ্টির মধ্যে নদীর পাড়ে বসে একমনে শিশুর খেলা দেখছে। আমি “ও-ও-ও-ও নানা, একলা একলা বইসা কি করোগো নানাআআ?” বলে যেই না হাঁক দিয়েছি, অমনি তিনি “তফাৎ যা, তফাৎ যা” বলে চেচিয়ে উঠলেন। নানা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, সুতরাং তার এই অকস্মাৎ রূঢ় ব্যবহারে দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও, মোটেই দুঃখ পেলাম না। বরং এই ঘটনার কথা চিন্তা করে সেদিন-ও মজা পেয়েছি, এখনো হাসি পায়। বুড়া একটা লোক ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একা একা বসে শিশুর খেলা দেখে! নৌকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে আমি দ্রুত তার চোখের আড়ালে চলে গেলাম। সেদিন-ও একগাদা মাছ ধরেছিলাম। ঢাকায় এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে না দিলে আমি হয়তো জেলেই হতাম একটা। নানা জাত বেজাতের মাছ ধরে সেগুলোকে নতুন চরের বাজারে বিক্রি করে লবন, তেল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মাকে বলতাম- নে মা তোর মাছ, তেল, লবন; শিং মাছ আর উচ্ছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খাব আজ।

জেলে হওয়া আর হলো না, তবে সুযোগ পেলেই শিশুগুলোকে দেখতে যেতাম। কয়েকদিন আগেই তো রাজকুমার* সমভিব্যহারে বাড়ি গেলাম। যদিও এখন অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে, এখন আর নৌকা করে কেউ যায় না, তবু শিশু দেখার লোভে আমি আর রাজকুমার নৌকা ভাড়া করলাম। পৃথিবীর সব নোংরা আর দুর্গন্ধ সহ্য করতে সক্ষম বলে জানতাম যে রাজকুমারকে, সে-ও পুরো নৌযাত্রাটিতেই রুমাল দিয়ে নাক চেপে রাখলো। আমি কিন্তু নাকে রুমাল দেইনি। কারণ আমি জানি, এই রাস্তা এই ব্রীজ এই কলকারখানা এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার বাবা, মামা, খালুরা কতোবার যে মন্ত্রী এমপি-দের কাছে গেছে, রাস্তা করেন, ব্রীজ করেন, ঢাকার এতো কাছে অথচ শিল্পায়ন হলো না, একটু শিল্পায়নের উদ্যোগ নেন, কতো দেন দরবার নিয়ে। অবশেষে রাস্তা হলো, ব্রীজ হলো, শিল্পায়ন হলো, নদীর নতুন চরে এডিবল তেলের কারখানা হলো। আর আমার শিশুরা পচে গলে মিশে গেল শীতলক্ষ্যার পানির সাথে। আমার নিজের অপরাধে আমার শৈশবের সঙ্গীদের মৃত্যু হলো, আর আমি তার পঁচা গলা শরীর মেশানো পানির গন্ধে নাকে রুমাল দেই কিভাবে?

*রাজকুমার সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

বাংলাদেশের স্থাপত্য সংরক্ষণের হালচাল

বাংলাদেশে স্থাপত্য (মনুমেন্ট) সংরক্ষণের ব্যাপারটা একেবারেই ঘোলাটে প্রক্রিয়ায় চলছে। কয়েক ধরনের ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন এই সংরক্ষণ। প্রথমত, সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তাদের নিজেদের কোনো স্থপতি নেই, এবং সাধারণত তারা স্থপতি ভাড়াও করে না। তাদের কোনো কনজারভেটর নেই এবং সাধারণত কনজারভেটর ভাড়াও করে না। কী সব কনজারভেশন হচ্ছে, তা পাহাড়পুর, ময়নামতি এমনকি বাগেরহাটেও এবিসি লেখা ইট দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন। নকশার যে কি বারোটা বাজিয়েছে, তা নিয়ে অনেক গণমাধ্যমের মধ্যে ডেইলী স্টারেরটা আমার কাছে বেস্ট, ওখানে দেখা যাচ্ছে, আগে যেখানে স্থাপত্যটির চারটি দরজা ছিল, এখন সেখানে হয়ে গেছে তিনটি।

পানাম সিটি সংরক্ষণের আগে ও পরে

পানাম সিটি সংরক্ষণের আগে ও পরে

আরেক দল সংরক্ষণ করছেন, উনারা মূলত স্থপতি এবং প্রকৌশলী। প্রধানত বুয়েটের দখলে এর বাজার, তবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পাস করা শিক্ষার্থীরাও আছেন। উনাদের একজন (নাম বলছি না, কারণ উনাকে অন্তত এই ব্লগের প্রায় সবাই চেনে) সেদিন আমাকে বললেন, "তুমি কি বলো এইসব? আমি তো দোতলা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের ওপর চারতলা বসিয়ে দিয়েছি, কোনো সমস্যা হয় নাই।" নির্মাণ প্রকৌশলের দিক থেকে হয়তো সমস্যা হয় নাই, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে সমস্যা হয়েছে। যে মনুমেন্টটি দোতলা করে বানানো হয়েছিল, সেটিকে সংরক্ষণের নামে চারতলা বানানো আসলে বিকৃতিরই নামান্তর। উনাদের দলের সমস্যার প্রধান কারণ হলো- তাদের দলে ইতিহাসবিদ বা প্রত্নতাত্ত্বিক অথবা সংরক্ষকদের কোনো জায়গা নাই।
(ছবি আছে, কিন্তু দেখাচ্ছি না, বেশি গোমর ফাঁস করে ব্যবসা নষ্ট করতে চাই না)
তৃতীয় যারা সংরক্ষণ করছে, তারা হলো আমরা। আমি নিজে কনজারভেটর, তবে তার চেয়েও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক। আমাদের দলে তাই আমরা বিশেষজ্ঞ সংরক্ষক রেখেছি। রেখেছি মানে আমরা একসাথে মিলেই কাজটা শুরু করেছিলাম। সমস্যা হলো, আমাদের দলে বিশেষজ্ঞ স্থপতি বা প্রকৌশলী নেই, যারা আছেন, তারা ৪/৫ বছর আগে পাশ করেছেন, এখনো তেমন যশ নেই। এই পোস্টটাই দিতাম না যদি তাদের যশ থাকতো। আজকে সকালে একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে হয়েছে, যেখানে ওই ডিসিপ্লিনগুলোর বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। উনাদের সাথে আমার যে কথোপকথন হয় তা হুবুহু তুলে ধরছি-

- তোমাদের সাথে বিশেষজ্ঞ স্থপতি এবং প্রকৌশলী রাখোনি কেন?
- স্যার, এটাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়।
- খরচ বেশি পড়লে তোমরা তোমাদের ক্লায়েন্টদের কাছে বিল করো।
- স্যার, আমি তো ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেই না, আমরা বিনা পয়সায় কাজ করি; বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্টরা তো স্যার বিনা পয়সায় কাজ করতে চায় না।
- তোমরা তো এভাবে মার্কেট নষ্ট করছো, একে তো কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে না, অন্যদিকে... ইত্যাদি ইত্যাদি।

উনাদের কথার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, সেটি হলো, সত্যিই মনুমেন্ট কনজারভেশনের জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ স্থপতি/প্রকৌশলীদের সাথে বিশেষজ্ঞ কনজারভেটরদের আর প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা সমন্বয় দরকার। গত ২/১ বছর ধরে আমরা সেটার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সমস্যাটা টাকার ক্ষেত্রে, আমরা যেমন বিনা দ্বিধায় দেশের ঐতিহ্য দেশের ঐতিহ্য বলে ডিপিএস ভাঙ্গিয়ে ভবন রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়ি, স্থপতি বা প্রকৌশলীরা তেমনটি করতে পারেন না। তাদের কাজের বাজার আমাদের কাজের বাজারের তুলনায় ভালো বলেই এটা হচ্ছে। সেই সাথে জ্ঞান ডিসিপ্লিনের এলিটিক জায়গাও আছে কিছুটা। এতো এলিট একটা ইউনিভার্সিটিতে এতো এলিট একটা ডিসিপ্লিনে পড়ে আমি কিনা ঝোপজঙ্গলে তাবুর ভিতরে পড়ে থাকবো???? আমাদের সাথের এক প্রকৌশলী তো পোকার কামড়ে (পোকা বিষয়ে আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম) অসহ্য হয়ে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে চলে গেছেন।

যেমনটি বলছিলাম, গত ২ বছরে আমাদের নড়াচড়ার ফলে আমরা কিছু অদ্ভূত অদ্ভূত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। একটা বলি, সমন্বিতভাবে কাজ করার কারণে আমরা প্রায়ই ছাড় দিয়ে কাজ করি। ছাড়ের মাত্রা এমন হয়েছে যে, একটা ভবন সংরক্ষণে যে বাজেট করা হয়েছে, তার ১ শতাংশ রাখা হয়েছে আমাদের দলের জন্য অর্থাৎ সংরক্ষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য এবং ৯৯ শতাংশ রাখা হয়েছে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের জন্য। তা সত্ত্বেও আমরা হাসিমুখেই কাজটা করে যাচ্ছি, তবু যদি সমন্বয় হয়।

সত্যি বলতে কি, ইউরোপে এমনকি ইন্ডিয়াতেও মনুমেন্ট কনজারভেশনের জন্য আলাদা ডিসিপ্লিন-ই আছে, এই ডিসিপ্লিনের নাম বিল্ডিং কনজারভেশন অথবা আর্কিটেকচার কনজারভেশন। সাধারণত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা আর্কিটেকটার বিভাগের শিক্ষার্থীরা এটি পড়েন এবং অন্য ডিসিপ্লিন (এমনকি আর্কিওলজি) থেকেও কেউ পড়তে চাইলে তাকে এক বা দুই বছর স্থাপত্য বিষয়ে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়। আমাদের দেশে এই বিষয়টি পড়ানো হয় না, বুয়েটে আর্কিটেকচার কনজারভেশন বলে একটা বিষয় আছে, এবং সেই বিষয়ে শিক্ষক-ও আছেন, কিন্তু গত চার বছরে সেখানে মাত্র একজন ছাত্র ওই কোর্সটি নিয়েছিলেন। আমরা যারা দেশ বিদেশ থেকে কনজারভেশনে ডিগ্রি নিয়েছি, আমরা ওই ২ বছরের ফাউন্ডেশন কোর্সের ভয়ে (অথবা অহেতুক কেন সময় নষ্ট করবো ভেবে) সাধারণ কনজারভেশনেই পড়াশোনা করেছি। এর ফলে একটি ভবনকে কেটে টুকরা টুকরা করে দিলে আমি সেটিকে সংরক্ষণ করতে পারি ঠিকই, কিন্তু একটি স্থাপনার দাঁড়িয়ে থাকার কারিগরি বিষয়টি আমি জানি না। আর সেজন্যই আমাদেরকে প্রকৌশলী ও স্থপতিদের শরণাপন্ন হতেই হয়।

শেষ করে দেই, অনেক বড়ো হয়ে গেল। একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি কখনো গুগলে বাংলাদেশের স্থাপনা সংরক্ষণ বিষয়ে সার্চ দিয়েছেন। একবার দিয়ে দেখুন। একগাদা খবর পাবেন। আমি একবার ১৭টা ভবন সংরক্ষণের খোঁজ পেয়েছিলাম, বলা বাহুল্য সবগুলোই করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিংবা স্থপতি অথবা প্রকৌশলীরা। আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছি, সবগুলো ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যের ব্যাপারটি ওভারলুক করা হয়েছে। এই ব্লগে যারা স্থপতি বা প্রকৌশলী আছেন, তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, নিজেরা না পারলেও অন্তত জুনিয়রদের আর্কিটেকচার কনজারভেশন বিষয়টি পড়তে উৎসাহিত করুন। কারণ, না পড়েও উনারা কাজ ঠিকই করছেন, পড়ে করাটাই ভালো নয় কি? আর আমরা যারা প্রত্নতত্ত্ব বা কনজারভেশন পড়ছি, আমাদের জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা, সেটি নিয়ে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেখা যাক কি হয়।

*****অনেক দ্রুত লিখলাম, বাস ছেড়ে দিবে। অনেক ভুলভ্রান্তি রয়ে যেতে পারে, ক্ষমা করলে বাধিত হবো।*****

মুসার অহীপ্রাপ্তি : ১

শোনেন শোনেন ভাই বোনেরা শোনেন দিয়া মন,
গ্যাস রপ্তানির কারণ এইবার করিব বর্ণন।
সব্জি যায়, চিংড়ি যায়, আদম হয় রপ্তানি,
গ্যাস বিক্রি করে এইবার আসবে মালপানি।
দেশে যদি না-ও আসে, পাবে দেশের লোক,
একটা কিছু হলো ভেবে, এইবার জয়ধ্বনি হোক॥

মাথা বেচি, বুদ্ধি বেচি, বেচি মেরুর হাড়,
সামান্য গ্যাস বেচা নিয়ে, অহেতুক হাহাকার!
বলি, ভাই বন্ধু সকল, আসুন সবাই মিলি,
বিদেশি কোম্পানির জন্য এইবার করি দালালি।
দালালি করার মধ্যে লজ্জার কিছু নাই,
দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখা চাই॥

মাটির নিচে গ্যাস রেখে ফায়দা কি আর আছে?
বেচে বরং টু পাইস কামাই ইন্ডিয়ার কাছে।
সাগরের গ্যাস তো ভাই জলেই ধুয়ে যায়,
পানি বেচে এমন সহজ রোজগার আর কোথায়?
আশি ভাগ গেলেই বা কি আছে তো ভাই কুড়ি,
কুড়িটা-ও না দিলে ভাই কিসের হিসেব করি?

পক্ককেশ মুসা বলে, করি নিবেদন,
মাথার মধ্যেই আছে গ্যাসের সঞ্চালন॥

মুসা সাহেব কহেন বিস্তর

যে কহে বিস্তর, সে কহে বিস্তর মিছা। তাই সকলেরই থামা ঊচিত। বিশেষ করে বেশি শ্রান্ত হয়ে গেলে। মুসা সাহেব থামছেন না। আজকের প্রথম আলো-তেও লিখেছেন। বলা বাহুল্য, অতিকথনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েই। একটি লাইন উদ্ধৃত করি, 'আমি আনু মুহাম্মদ অথবা গ্যাস-তেল আহরণ নিয়ে বিতর্কে সরকারের ইজারা প্রদান সিদ্ধান্তের পক্ষে।' সুবিধাবাদিতা কতো চরম মাত্রায় পৌঁছালে সংবাদপত্রে কলাম লিখে নিজের এই অবস্থান সংবাদপত্রে কলাম লিখে প্রকাশ করা যায়, এটি তার একটি নমুনা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ হরতাল ডেকেছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি, এর বিরোধিতা করে আজকেই একটি সংবাদ সম্মেলন করলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তেল-গ্যাস রপ্তানী বিষয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আগের অবস্থানেই আছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আগে যেভাবে তেল-গ্যাস রপ্তানীর বিরোধিতা করেছে, এখনো সেভাবেই বিরোধী (বাস্তবতা যদিও ভিন্ন কথা বলে)। এবং স্মরণ করুন সেইসব দিনের কথা যখন মুসা গং পত্রিকায় কলাম লিখে বিএনপি-র তেল-গ্যাস ইজারা ও রপ্তানী নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। আর এখন সরকার পরিবর্তনের পর তিনি লিখছেন, যদি সব্জি রপ্তানী করা নিয়ে কোনো আন্দোলন না হয়, তা হলে গ্যাস রপ্তানী নিয়ে এতো আন্দোলন কেন? সরকার বদল হলে চান্দি গরম হয় জানি, কিন্তু তাই বলে সব্জি এবং গ্যাস-কে একই রকম দেখার মতো গরম হয়, সেটা ভাবিনি।

তাই বলছি, মুসা সাহেব এবার থামেন; একটু দম নেন।

সারমেয় সমাচার

১.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটমেন্ট কখনো ছিল না, এটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়াচাড়া করার লাইসেন্স পাওয়ার ফলে আমি ধারণা করেছিলাম, প্রতিপক্ষকে ট্যাকল করার কৌশলে তারা কিছু বদল আনবে। কিন্তু কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, আওয়ামী লীগের সারমেয়-স্বভাবেরও তেমনি কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রভুদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মাত্র কুকুরের মতো ঝাপিয়ে পড়ার আওয়ামী লীগের পুরনো কৌশল আবারো দেখা গেল আজ।

২.
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম(?)-এর যে কি অবস্থা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র মন্ত্রী-নেতারাই তা খোলাশা করেছেন। তাদের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপস, অডিও টেপ এবং জবানবন্দীমূলক চিঠিপত্র এখনো ইন্টারনেটে সার্চ করলে পাওয়া যায়; ওইগুলোতে স্পষ্ট করেই নেতারা তাদের শীর্ষনেত্রী ও অন্যান্য নেতাদের দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, কবে কার কাছ থেকে কিভাবে ঘুষ নিয়েছেন, চাদাবাজি করেছেন, দুর্নীতি করেছেন, সবকিছুই দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার।

৩.
তারপরেও আমি আশা করেছিলাম, কৌশলে পরিবর্তন আসবে। প্রভুদের বিরুদ্ধে মিছিল দেখলেই দাঁত-নখ বেরিয়ে আসবে, এটা আশা করিনি। পেট্রোবাংলার সামনে গেলে আনু মুহাম্মদ কি করতেন? পেট্রোবাংলায় পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতেন? আমি তো জানি, আনু মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা পেট্রোবাংলাকে পছন্দই করেন; বিদেশী কোম্পানীগুলোকে কাজ না দিয়ে বরং পেট্রোবাংলাকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হোক, এটাই তো তারা চেয়েছেন। সুতরাং আনু মুহাম্মদকে লাঠি দিয়ে না ঠেকালেও হতো। তিনি পেট্রোবাংলার সামনে গেলে আসলে কিছুই হতো না, অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ওখানে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে কিছু বক্তৃতা-টক্তৃতা করতেন এবং একটা নতুন কর্মসূচি দিতেন। খুবই সাধারণ ব্যাপার হতো এটা। কিন্তু হলো না, তার কারণ- রাষ্ট্র।

৪.
আনু মুহাম্মদ-এর ওপর হামলাকে আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলেই মনে করি। প্রথমত, খুবই সাধারণভাবে বলি- আনু মুহাম্মদের ছাত্রজীবন, শিক্ষকতা, লেখালেখি এবং রাজনীতি বরাবর বাংলাদেশের মানুষের পক্ষেই থেকেছে। তিনি আমার কাছে তাই রাষ্ট্রের প্রতীক। ফলে তার প্রতি হামলাকে আমি বাংলাদেশের প্রতি হামলা হিসেবে মনে করি। স্বাভাবিকভাবেই আমি মনে করি, আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ এবং যে পুলিশ ও তাদের নির্দেশদাতা আমলা-রাজনৈতিক এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া উচিত।

৫.
কিন্তু আসলে সেটা হবে না। কারণ রাষ্ট্রের কলকাঠিওয়ালারা ঠিক এইভাবে ভাবেন না। রাষ্ট্র বলতে উনারা বোঝেন উনাদের ক্ষমতা। রাষ্ট্র বলতে কিন্তু আসলে ক্ষমতাটিই বোঝায়। সেই ক্ষমতা হলো- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মোটেই গণতান্ত্রিক নয় এবং এর সংবিধানের অনেক জায়গাতেই গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তা আছে। আওয়ামী লীগ যদিও ভোটের আগে এগুলো নিয়ে কিছু কিছু কথা বলেছে, কিন্তু এখন ভুলে গেছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ হলো, বাংলাদেশের শাসকদল ও গোষ্ঠী রাষ্ট্র বলতে বোঝেন ক্ষমতার ব্যবহার। যে ক্ষমতা জনগণ এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ভূমি ও সম্পদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা, সেই ক্ষমতাকে বিদেশি কোম্পানী ও বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করাটাকেই কেউ কেউ রাষ্ট্র বলে মনে করে।

৬.
বাংলাদেশের জ্বালানী ক্ষেত্র বিষয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একবার দুর্নীতি মামলা হয়েছিল, সেই মামলা থেকে তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে খারিজ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে (২৪ অগাস্ট) তিনি আবার তাল্লু এবং ফিলিপসকে ৫, ১০ ও ১১ নং ব্লক বরাদ্দ দেন। সেই পুরনো কাসুন্দি। বাংলাদেশ পাবে ২০ ভাগ, কোম্পানী পাবে ৮০ ভাগ। আর এই ৮০ ভাগ আবার বাংলাদেশকে কিনতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারদরে। কার্যত, গ্যাসের খনি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে চড়াদামে গ্যাস কিনতে হবে বাইরের কোম্পানির কাছ থেকে। যেন স্বর্ণকারের কাছে গয়না বানানোর জন্য সোনা দেয়ার পর এখন আন্তর্জাতিক দরে ৮০ ভাগ সোনার দাম দিতে হচ্ছে। এমন অসম চুক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। অন্তত গুগলে সার্চ দিয়ে আমি খুঁজে পাইনি।

৭.
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সংজ্ঞা অনুসারে শেখ হাসিনার এই কাজ দেশপ্রেমিকমূলক। কেননা দেশের স্বার্থেই তার সবকিছু করার কথা। দেশদ্রোহীমূলক কোনো কিছুই তিনি করতে পারবেন না, এই শপথ তিনি নিয়েছেন। "রাজা যখন অন্যায় করেন, তখন তিনি আর রাজা থাকেন না" রবীন্দ্রনাথের এই কথা অনুসারে হয় তিনি তার কর্তৃত্ব হারিয়েছেন অথবা তিনি দেশপ্রেমমূলক ও ঠিক কাজটিই করেছেন।

৮.
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমের যে কি হাল, তা আগেই একবার বলেছি। বর্তমান কাজটিও যদি ওই রকমই কিছু হয়ে থাকে, তবে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপদজনক। কেননা সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুসারে এর ফলে রাষ্ট্রটি আসলে খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, বস্তুত ভাঙ্গা। তার পরেও আনু মুহাম্মদের কাজটিকে কেন আমি দেশপ্রেমমূলক বলছি এবং তার ওপর হামলাকে দেশদ্রোহিতা বলছি? তার কারণ আমি এই চুক্তিটিকে যৌক্তিক ও হিতকর মনে করি না- তা নয়। তার চেয়েও বরং এই কারণে আরো বেশি যে, রাষ্ট্র কখনো আসলে শূন্য থাকে না। আনু মুহাম্মদ সেই শূন্যস্থান পূরণ করে একটি দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তই রেখেছেন।

৯.
তাই বলছি, আনু মুহাম্মদের ওপর হামলাকারী পুলিশ এবং নির্দেশদাতা আমলা ও রাজনীতিকেদর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন।

ছবি- রানা রায়হানের ফেসবুক অ্যালবাম থেকে

ফারিয়া, তোমার জন্য...

ফারিয়া

বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, নিজেও আক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তা সত্ত্বেও আমাদের সংরক্ষণ কাজে সবচেয়ে আগ্রহী মানুষটি ফারিয়া। প্রতিদিন এসে কাজের খোঁজখবর নিচ্ছে, আমাদের দলের কে কেমন আছে, অভিভাবকসুলভভাবে দেখভাল করছে। ওর ভাই-বোন (যাদের সাথে থাকে) আমাদেরকে চাচা-মামা ডাকলেও ফারিয়া এসব সাধারণ (কমন) সম্পর্কে আগ্রহী নয়। প্রত্যেকের সাথে তার ওয়ান-টু-ওয়ান সম্পর্ক, প্রত্যেককে কাস্টমাইজড নাম দিয়েছে সে। সাধারণত নামের আদ্যক্ষরটিকেই নাম হিসেবে তার পছন্দ, নিজের নাম বলে ‘ফা‌'। সুতরাং আমাদের দলের অধিকাংশ সদস্যই তার কাছে শা, আ, স ইত্যাদি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ডাক নাম যে চুন্নু, ফারিয়া-র ‘চু' অনুসন্ধান ব্যতীত এটা আমি জানতেই পারতাম না। তবে একই অক্ষর একাধিক হয়ে গেলে অথবা কোনো বিশেষ কারণ থাকলে অন্য কোনো শব্দ বা অক্ষর বেছে নেয় সে। যেমন মামুন-কে ‘বন্ধু’ নামে কাস্টমাইজ করেছে, কেননা ‘মা’ অক্ষরটি অন্য কারো জন্য বরাদ্দ করতে সে আগ্রহী না। আমি যদিও এই দলের সবচেয়ে মুরব্বী সদস্য না, তবে দলনেতা হওয়ার কারণে প্রায়ই মুরব্বী গোছের লোকদের সাথে আমার আনাগোনা থাকায় আমাকেও আদ্যাক্ষর দিয়ে বিভূষিত করা যাবে কিনা, এ বিষয়টি ফারিয়া এখনো নিশ্চিত নয়। তাই ‘এই, ওই, এই যে’ ইত্যাদি ভূষণ নিয়েই আপাতত থাকতে হচ্ছে। আমাদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে তার সুস্পষ্ট বিধিমালা আছে, তা হলো- ফারিয়া থাকা অবস্থায় সিগারেট খাওয়া যাবে না, খেতে হলে দূরে গিয়ে খেতে হবে এবং ফারিয়াকে দেখা মাত্র সিগারেট ফেলে দিতে হবে- এর কোনো ব্যতিক্রম হলে ও আমাদের কাছে আসবে না। আর ওর সঙ্গ পছন্দ করে না, এমন সদস্য আমাদের দলে নেই। আমাদের দলের সদস্যদের তোলা ফারিয়ার ছবির কয়েকটি আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে আছে। (শুধু ফারিয়া-কে নিয়ে পরে একটা আলাদা পোস্ট দিবো, আশা করছি)।

১.
আজ সকালে যখন সাইটে গেলাম, দূর থেকে দেখলাম একটা মিছিল। কাছে গেলে বুঝলাম- একদল স্কুলের বাচ্চা এসেছে আমাদের কাজ দেখতে। প্রতিদিনই শত শত শিশু এখানে আমাদের কাজ দেখতে আসে। আশেপাশের এবং দূরের স্কুল, কিন্ডারগার্টেন এবং মাদ্রাসা থেকে শিশুরা দলবেঁধে কিংবা একা একা আসে। বড়োদের থেকেও ওদের উৎসাহ অনেক বেশি। এবং বড়োদের অনেকের মধ্যে যে অতিলৌকিক সংস্কারগুলো আছে, শিশুদের মধ্যে সেটা নেই। এতো বছরের পুরনো একটি ভবন, যা তৈরি করেছে জ্বীন-পরীরা, সেটা কি মানুষের পক্ষে পুনর্নিমার্ণ করা সম্ভব? এই প্রশ্নের জবাবে বড়োরা অনেক সময় দ্বিধান্বিত হলেও শিশুরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে- এর সংস্কার ও সংরক্ষণ হবেই।

২.
ফারিয়া কখনো এই লেখা পড়ার মতো বড়ো হবে কিনা, জানিনা। কিন্তু ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা একদিন বড়ো হবে। ওরা জানবে, এই দেশ সেই দেশ যে দেশে অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুদ্রা চালু হয়েছে পৃথিবীর সব দেশের আগে। (৬ষ্ঠ খৃস্টপূর্ব শতাব্দীতে উয়ারীতে প্রবর্তিত ইউনিফর্মড মুদ্রাব্যবস্থার আগে বিশ্বের কোথাও মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না)।

পৃথিবীর দেশগুলো যখন বিদ্যালয় কি এই বিষয়টিই জানতো না, তখন আমাদের উপমহাদেশেই প্রথম তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় (তক্ষশিলা)। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খৃস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে আমাদের দেশে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় (মহাস্থানগড়, হরিশচন্দ্র নির্মিত বিদ্যায়তন, সোমপুর বিহার, কুমিল্লার বিহারসমূহ ইত্যাদি), ইউরোপ যখন বিশ্ববিদ্যালয় কি, তা-ই জানতো না।

বর্তমান ডিজিটাল বিশ্ব যে দশমিক পদ্ধতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই দশমিক পদ্ধতি ও শূন্য এই বাংলাতেই আবিষ্কৃত হয়।

আমাদের দেশ এতোই অতিথিপরায়ণ ও সমৃদ্ধ যে এই দেশ অনুপ্রবেশকারী যোদ্ধা এই দেশেই জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন কি নিজের ছেলের সাথে যুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন রাখার চেষ্টা করেছে।

যে আলেকজান্ডারের ভয়ে সারা বিশ্ব কাপঁতো থর থর করে করে, সেই আলেকজান্ডার বাঙালি বীরের (নন্দ) বীরত্বগাঁথা শুনে অস্ত্র সংবরণ করেছিলেন।

এমনি আরো শত শত গল্প এইসব শিশুরা জানবে। শুধু জানা নয়, এইসব ঋদ্ধ অতীত আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছি এটাও ওরা দেখবে।

৩.
এই যে নগর-সংসার ছেড়ে এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে পড়ে আছি, তার প্রধান কারণ- ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা যখন বড়ো হবে, ততদিনে আমরা এই দেশের আরো অনেক স্থাপনা এবং অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণ করতে পারবো। ওরা বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরবগাঁথা গর্ব করে বলবে এবং সেই সাথে এই গৌরবান্বিত অতীত থেকে অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ নিয়ে আরো গর্ব করার মতো ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের যতো প্রয়াস, সব ওদের জন্যই।

পরামর্শ চাই : রাণীশঙ্কৈল-এর ঐতিহাসিক রাধামাধব মন্দির পুনরানয়নের জন্য কিভাবে টাকা পাই?

ঠাকুরগাঁওয়ের জমিদারদের মধ্যে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী কিছুটা ব্যতিক্রমী। সমকালীন অন্য জমিদারদের চেয়ে তার খ্যাতি একটু বেশিই ছিল। পৈত্রিক সূত্রে বাবা বুদ্ধিনাথ-এর কাছ থেকে জমিদারি পান টঙ্কনাথ। তিনিও তার সময়ে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন। জমিদারির ব্যাপ্তী এবং শাসনকাজের বলিষ্ঠতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। রাণীশঙ্কৈল থানার পূর্বপাশে কুলিক নদীর তীরে মালদুয়ারে রাজা টঙ্কনাথের রাজবাড়ি। রাজবাড়িটির খুব কাছেই রাধামাধব মন্দির। ১৮৫০ সালের দিকে জমিদার বুদ্ধিনাথ চৌধুরী বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। একই সময়ে তিনি কয়েকটি বিদ্যালয়ও নির্মাণ করেন। মন্দিরটিও ঐ সময়ে নির্মিত হয় বলে স্থানীয়ভাবে জানা যায়। ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে নির্মিত তিনতলা বাড়িটির বিভিন্ন অংশের কাজ শেষ করেন রাজা টঙ্কনাথ চৌধুরী। মন্দিরটি বাড়ি তৈরির সমসাময়িক হলে এর বয়স প্রায় ১৫০ বছর।

দেশীয় রীতিতে ইটের তৈরি আটচালা মন্দিরটির সারা গা জুড়েই রয়েছে অসংখ্য কারুকাজ। জ্যামিতিক নকশা ছাড়াও নানা প্রাণী ও উদ্ভিদচিত্র পুরো মন্দিরের গা জুড়েই অলঙ্কৃত করা হয়েছে। সাধারণত মন্দিরগাত্রের অলঙ্করণগুলো পোড়ামাটির ফলক দিয়ে আবৃত থাকে। এখানে পোড়ামাটির ফলকচিত্র ছাড়াও ইট কেটে বা পলেস্তারা নকশা করে ফলক খোদিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে এই অনন্যসাধারণ মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, মন্দিরের পুরোহিত ও টঙ্কনাথ চৌধুরী পরিবারের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যান। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে এই মন্দির।

সম্প্রতি আমাদের অনুপ্রেরণায় স্থানীয় জনসাধারণ এই মন্দিরটি পুনরানয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্দিরের আদি বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই ব্যবহারোপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম ও ব্যয়-পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক কাজ-ও শুরু হয়েছে। এখন প্রয়োজন মন্দির পুনরানয়ন কাজকে বেগবান করার জন্য ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা।

এই মন্দিরটির সংরক্ষণ কাজ করতে প্রায় ২০ (বিশ) লাখ টাকা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত স্থানীয় উদ্যোগে ১ (এক) লাখ টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। বাকী টাকা কিভাবে সংগ্রহ করা যায়, সে বিষয়ে সচলদের কাছে পরামর্শ চাচ্ছি।

ঐতিহ্যবাহী প্রত্নস্থানগুলো বেছে বেছে ইউক্যালিপটাস লাগাচ্ছে কেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো?

ঐতিহাসিক স্থাপনার পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি

সম্প্রতি কোনো ঐতিহ্যবাহী প্রত্নস্থানে গিয়েছেন? গেলে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, স্থাপনাটির চারপাশে সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো। মহাস্থানগড় বলুন আর দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির-ই বলুন সবখানেই স্থাপনাটির বাফার এরিয়ার ভেতরেই আপনি হয়তো দেখেছেন, ইউক্যালিপটাস। সত্যি কথা বলতে কি, কিছু না জানলে আপনার হয়তো ভালই লাগবে- আর কিছু না, গাছ বলে কথা। ইন্টারনেটে একটু সার্চ দিলে আপনি হয়তো ইউক্যালিপটাস সম্পর্কে অনেক কথাই জেনে যাবেন। দ্রুত বর্ধনশীল এই কাঠদায়ী গাছের অর্থকরী গুণের বর্ণনায় অনেকে মুখরোচক তথ্যই আপনি পাবেন। তবে, অনেক কথাই আপনি পাবেন না। আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে কেন এই গাছের বিরুদ্ধে রীতিমতো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই সব তথ্য অনেক কম-ই পাওয়া যায়। তবে তবু আপনি জানতে পারবেন, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার মানুষ এই গাছের বিরুদ্ধে সোচ্চার- এই গাছ তাদের সনাতন কৃষি পদ্ধতি, পরিবশ এবং সংস্কৃতির জন্য হুমকি বলে তারা মনে করে। আমাদের দেশেও ফরহাদ মজহার-রা এই গাছের বিরুদ্ধে, তাদের প্রধান যুক্তি- ওই সনাতন হারালো বলেই। রাস্তার দু'ধারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানীর লাগানো ইউক্যালিপটাস, শিশু এবং অ্যাকাশিয়া বিষয়ে চিন্তার একটা সংখ্যাও বেরিয়েছিল।

আমরা প্রত্নতাত্ত্বিকরা ক্ষুদ্ধ অন্য একটি বিশেষ কারণে। এতোদিন ধরে এই গাছ আমরা কেবল রাস্তার দুই ধারেই দেখতাম, এই কাজের জন্য কয়েক বছর ধরে তারা প্রধানমন্ত্রীর বৃক্ষরোপন পুরস্কার-ও পেয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, ঐতিহ্যবাহী প্রত্নস্থানগুলোর চারধারে এই গাছ লাগানো। সত্যি কথা বলতে কি, যে উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী এই গাছ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে গণহারে লাগাচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যটি প্রত্নস্থানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেটি হলো- পানি শোষণ। এই গাছ বিপুল পরিমাণে পানি শোষণ করে। এর ফলে এটা সেচ ব্যবস্থা ও কৃষি ব্যবস্থার ওপর একটা প্রভাব ফেলে।

আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার পাশে এই গাছ লাগালে, এটা ভূমির পানি শোষণ করে, তখন ভূমি পাশ্ববর্তী স্থাপনার মধ্যে থাকা আর্দ্রতা শোষণ করে। এর ফলে ওই স্থাপনাটি আর্দ্রতা হারিয়ে নিজের মধ্যকার দৃঢ়তা হারায়। ক্রমাগত সঙ্কোচন ও প্রসারণের ফলে ভবন বা স্থাপনাটি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।

এবং আমি মনে করি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী এই কাজটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই করছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেশকে ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে দূরে রাখার জন্য এই রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজটি তারা করছে রাষ্ট্রকে পুরো অন্ধ রেখে। অথচ এই কাজের জন্যই তারা ফি বছর রাষ্ট্রীয় পদক পেয়ে যাচ্ছে।

যে চাষীদেরকে প্রলুব্ধ করে, ব্যাট এই গাছ লাগিয়েছে, তারা গাছগুলো কাটতে পারছে না। কারণ তাদের সাথে চুক্তি ছিল, এই গাছগুলো নির্দিষ্ট সময় আগে কাটা যাবে না এবং এই গাছের আশেপাশে কোনো দেশীয় গাছ লাগানো যাবে না। ফলে কৃষকের পক্ষে খুব একটা কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজের আইনগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাদের কাছে একটা অনুরোধ, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংসের জন্য তাদের এই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের বিরুদ্ধে একটা কিছু করুন।

***ইউক্যালিপটাস সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন। এই লিংকটি পাওয়া না গেলে আমাদের ওয়েবসাইট-টিতেও দেখতে পারেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ ২য় কিস্তি

বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণের কিছু ছবি আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে এবং আমাদের একটি ওয়েবসাইটের অ্যালবামে দেয়া আছে, কেউ আগ্রহী হলে দেখতে পারেন।

বালিয়া মসজিদের সবচেয়ে কাছের বাড়িটি নবীরুলের। সুতরাং মসজিদটির ইতিবৃত্ত নবীরুলের কাছে কিছু জানা যাবে ভেবে আমরা তার কাছেই প্রথমে জিজ্ঞেস করি। নবীরুল দ্বিধাহীন চিত্তে জানায় সে নিজের কানে স্পষ্টভাবে শুনেছে, এই মসজিদটির ভেতরে পরীদের আনাগোনার শব্দ, তাদের নূপুরের নিক্কণ তার কানে এখনও পরিষ্কার বাজে। নবীরুলের পরী-কাহিনী মসজিদটি সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প হলেও, সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গল্প হলো- রাতারাতি মসজিদটির গজিয়ে ওঠার কাহিনী। একরাতের মধ্যেই নাকি মসজিদটি তৈরি করা হয়, অতিরিক্ত অলঙ্করণ ও পুরু দেয়াল তৈরি করতে করতে ভোর হয়ে যাওয়ায় মসজিদটি শেষ করা যায়নি আর, গম্বুজ তিনটি তৈরি না করেই চলে যায় জীনপরীরা। অন্যদিকে ইছহাক চৌধুরী আমাদের শোনালেন বাঘ ও খরগোশের গল্প। এই মসজিদে নাকি একই সাথে বাঘ ও খরগোশ থাকতো। গাছপালার জঙ্গলটিতে একটি ছোট্ট গহ্বর করে একটি গুহা সৃষ্টি করেছিল সেই বাঘ। সেখানে সে বাচ্চাসহ থাকতো। নিজ চোখে মসজিদ সংলগ্ন পুকুরঘাটে বাঘের পানি খাওয়া এবং পানি খাওয়া শেষে গুহামুখ দিয়ে মসজিদগুহায় প্রবেশ করতে দেখেছেন ইছহাক।

এমন অনেক গল্প আপনি পাবেন ঠাকুরগাঁও জেলাসদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী বালিয়া গ্রামের এই মসজিদটি সম্পর্কে। অনেকে অনেক ভাবে আপনাকে গল্পগুলো বলবে। নানা মত, নানা ভাষ্য শুনবেন আপনি। তবে সবারই একটাই প্রশ্ন, এই প্রত্যন্ত পাড়াগায়ে কে বা কারা অথবা কেন এই নয়নাভিরাম স্থাপত্য নির্মাণ করেছিল। এমনকি স্থানীয় এলজিইডি-র ইঞ্জিনিয়ার লিটন পর্যন্ত বললেন, আমি তো এই এলাকায় আট বছর ধরে আছি, এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি, কোনো দিন তো এই মসজিদটি চোখে পড়েনি, এই মসজিদটি কি রাতারাতি তৈরি হলো?

না, নয়নাভিরাম মসজিদটি রাতারাতি তৈরি হয়নি। যদি স্থানীয় শাসককেই স্থাপনার নির্মাতা বলা হয়, সেক্ষেত্রে ‘মহারাজাধিরাজ’ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অন্তর্গত শালবাড়ি পরগণার জমিদার বিবি গুলমতি চৌধুরানী এই মসজিদের নির্মাতা। পরম্পরায় প্রকাশ, গুলমতি চৌধুরানীর পতি মেহের বক্শ-এর দাদা পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের পর নিপীড়নমূলক অবস্থায় আত্মরক্ষার্থে পাটনা থেকে জলপাইগুড়ি চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে তার পুত্র এবং মেহের বক্শ-এর বাবা রাজ-এ-মোহাম্মদ ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়ায় এসে ব্যবসা বাণিজ্য করে সমৃদ্ধি অর্জন করেন। স্থানীয় জমিদারের সাথে সুসম্পর্কের প্রেক্ষিতে তার ছেলে মেহের বক্শ-এর সাথে তৎকালীন জমিদারকন্যার পরিণয় সর্ম্পক স্থাপিত হয়। যদিও জমিদারী বিবি গুলমতি চৌধুরানীর নামেই ছিল, কিন্তু কার্যত শাসন করতেন মেহের বক্শ। ফলত মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন বলে পরম্পরায় প্রকাশ।

তিন-গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হলেও মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও অলঙ্করণে মুঘল রীতির স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। ভারবহনকারী বীম বা পিলার বিহীন ভবনটিতে ৪২ ইঞ্চি প্রশস্থ দেয়াল তৈরি করে ভার বণ্টন করা হয়েছে। সেই সাথে প্লাটফর্ম থেকে মাটির নীচ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেয়াল তুলে এর দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওপরের দেয়ালের প্রস্থ যদিও ৪২ ইঞ্চি, কিন্তু বর্তমান ভূমি লেবেলের (ইজিএল) ওপরে প্লাটফর্ম লেবেল পর্যন্ত দেয়ালের প্রস্থ ৭৪ ইঞ্চি, ভিত্তিতে তা আরও বেশি।

পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তনের আয়তাকার মসজিদ কমপ্লেক্সটিকে ‘সিড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলাচত্বর’ এবং ‘মূলভবন বা নামাজঘর’ এই তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়। ৯ফুট বাই ২১ ফুট আয়তনের দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি আলাদা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপত্য । মূলভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্থ। প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূলভবন একই প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। বর্তমান ভূমি লেবেল (ইজিএল) থেকে স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তির ওপর ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটের আকৃতি বর্তমান কালের ইটের মতো হলেও ইটগুলো আদর্শমানের, সঠিকভাবে পোড়ানো এবং কঠিনত্ব গুণ সম্পন্ন। এর রং লাল এবং সুন্দর সুপরিস্ফুট কাদামাটির কণা দিয়ে তৈরি। ইটে কোনো অলঙ্করণ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে তৈরি করা নকশা স্থাপন করা হয়েছে। অলঙ্করণে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি, পদ্ম ইত্যাদি আকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও পুরো মসজিদেই কমবেশি অলঙ্করণ রয়েছে, তবে প্রধান প্রবেশপথ, পূর্বদিকের দেয়াল এবং মিহরাবে বেশি নকশা স্থাপন করা হয়েছে। দেয়ালের কোথাও আস্তরণ করা হয়নি। দরজা-জানালা কাঠামো নির্মিত হলেও দরজা-জানালা নির্মিত হয়নি। প্রবেশ পথ ও মূল প্রবেশদ্বারের খিলানে এবং মূল ভবনের ভেতরের ভারবহনকারী খিলানে লোহার আংটাসহ রিং দেখা যায়। সম্ভবত বাতি ঝোলানোর জন্য এই আংটাগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।
(চলছে)

নাওযাত্রা-৩

তিন নম্বর কিস্তিটি লেখার আগে এক নম্বর কিস্তির একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে নেই। নজরুল ভাই এবং মুস্তাফিজ ভাই জানতে চেয়েছিলেন বারিকের টিলাটি কোথায়? ভারতের মেঘালয় থেকে নামা সহ্‌ইয়ং নদীটির প্রধান শাখা জাদুকাটা বাংলাদেশে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার যে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে, ওই সীমান্তে একটি টিলা আছে, তার নাম বারকির টিলা বা বারেকের টিলা বা বারিকের টিলা। ঢাকা থেকে গেলে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে তাহিরপুর, সেখান থেকে নৌকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পার হয়ে পৌঁছুতে হবে বারিকের টিলা। বন বিভাগের সংরক্ষিত বন এবং বিডিআর-এর চৌকি আছে এখানে। এক দিকে মেঘালয় (এই টিলাটিও মেঘালয়ের অংশ, তবে ছোট), অন্যদিকে নদী এবং জেগে ওঠা চর। আর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করছেন জৈন্তা আদিবাসীরা। সময় মতো যেতে পারলে কোনো আদিবাসী উৎসব-ও হয়তো দেখে আসতে পারবেন (যেমনটি আমরা পেরেছিলাম)। কয়েক ঘর মুসলমানও আছে, দু'এক ঘর খাসি বা অন্য আদিবাসীও পেতে পারেন। জুঁটিরা কয়েকটি জিনিস মনে রাখবেন, প্রথমত প্রায় সারা বছর বৃষ্টি হয়, সুতরাং বৃষ্টিরোধক জুতা, রেইনকোট এবং ছাতা নিয়ে যাবেন। রেইনকোট নিলেও ছাতা নেবেন, নইলে ছবি তুলতে পারবেন না। টিলায় ওঠার সময় সাবধানে উঠবেন। বনে যাবেন, যদিও অনেকেই নিষেধ করবে। নদীতে নামবেন না, ছোট নদী মনে হলেও অনেক গভীর। চরেও নামবেন না, চোরাবালি আছে নিশ্চিত, আমরা হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি। অবশ্যই রোগজীবাণু প্রতিরোধক সাথে নিয়ে যাবেন।

আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে জাদুকাটার কয়েকটা ছবি আছে, তবে বৃষ্টির কারণে এবং ব্যাটারিতে চার্জ না থাকার কারণে বেশি ছবি তুলতে পারিনি।

নাওযাত্রা-৩
সকাল হলো বাথরুমের তাড়ায়, নৌকাটিতেই সারলাম। নাস্তা হলো না ক্ষুধা নেই বলে, গোসল করলাম মধ্যনগর থানায় (মানে পুলিশস্টেশনে)। ছবি তুললাম, একটা মাথাল কিনলাম। পার্থরা স্কুলে সমাবেশ করলো, স্কুল প্রাঙ্গনে হাজার হাজার গাছের ভেতর বৃক্ষরোপন করলো। নাটক শুরু হলো নৌকা চলতে শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

নৌকায় লাগানো ব্যানারের বাঁশের খুঁটির সাথে ইলেকট্রিক তারের ছোঁয়া লেগে তড়িৎস্পৃষ্ট হয়ে একটি ছেলে নদীতে পড়ে গেল। আমরা ছিলাম পাশের নৌকাতেই। আমাদের নৌকানেতা জাহাঙ্গীর ভাই বাঁশ, বাঁশ বলে চেঁচাতে লাগলেন, আমি আর বিশ্ব বাঁশ খুঁজতে লাগলাম। আর আমাদের তিন উন্নয়নজীবী (ফারহাত, মর্তুজা এবং স্বপন) এবং তাদের ভাড়ায় আনা ক্যামেরাম্যান সুমন খুললেন তাদের ক্যামেরাগুলো। সবাইকে হতাশ করে, বাঁশের সাহায্য ছাড়াই ছেলেটি সাঁতরে নৌকায় উঠে এলো।

নাটকের দ্বিতীয় অংক শুরু হলো বৃষ্টি শুরু হবার পর। বৃষ্টি শুরু হলে স্বভাবতই আমি সদ্য কেনা মাথাল বের করলাম বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। ৫ সেকেন্ড বড়জোর ৬ সেকেন্ড হবে। তার বেশি এক ন্যানো সেকেন্ড-ও না। আমার মাথা থেকে মাথাল উধাও। চলে গেছে মর্তুজার হাত ঘুরে ফারহাতের মাথায়। শুরু হলো বাংলা সিনেমার বৃষ্টিভেজা নৃত্য- আমি এটা পড়ে ছবি তুলবো, আমি এটা পড়ে ছবি তুলবো। এক নায়িকা দুই নায়ক। একজন মাথায় পড়িয়ে দিলেন (যেন মাল্যদান করলেন), অন্যজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকার রেলিংয়ে ব্যাঙঝোলা হয়ে নায়িকার ছবি তুললেন।

ও, বলতে ভুলে গেছি, প্রতি নৌকাতেই তিনটি করে লাইফ জ্যাকেট দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ছেলেটি নদীতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য মঞ্চস্থ হওয়ার পরপরই নায়ক-নায়িকারা কস্টিউম বদলের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়লেন।

বাদশাগঞ্জ বাজার। সেলবরষ ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারি খাদ্যগুদামের চত্বরেই অবশ্য আমাদের অবস্থান। এখানে একটা নৌকায় হাটের ছবি তুললাম। মানে নৌকা নৌকাতেই হাট বাজার। নৌকাতেই দোকান, খদ্দের-ও আসেন নৌকা করেই।

ধর্মপাশা বাজার। এখানে লোকজন অনেক দেখা গেল। কয়েকটা কামারের দোকানে কাজের ছবি তুললাম।

রাতে নৌকাতেই থাকলাম, কিঞ্চিৎ অমৃতপানের পর নাসিকা গর্জন।
(চলছে)

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ সংরক্ষণ

ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে তৈরি মসজিদটিকে মুঘল আমলের তৈরি বলে মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি নির্মিত হয় আরও অনেক পরে। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় বঙ্গাব্দ ১৩১৭ সালে। স্বভাবতই প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম, মসজিদটি হয়তো ১০০ বছরেরও কম সময় আগে নির্মিত। কিন্তু নির্মাণকারী মেহের বক্শ সরকার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এবং মসজিদটির দেয়ালের কিছু অংশ খোলার পর বেরিয়ে আসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। প্রথমত, মসজিদের নির্মাতা মেহের বক্শ সরকারের কবরেও তার মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা আছে ১৩১৭ সাল। মেহের বক্শের মৃত্যুর সময়েই যদি মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে (যেমনটি স্থানীয় মানুষেরা আমাদের বলেন), তবে তা কোনোভাবেই ১৩১৭-এ নির্মিত হতে পারে না। মেহের বক্শ এর পরিজনরা আমাদের জানান, মেহের বক্শ মসজিদটি নির্মাণ করার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি নিয়ে আসেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্তির আগেই স্থপতি মারা গেলে মসজিদের কাজ থেমে যায়। বেশ কয়েক বছর স্থগিত থাকার পর, মেহের বক্শ স্থানীয় নির্মাতাদের নিয়ে নিজেই মসজিদের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু শেষ করার আগেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। এ পর্যায়ে আরো কয়েক বছর মসজিদের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। মেহের বক্শের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারো উদ্যোগ নেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নির্মাণকাজ সমাপ্ত না করেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় মানুষ এবং মেহের বক্শ-এর পরিবারের কাছে এভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যায় যে, এই মসজিদটি সম্পন্ন হবার নয়, কেননা এটিতে অশুভ ছায়া রয়েছে। কাজেই শতাধিক বছর ধরে পরিত্যক্ত হয়ে জনমানসের আড়ালে বৃক্ষ ও শ্বাপদের আশ্রয়ে পরিণত হয়। এই তথ্য থেকে মনে হয়, মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগেই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। অপর দিকে, সংরক্ষণ কাজের অংশ হিসেবে ফাটল ধরেছে এবং আলগা হয়ে পড়েছে এমন একটি অংশকে আমাদের খুলে ফেলতে হয়েছে। দেয়ালের যে অংশটি খোলা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মসজিদের ১১ ইঞ্চি গভীরে অলঙ্করণবিহীন হুবুহু একই নকশার একটি স্থাপনা। পুরো মসজিদেই এই ১১ ইঞ্চি দেয়ালের ভেতরের স্থাপনাটি আছে, যা পূর্ববর্তীকালের নির্মিত। শুধু তাই নয়, এই ভেতরের স্থাপনাটির ইটের আকৃতি, গঠন এবং মর্টারের সাথে পরবর্তীতে নির্মিত ইটের আকৃতি, গঠন ও মর্টারের পার্থক্য রয়েছে। স্পষ্টই এই দুয়ের নির্মাণকালের পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে। তবে তা কতো আগের তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই তথ্যসমূহ মিলিয়ে আমরা মসজিদটির প্রাক্কলিত বয়স নির্ধারণ করেছি, ১২০ বছর। তবে (ব্যয়বহুল বলে) বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স এই ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি।

মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর পর যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং প্রচলিত মিথ ও ভীতির কারণে মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি অথবা এটিকে কোনো রকম যত্ন-আত্তিও করা হয়নি। অযত্ন-অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে মসজিদের বিভিন্ন অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমগ্র দেয়াল জুড়ে পাকুড় ও অন্যান্য জাতের গাছপালা, মস, শৈবাল, ছত্রাক রয়েছে, নোনা ধরেছে এবং ফাটল রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মসজিদ উপকরণের অপব্যবহার এবং খোঁচাখুঁচি ও ঝাঁকানোর কারণেও মসজিদটি তিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় ইট ক্ষয়ে গেছে, আলগা হয়ে গেছে, কোণা ভেঙ্গে গেছে অথবা ফেটে গেছে। ছাদের লেবেলে কয়েকস্তর ইট খুলে পড়ে গেছে। মর্টারের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষনীয়। অনেক জায়গায় মর্টার ক্ষয় হয়ে ইট খুলে পড়েছে। গাছের শিকড়ের কারণে প্রায় সব অলঙ্করণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং যেগুলো টিকে আছে তা-ও দেয়াল থেকে আলগা হয়ে আছে। অলঙ্কৃত স্তম্ভগুলোতেও ফাটল ধরেছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্তম্ভসহ দেয়ালের ওপর থেকে নিচ বরাবর লম্বালম্বি ভাবে ফেটে গেছে।

ইট ও মর্টারের ফাঁকে এবং দেয়ালের ফাটলে বসতি স্থাপন করেছে সাপ, বিছা, চিকা, শেয়াল, খাটাস, মাকড়সা, টিকটিকি, পিঁপড়া ও নানা ধরনের পোকামাকড়; আর স্কুইঞ্চগুলোতে কয়েকটি মৌচাক।

এই রকম একটি অবস্থাতেই আমাদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে পুনঃনির্মিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। বাংলাদেশে বিজ্ঞানসম্মত প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে এটি একটি। বলা বাহুল্য অপর উদ্যোগগুলোও আমাদেরই। (চলবে)

নাওযাত্রা-২

টেকেরহাটের কয়লাশ্রমিক; ছবি: বিশ্বজিৎ দাস

১২ জুলাই ২০০৮
নাওযাত্রার দ্বিতীয় দিন

এক.
পরিকল্পনা মতো সময়ে শুরু করা যায়নি। নাস্তা খেতে পারেননি অনেকেই (নাস্তার স্বল্পতা)।
দুই.
টেকেরহাট বড়ছড়া বাজারে প্রমিত বাংলায় একটি সমাবেশ করা হলো, আয়োজকেরা ছাড়া উপস্থিতি বড়জোর ২০, উকিঁঝুকিঁ-জিজ্ঞাসা আরো ১৫-২০ জন। বক্তব্য স্থানীয় মানুষের বিরোধী, স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষের প্রধান কাজ ছড়া (ঝর্ণা) থেকে কয়লা আহরন, আয়োজকরা মনে করে, এই কাজ অবৈজ্ঞানিক ও মানবেতর। স্থানীয় একজন শ্রমজীবী নারী বললেন, "তুমরার এই কতার লাগিই তো বিডিআর আমরারে দৌড়ায়"।
তিন.
দুপুরের খাবার আগের মতোই দেরিতে এবং অর্ধসিদ্ধ। কেউ কেউ বললেন, আয়োজকরা চাচ্ছেন- কিছু কিছু নাওযাত্রী বিদেয় হোক। এটিএন বাংলার সাংবাদিক ভাই বরাবরের মতো খাদ্যস্বল্পতায় ক্ষুব্ধ।
চার.
আজকেও ব্যাপক ফটোসেশন চললো। ও বলতে ভুলে গেছি, বড়ছড়ায় ফারহাত বললেন, খাসিয়া রাজার ছেলেও তার ভাই, ভাস্তেও তার ভাই। রাজকীয় তৈলমর্দন আর কাকে বলে?
পাঁচ.
সাড়ে দশটার দিকে নৌকা এল মধ্যনগর, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম তিনজনের মালপত্র আর চারজন লোক উধাও। (অ্যাকশনএইডের ফারহাত, ইনসা (বাউপ)-এর মর্তুজা, রুট-এর স্বপন)। তারা তিনজন থাকবেন চেয়ারম্যানের বাংলোতে। খাবারের ছবি না তোলার ঝাড়ি সুমন সম্ভবত দ্রুত ভুলবে না, আপার ঘুমানোর (?) ছবি তোলার জন্য খোলা ক্যামেরা হাতে সেও দৌড় দিল তাদের তিনজনের পিছু পিছু।
ছয়.
রাতে খেলাম বরিশাল হোটেলে, আগের দেড়দিনের তুলনায় অমৃত।
সাত.
তারপর সত্যিই অমৃত খেলাম, রেড লেবেল। নৌকার সামনে নদীর পাড়ে বসে রাত (অথবা সকাল) ছয়টা পর্যন্ত তর্কাতর্কি (অথবা মাতলামি) চললো। রাতটা ভালই কাটলো।
(চলছে)

Saturday, November 14, 2009

হায় নাওযাত্রা!!!



১১ জুলাই ২০০৮
নাওযাত্রার প্রথম দিন

এক.
পরিকল্পনা মতো আমরা সময় মতোই পৌছুঁলাম। আমরা ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি বুঝি মানুষের জন্য আমরা কিছু করতে এসেছি, প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঢেউয়ে তাই মনে হচ্ছিলো, হয়ে গেলো বোধ হয়। প্রথম দিনেই চার সেট জামাকাপড় ভেজালাম এবং এক সেট হারালাম। পরে অবশ্য বুঝলাম এটাও এক ধরনের 'উন্নয়ন পিকনিক', শুধু ন্যায্য বা স্থায়ীত্বশীল শব্দগুলো যুক্ত হবে।
দুই.
তাহিরপুরে জৈন্তিয়া ছিন্নমূল সংস্থার একটা সাইনবোর্ডে কেয়ার এবং ইইউ-এর নাম দেখলাম, এই প্রোগ্রামেও তারা আছে, ভালই কামাচ্ছে।
তিন.
বারিকের টিলা বাংলাদেশের খুবই সুন্দর জায়গাগুলোর অন্যতম, বিয়ের আগে প্রত্যেক প্রেমিক জুটির এখানে যাওয়া উচিৎ। বিয়ের পরেও (যদি) প্রেম থাকে, যেতে পারে।
চার.
দুপুরের খাবার এলো সাড়ে পাঁচটায়-ছয়টায়। এটিএনবাংলার এক সাংবাদিক খাদ্যস্বল্পতায় দারুন ক্ষুব্ধ হলেন।
পাঁচ.
যদিও থাকার কথা ছিল নৌকায়, জেনারেটর সমস্যায় থাকতে হলো বাংলোয়। ভালো ঘরগুলো অবশ্য দেয়া হলো অথবা নিলেন অ্যাকশনএইডের ফারহাত আর বাউপ-এর মর্তুজা।
ছয়.
রাতের খাবারে আবার অর্ধসিদ্ধি, আবার স্বল্পতা, আবার ক্ষোভ। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ফারহাত, তার ক্যামেরাম্যান সুমনের ওপর, "ক্যানো আমার খাবারের দৃশ্য ভিডিও করা হচ্ছে না?" বৃষ্টির জন্য ক্যামেরা ঢুকিয়ে রেখে বেচারা মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছে। ফারহাতের দ্বিতীয় ক্ষোভ, তার ঘরের প্লাগপয়েন্ট গোল গোল, অথচ তার ল্যাপটপের ব্যাটারিপ্লাগ চ্যাপটা। আর তার তৃতীয় ক্ষোভ, খাবার রান্না ভাল হয়নি। বোঝো ঠেলা!!!

(চলছে)

* ঠিক এক বছর আগের ঘটনা লিখছি এটা। বাংলাদেশের সবচেয়ে দায়িত্বশীল এনজিও অ্যাকশনএইডের একটা আয়োজন ছিল- নৌকায় করে পুরো হাওর এলাকা ঘোরা এবং চলতি পথে স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে হাওর অঞ্চলের মানুষের মঙ্গামুক্তির জন্য "স্থায়ীত্বশীল" উপায় খুঁজে বের করা। নাওযাত্রার সেই মিছিলে আমিও ছিলাম, ডায়েরীতে লিখে রাখা নোটগুলোই তুলে দিলাম। কারণ সামনেই বাসা বদল করবো এবং ডায়েরিটাও যথারীতি হারিয়ে যাবে। দু'একদিনের মধ্যেই তুলে দিবো তেল গ্যাস রক্ষা আন্দোলনের লং মার্চের মশকরাগুলো।