Friday, February 5, 2016

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কার পেয়েছেন?


জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি-এর ওয়েবসাইটে পুরস্কারের বিবরণীতে বিষয়টি উল্লেখ করা আছে।

শেখ হাসিনা পুরস্কার পেয়েছেন পলিসি লিডারশিপ ক্যাটেগরিতে। এই ক্যাটেগরিতে বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এ পুরস্কার পেলেন। প্রধানমন্ত্রীকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন।

প্রশ্ন হতে পারে, পলিসি লিডারশিপে তিনি এমন কী কাজ করেছেন, যে জন্য তিনি এ পুরস্কার পেতে পারেন?
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কতৃর্পক্ষ যে কয়েকটি অবদানকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে, সেগুলো হলো-

এক. উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে;
দুই. শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন নয়, এটি বাস্তবায়নের জন্য ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে;
তিন. প্রতি বছরের বাজেটের ৬ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের জন্য;
চার. ২০১১ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বন ও জলাভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এর ফলে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ দশ শতাংশ বেড়ে গেছে।


জলবায়ু পরিবর্তন কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা কমিটির প্রধান ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার এমপি। কর্মপরিকল্পনাটির মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন- ২০০৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা (নাপা) প্রণয়ন করা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে এর একটি সংশোধিত সংস্করণ প্রণীত হলো।

২০০৮ সালে যারা কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করেন, সেই কমিটিতে ছিলেন সরকারের পক্ষ থেকে দুই যুগ্মসচিব কামার মুনীর এবং রবীন্দ্রনাথ রায়, বিআইডিএসের ড. আসাদুজ্জামান, আইইউসিএনের ড. আইনুন নিশাত, বুয়েটের অধ্যাপক রেজাউর রহমান, পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের কামরুল ইসলাম চৌধুরী, পরিবেশবিদ ড. রেজাউল করিম।
এই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের পেছনে বড় একটি ভূমিকা রাখেন ড. আতিক রহমান। ২০০৮ সালে তিনি পেয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কার। ২০০৯ সালের সংশোধিত ভার্সন প্রণয়নেও (অন্যদের পাশাপাশি) তার অবদান আছে।

মজার ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনে যে বিষয়টি অনেক বেশি (সম্ভবত সবচেয়ে বেশি) অবদান রেখেছে, সেই “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কর্মপরিকল্পনা”টি যারা প্রণয়ন করলেন, গত কয়েকদিনের হাসি-গান-আলোচনায় তাদের কোনো দেখা মিললো না। এবং ভুলে গেলে চলবে না, কর্মপরিকল্পনাটি ২০০৫ সালের নাপা’র ধারাবাহিকতা। নাপা প্রণয়নে যাদের অবদান আছে, তারাও স্মর্তব্য।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার প্রাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, সেটি হলো জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করা। গত ১ জুলাই ২০১৫ বাংলা ট্রিবিউনের “জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা কার পকেটে?” শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়- “অনেক আশা আর কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হলেও ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ আত্মসাতের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ গত ছয় বছরে রাজস্ব খাত থেকে এই তহবিলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৯০০ কোটি টাকা!” সূত্র:http://banglatribune.com/tribune/single/103171

যে প্রকল্পটিকে ব্যর্থ বলে সরকার নিজেই স্বীকার করছে, তার জন্য সরকারপ্রধানের পুরস্কারপ্রাপ্তিকে কী বলা যায়?
তৃতীয়ত, জাতিসংঘ বলছে বাংলাদেশে প্রতি বছরের বাজেটের ৬ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের জন্য।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় খাতে এক হাজার ২০ কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ বছরের মোট বাজেট ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার, সে হিসেবে বরাদ্দ ০.৩৩ শতাংশ, তবে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রকল্প থাকতে পারে, যাতে জলবায়ু ও পরিবেশের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে মোট বরাদ্দ আধা থেকে এক শতাংশও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে ছয়-সাত শতাংশ?

চতুর্থ ও সর্বশেষ বিষয়টি হলো, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এ সংশোধনীর জন্য দেশবিদেশে শেখ হাসিনা নিন্দাই শুনেছেন বেশি, এবারে এ জন্য পুরস্কৃত হলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের জন্য বিখ্যাত এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদটি যুক্ত হয়। এতে বলা হয়েছে- “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।”

জাতিসংঘ বলছে, এই সংশোধনীর কার্যকরী প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০ অনুসারে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার।

বাংলাদেশের বনভূমির হিসেব নিয়ে সরকারি তথ্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। কিন্তু সংখ্যাটি যে ক্রমাগত কমছে, এটি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অংকে আমি একটু কাচা, তাই দশ শতাংশ বৃদ্ধির হিসেব মেলাতে পারছি না।

ডানকান, ইকোনোমিক জোন আর একজন দীপার গল্প

১৮৫৮ সালের ২০ নভেম্বর। পণ্যবাহী এক জাহাজ এসে ভিড়লো কলকাতা বন্দরে। জাহাজে অনেক মালপত্রের সঙ্গে ছিলেন স্কট বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ উইলিয়াম। গ্লাসগো থেকে ভাগ্যান্বেষণে জাহাজে চেপেছেন। ব্রিটিশসিংহ তো বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই দেয়নি, বঙ্গলক্ষ্মী যদি দয়া করেন। বাংলা দেশের তুলা বিশ্ববিখ্যাত, খোদ আলেকজান্ডারের সভাসদরা কাপাসিয়ার কার্পাস তুলার গুণ গেয়েছেন। এখানকার মিহি তুলার মসৃণ সুতায় বোনা মসলিন পড়েন স্বয়ং ক্লিওপেট্রা।

উইলিয়াম ডানকান সেই তুলার কারবারই শুরু করলেন আরেক ব্রিটিশ প্যাট্রিক প্লেফেয়ারের সাথে। ১৮৫৯ সালে ভাই ওয়াল্টার ডানকানকেও নিয়ে এলেন। দুই ভাই আর প্যাট্রিক মিলে শুরু করলেন তুলার কারবার। কোম্পানির নাম হলো মেসার্স প্লেফেয়ার, ডানকান ব্রাদার্স এন্ড কোং, মোকাম ৬৪ ক্লাইভ স্ট্রিট, কলিকাতা।

ক্লাইভ স্ট্রিটের যে বাড়িতে অফিস, ওই একই বাড়িতে আরেক কামরায় বসে চায়ের ব্যবসা করতেন চার্লস লেকি নামের আরেক ইংরেজ। ভারতবর্ষে সবে চায়ের চাষ শুরু হয়েছে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায়। যুদ্ধের জন্য চীনা চায়ের রপ্তানি বন্ধ, এদিকে ব্রিটিশদের বেড টী ছাড়া ঘুমই ভাঙ্গে না। কাজেই হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ আর হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাস করে চায়ের উৎপাদন শুরু হলো ভারতবর্ষে- সিলেটে। সরকারি অনুকম্পা ও আতিশয্যে চার্লসের চায়ের কারবার রমরমা।

১৮৬০ সালের শেষ দিকে চিকিৎসার জন্য বছর খানেকের জন্য বিলেত যেতে হলে ভদ্রলোক ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান ডানকান ভাইদের। সেবারই চায়ের ব্যবসার সাথে ওদের পরিচয়। চার্লস ফিরে এলে ফের শুরু শুধুই তুলার ব্যবসা।

ইত্যবসরে বাংলার তাঁতশিল্পে কোস্পানির থাবা পড়েছে, তা চলছে মহারাণীর আমলেও। মসলিন তাঁতীদের হাত কেঁটে দেয়া হচ্ছে, তুলাচাষীদের বাধ্য করা হচ্ছে নীলচাষে। তুলা ব্যবসায়েও রমরমা ভাব মলিন হচ্ছে। সে ঝড়ের ঝাপটা ডানকান ভাইদের গায়েও লাগলো। ১৮৬৯ সালে ওয়াল্টার ব্যবসা ছেড়ে চলে গেলেন গ্লাসগো। বনিবনা না হওয়াতে প্যাট্রিকের সাথেও যৌথ ব্যবসা টিকলো না, আলাদা হয়ে গেলেন ১৮৭৪ এর ডিসেম্বরে।

মড়ার কলিকাতায় পড়ে রইলেন একা উইলিয়াম, যেভাবে একাই নেমেছিলেন কলকাতা বন্দরে। আর পড়ে রইলো নামসর্বস্ব নতুন কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্স এন্ড কোং। ঠিকানা সেই ৬৪ ক্লাইভ স্ট্রিট (পরে নামকরণ করা হয় নেতাজী সু্ভাষ বোস সড়ক)।

কয়েক বছর তুলা চালাচালি করে হঠাৎ প্রতিবেশি চার্লসের চায়ের ব্যবসার কথা মনে পড়লো। ১৮৮০ সালে ছোট লাটের কাছে কিছু জমির আবদার করলেন, উদ্দেশ্য চা বাগান করবেন। সরকার ভাগ্যবিড়ম্বিত যুবকের অনুরোধ রাখলো, চায়ে সরকারের অতিশয় ভক্তি কিনা! সিলেটের মাধবপুর এবং আশেপাশের এলাকায় পাঁচ হাজার (প্রকৃত আয়তন ৫৮০৬.৯৮ একর) একর জমি অধিগ্রহণ করে দেয়া হলো। সাথে উপহার দেয়া হলো শ্রমিকশোষক আইন, গিরমিট চুক্তি। অর্থাৎ শ্রমিক বংশানুক্রমে শুধু কাজই করে যাবে, কোনো মাইনে পাবে না বললেই চলে।

উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্য হলে যে কোনো ব্যবসাই লাভজনক হতে বাধ্য। আর সে লাভের গুড়ের টানে গ্লাসগো থেকে ওয়াল্টারও উড়ে এলেন মৌমাছির মতো। ডানকান ব্রাদার্স সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মহীয়ান হলো। ৩০ বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার একর জমি পঞ্চাশ হাজার একরে পরিণত হলো, সরকার বাহাদুর একের পর এক জমি অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ ভাইদের দিলেন।

১৯৪৭ সালে সদাশয় ইংরেজ সরকার ভারত শাসনের ভার আর বইতে পারলেন না, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের হাতে দুই দেশ তুলে দিয়ে পালালেন। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। কাজেই হোক ইংরেজ, পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশদের তাড়ালেন না, অধিকৃত জমি আর ব্যবসা যেমন যেমন ছিল, তেমনই রইলো। একাত্তরে পাকিস্তানও গেল, বঙ্গবন্ধু দেশজুড়ে সবই প্রায় জাতীয়করণ করলেন। কিন্তু রাখে খোদা মারে কে, ডানকান ভাইরা রয়ে গেলেন। ১৯৭২ সালে অধিকৃত জমি লীজের মেয়াদ নবায়ন করা হলো।

সব চলছিলো ভালই। গোল বাঁধলো ২০১৫-তে এসে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে করা নির্বাচনী অঙ্গিকার মতো আওয়ামী লীগ চাইছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে, দেশজুড়ে লাখো ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়া সাড়ে সাতশো ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবি এটি। শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, আলাদা শিল্পাঞ্চলও চাইছেন তারা। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা চান আলাদা মুদ্রণ শিল্পাঞ্চল, সফটওয়্যার ব্যবসায়ীরা চান আলাদা সিলিকন ভ্যালী ইত্যাদি। সব করা না গেলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়তো সম্ভব। সে মতেই হবিগঞ্জে ডানকানকে লীজ দেয়া পাঁচশো একর জমির (প্রকৃতপক্ষে ৫১১.৮৩ একর) লীজ বাতিল করে সে জমি সরকার ফিরিয়ে নিয়েছেন। কোম্পানিও তা মেনে নিয়েছে হৃষ্টচিত্তেই, সাড়ে ঊনপঞ্চাশ হাজার একর তো রইলো এখনো!

বিপদে পড়েছে চা-শ্রমিকরা। চা বাগানে যারা গিয়েছেন, শ্রমিকদের ঘরে, চিলতে উঠোনে দু'এক সপ্তাহ থেকেছেন, তারা জানেন, বাগানের পাশে এক ধরনের ঘেটোর মধ্যে থাকেন শ্রমিকরা। এ জীবনযাপনকে মোটেই মানবেতর বলা যাবে না। ওতে মানবেতর শব্দের অবমান হয়। ফার্মের পশুরা তো বিলাসী জীবনযাপন করে, ওদের কথা আলাদা, গৃহস্থ বাড়ির গরুছাগলও থাকে না- এমন বাড়িঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকে চা-শ্রমিকেরা। শুনে হেসে খুন হবেন, এরই মাঝে শ্রমিকের বাচ্চারা স্কুলে যায়, ফুটবল খেলে, নাটক করে, গান গায়। যেবার তথ্যচিত্র করতে গেলাম দীপা নামের চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হলো, সে সিলেট বিভাগীয় নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পুরো টুর্নামেন্ট সিলেটকে ডিফেন্ড করেছে সে, চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সিলেট। কিন্তু এখন দীপাকে ডিফেন্ড করার কেউ নেই। ওরা যে ঘরে থাকে সেখানকার জমি সরকার নিয়ে নিয়েছে। পঞ্চাশ হাজার একর জমির মধ্যে ডানকান শুধু সেই পাঁচশো একর জমিই ছাড়লো যেখানে শ্রমিকদের আবাস। সরকারের ভাষায়, "ওই জমিতে চা চাষ করার কথা থাকলেও, ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি পুরো জমিতে তা করছে না।" (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫)।

গৃহহীন দীপাদের আওয়াজে আসল কথাটিও কেউ কেউ বলছেন- শ্রম শোষণ। গিরমিট চুক্তি এখন আর না থাকলেও শ্রমিকরা আছেন ওই একই প্রথায়। পৃথিবীর কোনো স্বাধীন, সভ্য দেশে এমন কোনো প্রথা থাকতে পারে? গার্মেন্টেসে কমপ্লায়েন্সের অভিযোগে ব্রিটিশ মডেল বাংলাদেশি কাপড় খুলে ছুড়ে দেন, প্রতিবাদের মিছিলে টিভিতে বাইট দেন, তারপর? বাড়ি ফিরে ডানকান চায়ে গলা ভেজান? কিংবা অন্য কোনো কোম্পানির, যা বাংলাদেশ থেকেই গেছে। কই কোনোদিন গরম চায়ের পেয়ালা উইলিয়ামের মুখে ছুঁড়ে মারতে পারলেন না তো! আন্তোনিও হাসেন্তির কথা মনে পড়ে? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? কিংবা সব্যসাচীর আবৃত্তি?

"সেই বিরাট খামারটাতে কখনো বৃষ্টি হয় না
আমারই কপালের ঘাম দিয়ে গাছগুলোকে
তৃষ্ণা মেটাতে হয়
সেখানে যে কফি ফলে, আর চেরি গাছে
যে টুকটুকে লাল রঙের বাহার ধরে
তা আমারই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, যা জমে কঠিন হয়েছে
কফিগুলোকে ভাজা হবে, রোদে শুকোতে হবে,
তারপর গুড়ো করতে হবে
যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের গায়ের রঙ হবে
আফ্রিকার কুলির গায়ের রঙের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ
আফ্রিকার কুলির জমাট রক্তে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।"

আফ্রিকার কফি আর সিলেটের চা-- শ্রমিকের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।

ও, বলতে ভুলে গেছি- দীপা নাটকও করে। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে, "আপনি নাটক বানাইলে আমাকে বলবেন, আমি অভিনয় করবো"। আমিও মজা করে বলি, তুই অভিনয় করবি কিরে, তুই তো ঠিকঠাক বাংলায় কথাই বলতে পারিস না। ওর অনুযোগ, "কেন, পাতর (পাত্র) ভাষায় নাটক বানাবেন।" আমি বললাম, বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষা বাংলাদেশের মিডিয়া এমনকি সরকারও অনুমোদন করে না, চাকমা ভাষায় করা অং চাকমার অনুদানের সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছে জানিস না?

দীপারা যেদিন চ্যাম্পিয়ন হলো, সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরেছে ভারতের কাছে। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় চার কলাম ছবি, তিন কলাম খবর; খেলার পাতায় পুরো আট কলামই মুশফিকদের দখলে। খেলার দ্বিতীয় পাতার একদম শেষ খবরটি দীপাদের- এক কলাম দেড় ইঞ্চি। হারুক জিতুক প্রথম আলো পুরুষ ক্রিকেটের সঙ্গে আছে, তারপরেও তো দেড় ইঞ্চি দিয়েছে, অন্য কাগজে তাও নেই।

তাই দীপাদের আন্দোলনের খবরও মিডিয়াতে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও ওদের সাথে নেই। আমি ইকোনোমিক জোনের পক্ষের লোক, এ নিয়ে টিভিতে অ্যাডভোকেসি মার্কা প্রোগ্রামও করেছি, এখনও করছি। কিন্তু সেটা মরার বসতভিটা আর সামনের খোলা জায়গাটুকুতে কেন, যেখানে ফসলের মৌসুমে ওরা খানিক চাষ করে আর শুকনো মৌসুমে দীপারা ফুটবল খেলে, নাটক করে। ম্যানেজারের বাংলো, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলোর আশেপাশে সবমিলিয়ে এরচে' ঢের বেশি জায়গা পড়ে আছে।

তারও বড় প্রশ্ন- চা বাগানে শ্রম শোষণ থামবে কবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল বিতর্ক প্রসঙ্গে

যমুনা সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচির মূল্যায়ন-সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পে আমি কিছুদিন কাজ করেছি। তখন দেখেছি, সিরাজগঞ্জের হাটীকুমড়ুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত যে রাস্তাটি হয়েছে, সেটির নকশায় কয়েক দফা পরিবর্তন আনা হয় প্রভাবশালীদের বাড়ি/জমি রক্ষার জন্য।

ঢাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করতে গেলে প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ক্যান্টনমেন্ট আর বিডিআর। মাঝে মাঝে অন্য কেউ যদি ওদের মতোই দাপট দেখায়, ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ দর্শক হিসেবে সেসব দেখতে মজাই লাগে।

যেমন ধরুন, মেট্রোরেল প্রকল্প।

আরো দশ বছর আগেই হয়তো মেট্রোরেল হয়ে যেতো যদি দাতা সংস্থা জাইকার সাথে সরকারের আলোচনা আরো গতিশীল হতো। উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়ার স্বাভাবিক রাস্তা হলো এয়ারপোর্ট বনানী হয়ে। স্বাভাবিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ রুটেই মেট্রোরেল করতে জাইকার আগ্রহ ছিল, কিন্তু উত্তরপাড়ার জাঁদরেল বাবুদের সরকার সেই রুটে রাজি করাতে পারেনি। এ নিয়ে টানাপোড়েনে চলে গেছে কয়েক বছর। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতাও বেড়েছে। মেট্রোরেলের প্রধান অর্থ জোগানদাতা জাইকাকেও শেষাবধি উত্তরের কাছে হার মানতে হয়েছে।
প্রভাবশালীদের দাপটে উত্তরা থেকে মিরপুর পল্লবী আগারগাঁও হয়ে ঘুরপথে যে মেট্রোরেল হচ্ছে তা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হোঁচট খেয়েছে।

দর্শক হিসেবে বলতেই হচ্ছে, ‘বিষম মজা’!

তবে যেসব যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে মেট্রোরেলের বিরোধিতা হচ্ছে তা অনেকটাই হাস্যকর।

যেমন একজন লিখেছেন, “অন্য রেললাইনের মত টিএসসির পাশেও কাঁচা বাজারের দোকান বসবে, টিএসসির নাম হবে তখন টিএসসি বাজার, সদরঘাটের কাছে হওয়ায় এ বাজারে মাছের দর কম থাকবে”।

কেউ কেউ অবশ্য এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্ট এবং হিস্টোরিকাল ইমপরট্যান্স সার্ভে রিপোর্টের রেফারেন্সসহ যুক্তি দিয়েও আপত্তিগুলো তুলে ধরছেন।

পত্রপত্রিকায়, অনলাইনে, ফেসবুকে এবং সাধারণ আলোচনায় সবমিলিয়ে মোটামুটি তিনটি আপত্তি দেখা যায়-
এক. শব্দদূষণ ও কম্পন, দুই. ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্থাপনার ক্ষতি, তিন. ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ঝুঁকি।

শব্দদূষণ এবং কম্পনের ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের রুট নিয়ে করা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে নেতৃত্বদানকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হকের একটি উক্তিকে রেফারেন্স হিসেবে হাজির করা হয়। তিনি বলেছেন, “শাহবাগ থেকে টিএসসি, কার্জন হল- এই এলাকাটা ইনস্টিটিউশনাল এরিয়া। এখানে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। এখান দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যেতে হলে সাউন্ড প্রুফ ও ভাইব্রেশন কন্ট্রোলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে রাজু ভাস্কর্যসহ যে সব স্থাপনা আছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি ভেঙে যেতে পারে।” (বিডিনিউজ, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬)

‘সতর্কতা অবলম্বন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের রুট নেওয়া হলে কোনো ক্ষতি হবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক মোজাম্মেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাউন্ড প্রুফ ও ভাইব্রেশন মিনিমাইজ করলে তা হবে না”।’

মোটামুটি এটা যে কোনো পাগলেও বোঝে- শব্দ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণ না করে নির্মাণ কাজ করা হলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো স্থাপনারই ক্ষতি হতে পারে।

এবং এখানেই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন- আপনাদের শব্দ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কী?

প্রযোজক কাজল আবদুল্লাহ যেভাবে বলেছেন, “যে যাই বলুক, একফোটা শব্দ হবে না বা শব্দে এদের সমস্যা হবে না। এটা আমি মানতে রাজি নই”, আমি সেভাবে বলতে চাই না। যুক্তিসঙ্গত, বিজ্ঞানগ্রাহ্য সমাধান থাকলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, পাবলিক লাইব্রেরির পেটের ভেতর দিয়েও মেট্রোরেল চালিয়ে নিতে রাজি আছি। পৃথিবীর বহু দেশেই বহুতল ভবনের ভেতর দিয়ে পর্যন্ত মেট্রোরেল গেছে, সেসব ছবি আজকাল ফেসবুকে বেশ দেখছি।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল কোনো বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রী এবং সরকারের কেউ কেউ জনসভায় কিছু কথা বলছেন, যার অর্থ মেট্রোরেল চুপি চুপি ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে চলে যাবে, কেউ টেরটিও পাবে না।

আবার সরকারের সমর্থক কিছু অ্যাক্টিভিস্ট এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টকে ধরে পরিবেশের (শব্দ ও কম্পন) ক্ষতি ন্যূনতম রাখার ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের ব্যবহৃত ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম বা এমএসএস পদ্ধতিটিকে সামনে হাজির করছেন।

দুই পক্ষের সম্মানজনক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে আগ্রহবশত এ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করলাম। পৃথিবীর প্রথম দিককার মার্ক্সিস্ট পার্টি জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের বিখ্যাত নেতা Hans Georg Wagner, যিনি একজন বিজ্ঞানী এবং জার্মানির স্থপতি ও প্রকৌশলীদের নেতাও বটে, তার একটা লেখা পেয়ে গেলাম। খুবই সহজ ভাষায় লেখা এ প্রবন্ধে তিনি বলছেন, "With well designed, low-tuned floating trackbeds, high vibration attenuation levels can be reliably achieved. Supported on steel springs, long slabs or troughs provide advantages in terms of construction, installation and performance. Several applications are shown. The springs are generally accessible. They allow the fast and easy readjustment of deviated track levels. Being fatigue-proof and provided with an excellent anti-corrosion system, the springs are designed to a long lifetime".
শুধু তা-ই নয়, তিনি মোটামুটি অঙ্ক কষে দেখাচ্ছেন ট্রেনের গতি এবং স্প্রিংয়ের আকারের ওপর নির্ভর করে শব্দ ও কম্পন মাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আরো যারা আগ্রহী তারা ২০০৮ সালে প্রকাশিত Noise and Vibration Mitigation for Rail Transportation Systems edited by Burkhard Schulte-Werning, David Thompson, Pierre-Etienne Gautier, Carl Hanson, Brian Hemsworth, James Nelson, Tatsuo Maeda, Paul de Vos বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অনলাইনে বিনামূল্যেই বইটি পড়তে পারবেন।

কিন্তু আমি বা আপনি এসব বই পড়লে শুধু আমাদের জ্ঞানই বাড়বে। ঢাকা মেট্রোরেলে কী প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো উত্তর মিলবে না।

উত্তরটি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। তাদের জানাতে হবে, কোন্ প্রযুক্তি, কীভাবে তারা ব্যবহার করবেন এবং এটি করলে আসলে কী ক্ষতি হবে কিংবা হবে না।

আর, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা নষ্টের বিষয়টি আপেক্ষিক। রাজু ভাস্কর্য ঐতিহ্য নাকি টিএসসি? টিএসসির সামনে রাজু ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করে টিএসসির ঐতিহ্য, নান্দনিকতা নষ্ট করা হলো কেন? এসব প্রশ্ন থাক।

আমার কাছে মেট্রোরেল বলতেই মনে পড়ে কুড়িল ফ্লাইওভারের বিশালত্ব, মগবাজার ফ্লাইওভারের কর্মযজ্ঞ। যদিও মেট্রোরেল এর চেয়ে অনেক কম জায়গা নিয়ে চলবে এবং এর পিলার ও লাইনের প্রস্থও হবে অনেক কম। কিন্তু সেই কম জায়গাটুকু কতো? তিন ফুট? ছয় ফুট? দশফুট? শাহবাগ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাতের ওপর দিয়েই যদি মেট্রোরেল চলে যায় আমি তো টেরও পাবো না ওপরে কিছু আছে। কিন্তু তা যদি ফ্লাইওভারের মতো ঢাউশ হয়, তবে তা ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে, এমনকি পাশ দিয়ে নিয়ে যেতেও আমার আপত্তি আছে।

মোদ্দাকথা, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে পষ্ট করতে বলতে হবে, রেললাইনের প্রস্থ আসলে কতো? এর পিলারগুলো কতো চওড়া হবে এবং সেগুলো কোন্ কোন্ পয়েন্টের ওপর দিয়ে যাবে আর তার উচ্চতাই বা কী। বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই সারা দেশেরই ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক স্থাপনার দর্শনদারিতে অনেক ক্ষতি উন্নয়নের নামে আমরা নিজেরাই করেছি, উন্নয়নের “স্বার্থে” আরো কিছু ক্ষতি মেনে নিতেও আমরা প্রস্তুত, কিন্তু কতোটা?

তৃতীয়ত, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ঝুঁকি। রেললাইনের পাশে মাছের আড়ত বসলে কিংবা ছিন্নমূল মানুষের বস্তি গড়ে উঠলে নিরাপত্তা আসলেই হুমকির মুখে পড়বে। তবে এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব চিন্তিত নই। কোনো ফ্লাইওভারেই এখন পর্যন্ত মাছের আড়ত বসেনি, বস্তিও হয়নি। উচ্চতার কারণেই সম্ভবত কারওয়ান বাজার বা গুলিস্তান হয়ে ওঠেনি ফ্লাইওভারগুলো। আর মেট্রোরেলের প্রস্থ এবং উচ্চতা কোনোভাবেই সম্ভবত এ ধরনের সম্ভাবনা অনুমোদন করে না। শাহবাগে বাস স্টপেজ থাকলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে না পড়ে, তাহলে মেট্রোরেলের স্টপেজেও পড়বে না।
তবে দোয়েল চত্বরের পাশ দিয়ে শাহবাগের মতো গণপরিবহনের গতায়ত কম। কাজেই সেখানে জনসমাগম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। যদিও দোয়েল চত্বরে স্টপেজ থাকলে বইমেলাগামী মানুষের জন্য তা ভালই হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলায় লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ হলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে না পড়ে তাহলে দোয়েল চত্বরে স্টপেজ থাকলেও সম্ভবত হবে না। উপরন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং সদরঘাটের যাত্রীদেরও উপকার হবে। তবে সরকার চাইলে এই স্টপেজটি দোয়েল চত্বরে না করে আরেকটু এগিয়ে হাইকোর্ট মাজারের সামনে করা যেতে পারে। যদিও প্রেস ক্লাবের সামনে পরবর্তী স্টপেজটি সেক্ষেত্রে অনেকটাই অর্থহীন হয়ে যায়।

অর্থাৎ সব আলোচনার আগের কথা হলো- সরকারের প্রতিক্রিয়া, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য। প্রকল্পের শুরুতেই এ বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা এবং জনমত গঠন প্রয়োজন ছিল। সে নিয়ে একটি কমিটি এবং আলাদা বরাদ্দও ছিল, যতোদূর জানি। কিন্তু সুবিধান্বেষী ডিগবাজ মার্কা এক্সপার্টদের দিয়ে যেমন কোনো কাজ হয় না, এই কমিটিও যে তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি, এখনকার অবস্থা তার একটি প্রমাণ।

পিপলস ফেডারেশন কেন জরুরি?

বাংলাদেশের শ্রম আইনে উৎসব ভাতার কোনো বিবরণ ছিল না। এ নিয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। মালিকের ইচ্ছে হলে মূল বেতনের সমান বছরে তিনটি বোনাসও দেয়া হতো, আবার ইচ্ছে হলে বছরে মূল বেতনের কমও দেয়া হতো। শেষ পর্যন্ত এর একটা সুরাহা হয়েছে। শ্রম আইনে মূল বেতনের সমান সমান দুইটি উৎসব ভাতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশের পর তা কার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে।
২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের পরে কোনো মালিক যদি দুইবার মূল বেতনের সমান উৎসব ভাতা না দেন, তবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে এবং আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওই প্রাপ্য আদায় করা যাবে। কিন্তু মুশকিল হলো পেশাজীবীরা সাধারণত মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার ঝামেলায় যেতে চান না। যুক্তরাজ্যে ইউনিসন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নিজেদের পরিচয় দেয় পিপলস ট্রেড ইউনিয়ন বলে, তারা কর্মজীবীদের বেতন-ভাতা ও কর্মপরিবেশের অধিকার নিয়ে যেমন প্রচারণা, অ্যাডভোকেসি চালান, একইভাবে কর্মজীবীদের পক্ষে এসব মামলাও পরিচালনা করেন।
গত কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে দেখা গেল, অনেকেই বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগও নিয়েছেন। তবে পেশাভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নগুলো ছাড়া অন্য তেমন কোনো কার্যকর সংগঠন আছে বলে আমার মনে পড়ছে না। কারো জানা থাকলে জানালে ভাল হয়। যদি না থাকে তাহলে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নিলে কেমন হয়, সেটাও জানাতে অনুরোধ করছি।

ডাচ বাংলা ব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে অদক্ষ ব্যাংক?

দেশের বাইরের ফ্রিল্যান্স কাজ করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। কারণ বাইরের কাজ করে টাকা দেশে আনা খুব জটিল বিষয়। তারপরেও পুরনো সম্পর্কের খাতিরে সিঙ্গাপুরের একটা প্রতিষ্ঠানের হয়ে ছোট একটা কাজ করলাম। সম্পর্ক ভাল বলে তারাও দ্রুত পেমেন্ট করতে চাইলো। টাকাটা আমার ডাচবাংলা ব্যাংকের একাউন্টে টিটি করে পাঠালো।

এরপরে শুরু হলো নাটক, বরং প্রহসন বলা ভাল। ৬ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ২ টা ২৮ মিনিটে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংকের মাধ্যমে ডাচবাংলা ব্যাংকের রিং রোড ব্রাঞ্চের আমার একাউন্টে টাকা জমা করে। ব্যাংকের রশিদ এবং আমার ইনভয়েস স্ক্যান করে ওই দিনই আমাকে মেইল করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ৬ নভেম্বর শুক্রবার, বাংলাদেশের ব্যাংক বন্ধ, আমি ধীরে সুস্থে ৯ নভেম্বর সোমবার ব্যাংকে যাই, ব্যাংক থেকে জানায় শুক্র শনি বন্ধ থাকায় এখনো টাকা আসেনি, আপনি ২/১ দিন পরে আসুন। আমি ৩/৪ দিন পরে আবারো যাই। তখনো আসেনি। এদিকে সিঙ্গাপুর থেকে বার বার ওরা জানতে চায়, টাকাটা পেয়েছি কিনা। পরের সপ্তাহে আবার ব্যাংকে যাই। এবার ব্যাংক বলে- রশিদ দেখে মনে হচ্ছে, আপনার কোম্পানি ব্যাংকে টাকা জমা করেছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকাটা ট্রান্সফার করেনি। আপনি কোম্পানিকে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে যোগাযোগ করতে বলেন।

ব্যাংকে যোগাযোগ করার পর ব্যাংক থেকে একটা ডকুমেন্ট স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেয়, তাতে লেখা- ১২ নভেম্বর ২০১৫ সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক বাংলাদেশের ডাচবাংলা ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করেছে। ট্রান্সফার নম্বর, সময় এবং ট্রান্সফারের জন্য ব্যাংকের অতিরিক্ত ৪০ ডলার হ্যান্ডলিং এবং কেবল্ চার্জও যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি পরিশোধ করেছে, সবকিছুই সেখানে লেখা আছে। কিন্তু ডাচবাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তারা কোনোভাবেই এর তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ করি, তারা খুঁজে পান না। অহেতুক ব্যাংকে যাওয়াও অর্থহীন হয়ে ওঠে, তাই একদিন নিজেই নিজের একাউন্টে কিছু টাকা জমা দেই। একদিন কিছু টাকা তুলি। এর মধ্যে একদিন আমার ডেবিট কার্ডের ধরন বদলে মাস্টারকার্ড দেয়ার জন্য আবেদন করি। মোটামুটিভাবে নানা অহেতুক কাজকর্ম করে প্রতি সপ্তাহে ব্যাংকে যাওয়াটাকে অর্থবহ করার নিষ্ফল চেষ্টা করি।

আড়াই মাস কেটে গেল। আমার টাকাও আসে না। এদিকে যে মাস্টারকার্ডের জন্য আবেদন করেছি, তাও আসে না, যদিও প্রায় দেড় মাস আগে কার্ডের বার্ষিক চার্জ বাবদ ৯২০ টাকা ব্যাংক ঠিকই কেটে নিয়েছে।

এর মধ্যে গত সপ্তাহে হঠাৎ করে ব্যাংক আমার টাকাটা খুঁজে পায়। ১২ নভেম্বরেই নাকি এসেছে। তবে ডাচবাংলা ব্যাংকের ৪০ ডলার সার্ভিস চার্জ কেটে বাকিটা আছে। দুই পক্ষকেই সার্ভিস চার্জ কেন দিতে হবে, সেই প্রশ্ন আর করলাম না, টাকার খোঁজ পাওয়া গেছে, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা সি ফর্ম ফিলআপ করতে দেয়, দিলাম।

এরপর কেটে গেল আরো এক সপ্তাহ। সিঙ্গাপুর থেকে টাকা পাঠানোরও তিনমাস পূর্ণ হলো। এখনো আমার একাউন্টে জমা হয়নি সেই টাকা।

ডাচবাংলা ব্যাংকের জঘন্য সার্ভিসের অভিজ্ঞতা এটিই প্রথম না। এর আগেও টাকা আসার সময় তারা আমাকে ডিবিবিএলের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত দৌড় করিয়েছিল। কিন্তু এর পরে কয়েকবার সহজেই টাকা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর হয়তো ঝামেলা হবে না, তাই দেশের সবচেয়ে অলস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই একাউন্ট নম্বরটি সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানে দিয়েছিলাম এবং সেটিই ছিল আমার প্রধান ভুল। এখন সেই ভুলেরই খেসারত দিচ্ছি।