Sunday, May 6, 2007

ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প : ঐতিহ্য???

কয়েকদিন আগে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে। খুবই আগ্রহ নিয়ে, আন্তরকিতার সাথে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক-প্রযোজক ধামরাইয়ে প্রস্তুত কাসা-পিতলের মূর্তিগুলো দেখাচ্ছিলেন। আমরা জানতে পারলাম, সুপ্রাচীন হরিশচন্দ্রপালের বিহারে খনন করেও কয়েকটি তামা-পিতলের মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। সুতরাং সেই পাল আমল থেকেই যে এখানে তামা-পিতলের শিল্প গড়ে উঠেছে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তার ওপরে যুক্ত হয়েছে ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ। মোটামুটি মৌর্য শাসনামল থেকেই যে ধামরাই বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটি তো বাংলার ইতিহাস-রচয়িতারাই বলে দিয়েছেন। সুতরাং টিভি অনুষ্ঠানে যদি ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পকে বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের নিদর্শন বলে প্রচার করা হয় কিংবা ধামরাইয়ের ভাস্কর্য বানানোর পদ্ধতি‌ সেরে পার্দু বা লস্ট ওয়াক্স মেথডকে যদি দুনিয়ার অনন্য পদ্ধতি হিসেবে বলার মধ্য দিয়ে জাতিগত ঐতিহ্য-বোধের অহমিকাকে আরো একটু বাড়ানো যায় তাহলে সে সুযোগ কে নিতে না চাইবে? এজন্য বিদেশি কিছু মানুষের সার্টিফিকেটের যে গুরুত্ব রয়েছে, এটাও আমাদের মিডিয়া বোঝে এবং সে জন্য কিছু সাদা চামড়ার মানুষের মুখ দিয়েও তারা এই ঐতিহ্যবাহী (?) শিল্প সম্পর্কে ছাড়পত্র গ্রহণে পিছপা হয়নি। টিভির একটা অনুষ্ঠান নিয়ে এতো কথা বলার কারণ, ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে বিটিভি যে দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করলো, আমরা সবাই কমবেশি ঐ রকমই ধারণা মনে মনে পোষণ করি। মজার ব্যাপার হলো, ওপরে ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে টিভির যে মতামত আলোচনা করা হলো, তার প্রায় পুরোটাই ভুল। এক কথায় ভুল বলে দেওয়াটা কোনো বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি হতে পারে না। কিন্তু ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে ট্রান্সন্যাশনাল কালচারিস্টরা যে মিথ তৈরি করেছেন, তার বিপরীতে এর চেয়ে ভালো ভাবে বলা সম্ভব নয়। আপনি কি জানেন, ধামরাইয়ের নামকরণ নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে বাংলার ইতিহাসবেত্তাগণ কতো দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং তার প্রায় পুরোটাই করেছেন কোনো ধরনের মনোযোগ না দিয়েই? রূঢ় মনে হচ্ছে বাক্যটি? তাহলে শুনুন, ধামরাইয়ের নাম ধামরাই হয়েছে ধর্মরাজিকা থেকে, একথা তো প্রায় সব ইতিহাসবিদ জানেন। ঐ ধর্মরাজিকা যে সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন এটাও আমাদের প্রায় সবার জানা। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হলেন যে, ধর্মরাজিকা থেকেই ধামরাইয়ের নাম এসেছে? দীনেশচন্দ্র সেন এবং যতীন্দ্রমোহন রায় এ প্রসঙ্গে একটি দলিলের কথা বলছেন। দলিলটি মোগল আমলের, ঐ দলিলেই নাকি লেখা রয়েছে, ধামরাইয়ের নাম ধর্মরাজিকা। দলিলটির একটি কপি আবার ঐ বইয়েই দেয়া আছে। আপনি ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, দলিলটিতে ধামরাই শব্দটি রয়েছে, ধর্মরাজিকা নয়। ধরে নিচ্ছি, দলিলটির অন্য কোথাও হয়তো ধর্মরাজিয়া বা ধর্মরাজিকা শব্দটি ছিল। কিন্তু অশোকের পর প্রায় ১৯০০ বছর কেটে যাওয়ার পর অশোক নির্মিত ধর্মরাজিকার নামের জন্য মোগল আমলের একটি দলিলের শরণাপণ্ন হওয়া কতোটা নির্ভরযোগ্য হতে পারে? আপনি হয়তো বলবেন, কেন, ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ? ওটাকেই তো আমরা সূত্র হিসেবে নিতে পারি। কয়েকজন ইতিহাসবিদ অবশ্য তা-ই নিয়েছেন। সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে বীরেন্দ্রনাথ বসু ঠাকুরের একটি কথা নিয়ে। ঠাকুর তার পূর্ব্ববঙ্গের পালরাজাগণ বইয়ে ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ধামরাইয়ের পার্শ্ববর্তী শাকাসর নামক গ্রামের একটি স্তম্ভকে অশোক স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বইটি প্রকাশিত হবার পর, স্টেপলটন সাহেবের কাছে সংবাদ পেয়ে তিনি ঐ স্তম্ভটি দেখতে যান। (তার মানে আগের মন্তব্যটি তিনি করেছেন, না দেখেই) স্তম্ভটি দেখার পর তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ঐ বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি সংশোধনী আকারে ধামরাইয়ের তথাকথিত অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে তার নতুন অবস্থান ব্যক্ত করেন। মূল বইয়ে তিনি যেখানে স্তম্ভটিকে অশোক নির্মিত বলে মন্তব্য করেছিলেন, পরিশিষ্টে এটাকে তিনি পরবর্তী পাল-যুগের কোনো রাজাদের নির্মিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। আগে তিনি বলেছিলেন, এটা ধামরাই থেকে শাকাসরে আনা হয়েছে, এখন তিনি বললেন, এটা শাকাসরেরই, ধামরাইয়ের নয়। ঠাকুরের এই মত পরিবর্তন তার সরেজমিন পর্যবেক্ষেণের ফল। কিন্তু আমাদের ইতিহাসবিদরা সরেজমিন পর্যবেক্ষণে অনীহ। মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস নির্মাণে আগ্রহ খুবই কম। পাঠাগারভিত্তিক গবেষণাই যেন পণ্ডিত হবার পথে প্রধান উপায়! আর তাই এমনকি বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বাইবেল নামে খ্যাত আকম যাকারিয়া-র বাংলার প্রত্নসম্পদ বইয়েও এই নিদর্শনটি অনুল্লেখিত। শুধু তাই নয়, ১৯১৩ সালের পর ২০০৭ সালে শাওন আকন্দের লেখা "ধামরাই জনপদের কাঁসা-পিতল শিল্প" বইটিতেই প্রথম এই স্তম্ভ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হলো।



ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে ধামরাইয়ের ইতিহাস কতোটুকু জরুরি? অনেকটাই। কারণ যদি ইতিহাস সম্পর্কে আপনার পরিচ্ছন্ন ধারণা না থাকে, আপনি মনে করবেন, ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে হয়তো ঐতিহ্য কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আপনি ভাববেন, অশোক না হোক পাল রাজাদের সাথে একটা যোগাযোগ নিশ্চয়ই ছিল! এভাবে আপনি একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যিক সম্ভ্রম নিয়ে ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়াবেন। স্বভাবতই আপনার চিন্তা কিছুটা প্রভাবিত হবে। এবং মজার ব্যাপার হলো, আপনি সম্ভবত ভুলকে সঙ্গী করেই এগুবেন। বস্তুত ধামরাইয়ের কাসা-পিতলের শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি ব্যবসা। সেটি হলো এন্টিক ব্যবসা। ১৯৭০-র দশক পর্যন্ত সত্যিকারেরর এন্টিক-ই কেনাবেচা হতো ধামরাইয়ে। এন্টিক যখন শেষ হয়ে যেতে থাকলো, তখন, এন্টিকের মতো ভাস্কর্য তৈরি করে বিক্রি করার আগ্রহ থেকে ১৯৮০-র দশকে প্রথম এখানে কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য নির্মাণ করা শুরু হয়। যে পদ্ধতিতে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়, বাংলাদেশে তা নতুন হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তা নতুন নয়। বরং কয়েক হাজার বছরের পুরনো। এভাবেই শাওন আকন্দ ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পের ধাতব জগতে প্রবেশের আগে আমাদেরকে ধামরাই অঞ্চলের এ যাবত কালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা করেন। আর ধামরাই অঞ্চলের কাঁসা পিতলের শিল্প সম্পর্কে বাংলা ভাষায় লিখিত সবচেয়ে দরদী বিবরণটি আমরা পাই শাওনের এই বই থেকেই। সেরে পার্দু বা লস্ট ওয়াক্স মেথড ছাড়াও আরো দুয়েকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন লেখায় কিছু কিছু তথ্য পাই, কিন্তু শাওন আকন্দ কয়েক বছর ধরে ধামরাই ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের কারিগরদের সংস্পর্শে থেকে, নিজে কাঁসা-শিল্পবস্তু তৈরি করে পদ্ধতিগুলোর যে বিবরণ দেন, তা তুলনাবিহীন। হয়তো নিজের অগোচরেই পদ্ধতির বর্ণনায় তিনি মাঝে মাঝে উত্তম পুরুষে চলে আসেন "এবার আমাদের দরকার পড়বে দুই খণ্ডে বিভক্ত একটি..." ইত্যাদি বলার একটু পরেই আবার বলেন "কারিগর হাত দিয়ে ঠেসে ঠেসে এমনভাবে মাটি প্রয়োগ করে যেন..." ইত্যাদি, এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের আর কারিগরের মধ্যকার সীমারেখাটি মাঝে মাঝে ভুলে যান। আর তার মাধ্যমেই তিনি যখন ধামরাই অঞ্চলের শিল্পীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অনুভূতি তুলে আনার চেষ্টা করেন তার মধ্যে এক গভীর মমতা প্রকাশ পায়। ধামরাইয়ের কারিগর শ্রেণীর চর্চিত উৎসব, রীতিনীতি, দৈনন্দিনতার সঙ্গে শাওন গভীরভাবে মিশে যান, এরই ফলে এই কারিগরেরা তার কাছে বলতে পারেন ঘরের কথা, নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসের কথা। এমনকি সৃষ্টিকর্তা বিষয়েও মাঝে মাঝে তাদের মনে যে প্রশ্ন জন্মায় কিংবা সব ধর্মের প্রভু যে আসলে মূলে এক - এই ধরনের দার্শনিক চিন্তাও অবলীলায় তারা শাওনের সাথে আলাপ করে। আর শাওন আমাদের সাথে আলাপ করেন ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্পের শিল্পকলার দিকটি নিয়ে, কিভাবে পশ্চিমা শিল্পবোধ একটি দেশের একটি জাতির প্রধান শিল্প-ঘরানাকে লোকশিল্পের তকমা লাগিয়ে শিল্প নামক অভিজাত ধারণার বাইরে ঠেলে দেয় অন্যদিকে ধামরাইয়ের কারিগরের নয়শো টাকার জিনিশ মহাজন কিভাবে নয় হাজার টাকার বিক্রি করেন আবার তা-ই কিভাবে আমেরিকান মহাজনেরা তাদের বাজারে নব্বই হাজার টাকায় বিক্রি হয় অথচ ধামরাইয়ের শিল্পীরা বছরের পর বছর "শিল্পী হইয়া দাম পাইলাম না" ধরনের কথা বলেই যান। শাওন সম্ভবত প্রথম গবেষক যিনি ধামরাই সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন দলিলপত্র ও শিলালেখসমূহ অনুবাদ ও পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন, যা এই বইয়ের পরিশিষ্টে সংযুক্ত করা হয়েছে।



বি.দ্র. এই লেখাটি গত ৪ মে ২০০৭ দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছুটা পরিবর্তন করে তা এই ব্লগে প্রকাশ করা হলো।

Tuesday, April 24, 2007

ধামরাইয়ের তামা-কাসার শিল্প : ঐতিহ্য???

ধামরাইয়ের তামা-কাসার শিল্প : ঐতিহ্য???

কয়েকদিন আগে টিভিতে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো, এই মুহূর্তে নাম মনে আসছে না। ধামরাইয়ের তামা কাসার শিল্পের কয়েকটা মূর্তি দেখালো। বললো, এগুলো নাকি বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের নিদর্শন। শুধু তাই নয়, এখানকার ভাস্কর্য বানানোর পদ্ধতি ‌"সেরে পার্দু" বা "লস্ট ওয়াক্স মেথড" যে দুনিয়ার অনন্য পদ্ধতি তা-ও বললো। তারপর একজন সাদা চামড়ার মানুষের মুখ দিয়ে একটা সার্টিফিকেট নিলো। আসল কথা হলো, ধামরাইয়ের ভাস্কর্য শিল্প ২০-২৫ বছরের আগে শুরু হয়, আর সেরে পার্দু পদ্ধতি দুনিয়ার বহু জায়গাতেই আছে, এই দেশেই আসছে মাত্র ২৫ বছর হলো। এই ভাস্কর্যকে ঐতিহ্য বলার মাধ্যমে আসলে একটা শ্রেণী-বৈষম্যকে বৈধতা দেয়া হয়, তা হলো- ধামরাইয়ের আসল ঐতিহ্যবাহী শিল্প হলো তামা কাসার বাসনপত্র তৈরি। ভাস্কর্য নজরকাড়া হলেও আমাদের ঐতিহ্য নয়। ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ঐতিহ্যকে যেভাবে দেখতে চায়, ঐতিহ্য আসলে কখনোই তেমন নয়। বিস্তারিত জানতে পড়ুন শাওন আকন্দের লেখা বই "ধামরাই জনপদের কাঁসা-পিতল শিল্প"।

Wednesday, April 18, 2007

উয়ারী সভ্যতার নির্মাতা কারা?

উয়ারী সভ্যতার নির্মাতা কারা?
সোহেইল জাফর

মানুষের মননের, মনীষার, মঞ্জুষার মুক্তির মানে মানবের মহাজীবনের মুক্তি। আর এই মুক্তচেতনা যতই আধ্যাত্মিক মনে হোক না কেন, মানুষ তার বস্তুগত প্রয়োজন মেটাতেই বার বার এই মহাজীবনের দিকেই ফিরে এসেছে। মানুষের ইহজাগতিক প্রয়োজনেই মানুষ চায় ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করতে। অনিশ্চয়তার আশঙ্কা এবং অপ্রাপ্তির সম্ভাবনা মানুষকে যে অনাকাঙ্খিত বিপদের দিকে ঠেলে দেয়, সেই অভিজ্ঞতা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য মানুষকে বার বার তাগাদা দেয়।

উয়ারী-বটেশ্বর বাংলার মানুষের সমৃদ্ধ অতীত অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল অধ্যায়সমূহের অন্যতম। ঢাকা থেকে ৭০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদীতীরবর্তী গ্রাম উয়ারী। সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে বিকশিত একটি সমৃদ্ধ নগর-সভ্যতা। সর্বমোট ৪৮ টি জায়গাকে এই নগর-সভ্যতার বিস্তৃতি বলে চিহ্নিত করা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি স্থানে বৈজ্ঞানিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়েছে। সেই স্থানটি হলো উয়ারী, এই জায়গাটিকেই অবশ্য এই নগর-সভ্যতার কেন্দ্রবা রাজধানী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি বসতিস্থানকে নগরকেন্দ্র বা রাজধানী বলার জন্য যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয় তার সবক’টিই এখানে পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমত, নদীতীরবর্তী উয়ারী অঞ্চলটি ছিল একটি বাণিজ্যকেন্দ্র, এর পাশ দিয়ে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। উয়ারীর ভূ-প্রাকৃতিক বিন্যাস এবং উয়ারীতে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন বাণিজ্য-কেন্দ্র হিসেবে উয়ারীর সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে। দ্বিতীয়ত, উয়ারীর উন্নত নগর-পরিকল্পনা সমসাময়িক অন্যান্য নগর-সভ্যতার সাথে তুলনীয়। প্রশস্ত রাজপথ, বাইলেন, বৃহদাকার স্নানাগার (?), জলাধার, সুবৃহৎ এসেম্বলী গ্রাউন্ড ইত্যাদি সমসাময়িক গ্রীক ও রোমান সভ্যতার সাথে তুলনীয়। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রতীক রূপে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণে রৌপ্যমুদ্রা স্থানটিকে প্রাক-নাগরিক জনপদ ও পরবর্তীকালের নাগরিক সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এটি একটি কেন্দ্রীয় মুদ্রা-ব্যবস্থা ও শাসনতন্ত্রেরও ইঙ্গিত বহন করে। প্রায় প্রতিটি মুদ্রায় সূর্যপ্রতীক থাকায় মনে হয়, এই অঞ্চলে সূর্যবাদ বা সূর্যকেন্দ্রিক দর্শন প্রতিষ্ঠিত ছিল। চতুর্থত, উয়ারীতে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণে এবং খুবই উন্নতমানের লৌহ, মূল্যবান পাথর, মৃন্ময় (মাটি) এবং কাঁচের জিনিসপত্র এই অঞ্চলে এই চারটি শিল্পের উৎকর্ষের প্রমাণ বহন করে। পঞ্চমত, বিপুল পরিমাণে বিশ্বাস-প্রতীক (তাবিজ), কিছু বিশ্বাস-পাত্র (ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত), বিশ্বাস-স্থাপত্য (ধর্মীয় স্থাপনা) এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা ও দর্শনের বিকাশের ইঙ্গিত বহন করে।

এমন একটি সমৃদ্ধ নগর-সভ্যতা কারা নির্মাণ করলো? উয়ারী সভ্যতার নির্মাতা কারা? জটিল এই প্রশ্নের অনুসন্ধান কয়েক বছরে সমাধান হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান লেখক এ বিষয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আপাতত আমরা এ বিষয়ে সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করবো। তবে সবার আগে উয়ারী সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য আমাদের জানা প্রয়োজন।

উয়ারী প্রত্নস্থানটি প্রথম সুধী-সমাজের গোচরে আনেন স্থানীয় স্কুল শিক জনাব হানীফ পাঠান, ১৯৩৩ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় নরসিংদীতে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা প্রাপ্তি শিরোনামে একটি লেখার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র স্কুল শিক জনাব হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। এদেশের ইতিহাসবেত্তা, ঐতিহ্য-অনুরাগী মানুষদেরকে এখানে নিজ খরচে আসা-যাওয়া ও স্থানটি দেখার ব্যবস্থা করেন। ১৯৮৯ সালে এই প্রত্নস্থান নিয়ে তিনি একটি বই লেখেন।

১৯৩৩ সালে হানীফ পাঠানের আহ্বানের প্রায় ৭০ বছর পর ২০০০ সালে সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করা হয়। এরপর থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মোট ৬ দফা এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলে।

উয়ারী সভ্যতার মানুষদের একটি পরিচয় পাই তাদের ব্যবহার্য বিশ্বাস-প্রতীকের (তাবিজ) মাধ্যমে। এই প্রতীকগুলো হলো পাথর ও কাঁচের তৈরি এক ধরনের পুঁতি। সাধারণ গোল গোল পুঁতির মতো মনে করলে এই প্রতীক-সমূহ সম্পর্কে ভুল মূল্যায়ন করা হবে। বিভিন্ন তাবিজ বিভিন্ন প্রতীক নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। নানা জ্যামিতিক আকার এবং উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ নানা প্রতিকৃতি অবশ্যই অর্থবহ। প্রতীকগুলো কৃষি-অর্থনীতি নির্ভর এবং গ্রামীণ মূল থেকে বিকশিত নাগরিক সভ্যতার পরিচয় বহন করে। লাঙ্গল, লাঙ্গল বা তীরের ফলা, খড়গ, হাতকুঠার, নেকড়ে, ঘটদেবী, হৃদয়, দাঁত, চোখ ইত্যাদি অবশ্যই বিশেষ কোনো দর্শন-চিন্তার ফল। যেমন, কুঠার দ্বারা শত্রু ধ্বংস, কচ্ছপ দ্বারা দীর্ঘ জীবন, হাতি দ্বারা সার্বভৌমত্ব বোঝায়। উয়ারীতে প্রাপ্ত বিশ্বাস-প্রতীকসমূহ কৃষি-সম্ভূত প্রকৃতিপ্রেমী এক জাতিসত্তার পরিচয়বাহী। এখানে প্রাসঙ্গিকক্রমে বলে রাখা যায়, পাথর ও কাঁচ নির্মিত এই তাবিজগুলো খুবই উন্নত প্রযুক্তিতে নির্মিত হয়েছে। পাথর কাটা বা কাঁচ তৈরি একটি জটিল কাজ, তদুপরি এগুলোকে রঙিন করা ও নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া উন্নত কারিগরি জ্ঞানের পরিচয় দেয়। বিপুল পরিমাণে এই ধরনের নিদর্শন প্রাপ্তি একটি দক্ষ কারিগর শ্রেণীর অস্তিত্বের জানান দেয়।

একই কথা প্রযোজ্য উয়ারীতে প্রাপ্ত লৌহ (ও অন্যান্য ধাতব) এবং মৃৎশিল্প সম্পর্কেও। দক্ষ কারিগর শ্রেণী ছাড়া এই ধরনের চমৎকার ও নিপুণ উপকরণ তৈরি করা সম্ভব হতো না। বিশেষ করে উয়ারীতে প্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক লৌহনির্মিত হাতকুঠার একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই হাতকুঠারগুলোতে কোনো হাতল নেই, ফলে ঠিক কী করে এই হাতকুঠারগুলো ব্যবহার করা হতো অথবা আদৌ তা কুঠার হিসেবে ব্যবহৃত হতো কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

উয়ারীতে প্রাপ্ত প্রাণীজ ভাস্কর্য-সমূহের মধ্যে নেকড়ে ও ঘোড়া দুটি খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। দুটি ভাস্কর্যই উদ্ধত। এই অঞ্চলের মানুষ কি বেপরোয়া অথবা অসীম সাহসী ছিল অথবা বেপরোয়া বা হতে চাইতো?

উয়ারীতে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা এই সভ্যতার পরিচয় বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। প্রথমত, সবগুলো (প্রায়) মুদ্রায় একটি সাধারণ প্রতীক হলো সূর্য। সারা পৃথিবীতেই মানুষের আদিম উপাস্য সূর্য। পরবর্তীতে সূর্যের রূপান্তর ঘটেছে নানা আকার ও নিরাকার দেবতার মাধ্যমে। মুদ্রায় প্রাপ্ত অন্যান্য প্রতীকগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়ূর, পাখি, চিংড়ি, মাছ, নৌকা, গাছ, বৃশ্চিক, গরু, হাতি ইত্যাদি। নৌকার যে বৈচিত্র্য ও বৃহদাকার পাল, হাল ও মাঝির চিত্র তাতে মনে হয়, এই নৌকাগুলো বাণিজ্যতরী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ একটি সওদাগরী বণিক শ্রেণীও উয়ারীতে ছিল।

উয়ারীতে প্রাপ্ত নবড্ ওয়্যার ও স্টাম্পড্ ওয়্যার ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক। প্রাথমিক বৌদ্ধ ধর্ম কিংবা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের রীতি-আচারের সাথে এর সম্পর্ক ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীযুগে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলটি ছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। তার সূচনা হিসেবে তন্ত্রচর্চার ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। উয়ারীতে প্রাপ্ত কয়েকটি কুণ্ড বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের উপস্থিতির এই অনুমানকে আরো জোরালো করে। বিশেষ করে আমরা যখন একই ধরনের কুণ্ডের উপস্থিতি এবং তার কার্য-ব্যবহার দেখতে পাই উজ্জয়িনী ও চন্দ্রকেতুগড়ে, যেগুলো বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের কাছে পবিত্র ও গুহ্য (গুপ্ত) বলে গণ্য হতো।

প্রায় ৬০০ মিটার বাই ৬০০ মিটার বিস্তৃত এই নগরীতে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রায় ২০০মিটার দৈর্ঘ্য ও প্রায় ৬ মিটার প্রস্থ ও ২৩-৩১ সেমি পুরুত্ব বিশিষ্ট প্রাচীন রাস্তা উন্মোচিত হয়েছে। সম্প্রতি উন্মোচিত রাস্তার দক্ষিণ দিকে একটি ২.১ মিটার প্রশস্ত পার্শ্ব-রাস্তা পাওয়া গেছে। এই পার্শ্ব-রাস্তাটি সম্ভবত কোনো ভবনের দিকে এগিয়ে গেছে, যে ভবনটির অংশবিশেষ চলমান খননে উন্মোচিত হয়েছে। এই রাস্তা, সংলগ্ন স্থাপনা, কুণ্ড ইত্যাদি উয়ারী-সভ্যতার অধিবাসীদের উন্নত নগর-পরিকল্পনার পরিচয় বহন করে। এগুলো বিশ্বের প্রাচীন নগর-সভ্যতাসমূহের সঙ্গে উয়ারীর নগর-পরিকল্পনার সাদৃশ্যের প্রমাণ বহন করে। এতে বোঝা যায়, নগর পরিকল্পনাবিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও রাজমিস্ত্রী শ্রেণীর অস্তিত্বও উয়ারীতে ছিল।

উয়ারী প্রত্নস্থানের দুর্গপ্রাচীর, পরিখা, অসম রাজার গড় ও পরিখা এবং এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রচুর পরিমাণে লৌহ-নির্মিত হস্ত-কুঠার (?), বল্লম, পোড়ামাটির নিপেণাস্ত্র, উয়ারীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রমাণ দেয়, যা এই অঞ্চলে কোন পরাক্রমশালী জাতির বসবাসের সাক্ষ্য বহন করে। আবিষ্কৃত রাস্তাটির দুর্গপ্রাচীর অংশে এই সব যুদ্ধাস্ত্রের প্রাপ্তি দেখে মনে হয়, কখনও কখনও দুর্গে প্রবেশোন্মুখ বর্হিশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর কাজেও এর ব্যবহার হয়েছিল। অর্থাৎ যুদ্ধ করার জন্য একদল সৈন্য বাহিনীও হয়তো এখানে ছিল। হাবিবুল্লা পাঠান মনে করেন, গ্রিক বীর আলেকজান্ডার গঙ্গা নদীর পূর্ব তীরে যে পরাক্রমশালী গঙ্গরিডি জাতির বসবাসের কথা শুনেছেন তার অবস্থান ছিল আজকের উয়ারী।

কিন্তু এই কারিগরশ্রেণী, বণিক সম্প্রদায়, সৈনিকদল, শাসকবর্গ এবং বিশ্বাসী মানুষের জাতিগত পরিচয় কি? হাবিবুল্লা পাঠান মনে করেন, গঙ্গারিডি শব্দটিতেই এর সমাধান রয়েছে। তিনি গঙ্গারিডিকে লিখতে পছন্দ করেন গঙ্গাঋডি। এর মানে হলো গঙ্গা=গাঙ বা নদী, ঋ=ঋষি এবং ডি=ডোয়াই সম্প্রদায়। ঋষি ও ডোয়াই নামক দুটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বাংলাদেশে এখনও আছে। তবে এরাই উয়ারী সভ্যতার নির্মাতা কিনা তা গবেষণার দাবি রাখে।

কিংবা উয়ারী নামটিই বা কতো প্রাচীন? মান্দি (বর্তমানে বিলুপ্ত (?) একটি জাতি, সাধারণভাবে অনেকে গারোদেরকেই মান্দি বলে থাকেন) ভাষায় শব্দটির মানে স্থলবেষ্টিত জলাভূমি, উয়ারীর ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যা মিলে যায়। তবে কি মান্দিরাই উয়ারী সভ্যতার নির্মাতা? টলেমির বিবরণীতে কিন্তু এই অঞ্চলে মান্দাই জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বের কথাও রয়েছে। প্রাচীন বাংলায় শব্দটির মানে দুয়োর বা দেউরি বা রাজবাড়ি (পরনে পাটের শাড়ি, চলিল উয়ারি- দ্বিজ বংশীদাস)। উয়ারীর নগর সভ্যতার কেন্দ্রকে ভিন্নার্থে দেউরি বলাই যায়। তবে কি প্রাকৃতভাষী-রাই উয়ারীর নির্মাতা? নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি, তবে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার গর্বিত উত্তরাধিকারী রূপে আমরা আমাদের মননের, মনীষার, মঞ্জুষার মুক্তির মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য আরো আশাবাদী হয়ে উঠতেই পারি।

সোহেইল জাফর

?= নিশ্চিত নয় (বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি উৎখননে প্রাপ্ত নিদর্শন সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি বলে)
বি দ্র: এই লেখাটি ২২ মার্চ ২০০৭ দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আংশিক পরিবর্তন করে তা এই ব্লগে দেওয়া হলো।

Thursday, April 12, 2007

প্রত্নসম্পদ বেচাকেনা ও পাচার

প্রত্নসম্পদ বেচাকেনা ও পাচার
সোহেইল জাফর

প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন
বাংলাদেশের প্রচলিত
প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ক আইনটি কেবল পুরনোই নয়, বরং সমকালীন বাস্তবতা-বিবর্জিত। ১৯০৪ সালে প্রণীত একটি আইনের আলোকে ১৯৬৮ সালে প্রণীত এই আইনটি ১৯৭৬ সালে সংশোধন করা হলেও এখানে প্রত্নসম্পদ পাচার ও কেনা-বেচা সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের কারাদণ্ড অথবা ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটির বিধান একাধারে অ-যুগোপযোগী এবং সেই সাথে এটি অকার্যকরও বটে।

পরশপাথর না কষ্টি পাথর না কালো পাথর
সংবাদমাধ্যমে এটি প্রায়ই দেখা যায়, উদ্ধারকৃত মূর্তিটি ‘কষ্টি পাথরে তৈরি’। সম্প্রতি উদ্ধারকৃত কিছু মূর্তির মধ্যে ২টি নাকি ‘পরশ পাথরে’র তৈরি। মূর্তিটি প্রকৃতপক্ষে কোন্ পাথরে তৈরি তা যথাযথ গবেষণার আগে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে কষ্টি পাথর বা পরশ পাথর বলে কোনো পাথর পৃথিবীতে নেই। সাধারণ ভাবে ব্লাক ব্যাসাল্টকে অনেকে কষ্টি পাথর বলে থাকেন। কিন্তু উদ্ধারকৃত মূর্তিগুলো ব্লাক ব্যাসাল্টের তৈরি কিনা তা-ও তো আগে নিশ্চিত হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী উদ্ধারকারী দলে কি কখনও কোনো পাথর-বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে?

প্রত্নসম্পদের মূল্য : কোটি টাকা না তারও বেশি?
প্রায়ই আমরা দেখে থাকি ‘৫০ কোটি টাকা মূল্যের কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার’। এই মূল্য নির্ধারণ কে করলো? বাজারে ব্লাক ব্যাসাল্টের (কষ্টি পাথরের!) মূল্য কিরূপ? বাজারে প্রতি টন ব্লাক ব্যাসাল্টের দাম ৭০০০ টাকা। তাহলে ২০ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের মূর্তির মূল্য কি করে ৫০ কোটি টাকা হয়? প্রকৃতপক্ষে
প্রত্নসম্পদের মূল্য কোনোভাবেই টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এই মূল্য নির্ধারণ ও প্রচার পরোক্ষভাবে পাচারকারীদের উৎসাহিত করে।

উদ্ধার  অযত্ন  ধ্বংস?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মূর্তিগুলো উদ্ধার হওয়ার পর সেগুলো কোথায় যায়? সেগুলো কি আইন-রক্ষাকারী বাহিনীর গুদামেই পরে থাকে? সেগুলোকে কি
প্রত্নসম্পদ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়? আমাদের প্রস্তাব হলো, উদ্ধারকৃত প্রত্নসম্পদ যথাসম্ভব দ্রুত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে এবং যোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হোক। উপযুক্ত গবেষণার পর তা যেন জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়, তার ব্যবস্থা করা উচিৎ। কেবল উদ্ধার এবং অযত্নে গুদামে পরে থাকা প্রকৃত অর্থে প্রত্নসম্পদকে ধ্বংসই করে।

প্রত্নসম্পদের প্রকৃত মালিক ও সংরক্ষক
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী সাংস্কৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক এই দেশের জনগণ। জনগণকে
প্রত্নসম্পদের প্রকৃত পরিচয় অবহিত না করলে জনমনে ভুল ধারণা তৈরি হয়। আমরা মনে করি, পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আগে স্থানীয় জনগণ ওই স্থানের প্রত্নসম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন থাকে। পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু হওয়ার পর অনেকে ধারণা করতে থাকে, সরকারি আমলা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা এখান থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণাকাজে অবশ্যই স্থানীয় মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করা উচিত। কিছু মানুষ প্রতক্ষ্যভাবে কাজ করবেন, অন্যরা কাজ দেথবেন। তারা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কাজ এবং আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু দেখবেন। তখনই যদি বোঝানো হয়, কীভাবে ভাঙ্গা মৃৎপাত্র থেকেও আমাদের অমূল্য ইতিহাস ও সংস্কৃতি বোঝা সম্ভব, তাহলে সেখানে অ-পদ্ধতিগত খনন অনেক কমে যাবে, এমনকি গবেষক দলের অনুপস্থিতিতে কোথাও কোনো প্রত্নসম্পদ পাওয়া যাওয়ামাত্র তাদের কেউ কেউ আপনাকে ফোন করবে, খবর পাঠাবে। বাইরে থেকে গিয়ে কারো পক্ষে ঐ অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ, বেচা-কেনা এবং পাচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।

রেপ্লিকা ও আলোকচিত্র
আর একটি কাজও করতে হবে, তা হলো, প্রত্নসম্পদের যথাযথ আলোকচিত্র ও রেপ্লিকা তৈরি করে বহুল প্রচার। এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা এবং জাতীয় সম্পদের প্রতি আগ্রহকেই বৃদ্ধি করবে। এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও পুরাকীর্তির রেপ্লিকা তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আইন ১৯৮৩-তেও জাতীয় জাদুঘরের কার্যাবলিতে রেপ্লিকা তৈরি করা ও তার প্রচারের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নেই।

Tuesday, April 10, 2007

টুকরো জীবন : স্বপ্ননীল উপাখ্যান

শৈশবপর্ব
শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধি এবং তারুণ্যের প্রথম দিনগুলো নিয়ে ‘আমার ছেলেবেলা’ টাইপ গদ্য বাংলা সাহিত্যে প্রচুর। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এইসব গদ্য লেখে এবং পড়ে আসলে বড়োরা। মানুষের মধ্যে কি প্রবল এক শিশু চিরকাল ঘুমিয়ে থাকে? এইসব শৈশবময় গদ্য সেইসব শিশুদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়? কিন্তু ঘুম ভাঙিয়ে এর আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় কোথায়? রূপকথার কোনো রাজ্যে? না আবহমান বাঙলার সর্ষে-মটর ক্ষেতে? কিংবা কোনো মফস্বলে? যেখান থেকে ছেলেরা প্রায়ই পালিয়ে অন্য আরেক মফস্বল শহরে ঘুরে আসে। ছেলেবেলার সব গল্পগুলোই আমাদেরকে কেবল গ্রাম, মফস্বল কিংবা অচেনা-অচেনা প্রকৃতিতে নিয়ে কেন?

এইসব প্রশ্ন আমি করি, যখন আমার বেড়ে ওঠা শহর ঢাকাতে কোনো শিশুই বেড়ে ওঠে না কোনো গদ্যে, কোনো স্মৃতিকথায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিরিশ বছরে ঢাকা শহরে কি একটি শিশুও বড় হয়নি? ঢাকায় কি শৈশব যাপন করেনি কেউ তিরিশ বছল? ঢাকার শিশু পার্ক, শিশু নিকেতন, শিশু মেলা, শিশু হোম, শিশু হাসপাতাল-গুলোতে গত তিরিশ বছর কারা হেসে খেলে কেঁদেছে?

নচিকেতার গানের মতো ঢাকার শিশুদের শৈশব কারা চুরি করে নিয়ে যায়? গ্রন্থকীট? সমাজ? সংস্কৃতি? অর্থনীতি?

না, তারপরেও শৈশব থাকে। টিনড্রামের অস্কার তিরিশ বছর ধরে শিশু থাকলেও তিরিশ বছর কেটে যায় এবং অভিজ্ঞতা থেকে যায়। সেইসব অভিজ্ঞতা কি এতটাই অকহতব্য যে শৈশবের ঢাকা অলিখিতপ্রায়?

এই পর্যন্ত লিখে- মনে হচ্ছে- আসলেই কি শৈশব যাপন করে কেউ ঢাকায়? বড় হওয়া আর শৈশব যাপন তো এক কথা নয়। ঢাকা শহরে, ঢাকা নগরে, ঢাকা মহানগরীতে শৈশব যাপন কি আসলেই সম্ভব? কিংবা এভাবে প্রশ্ন করা যায়- ঢাকায় কি আসলে কোনো শিশু আছে? পুঁজিবাদের কালো থাবা প্রতিটি শিশুকেও এমনভাবে চেপে ধরে আছে যে সেও ছুটছে- বাঁচতে। প্রতিদিন সকালে ঢাকার পথে পথে অজস্র শিশুকে ছুটে চলতে দেখা যায়। প্রতিটি শিশুর কাঁধে পণ্যের দুঃসহ বোঝা।

আমরা যখন শিশু ছিলাম আমরাও পাঁচ কেজি দশ কেজি পণ্যের বোঝা কাঁধে দৌড়াতাম স্কুলে। অতটা সকালে কলতলায় ভিড় থাকতো না। কিন্তু তাড়া থাকতো। হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি চারটে ভাত খেয়ে আমি স্কুলব্যাগ কাঁধে চাপাতাম। পাশের বাসা থেকে দোস্ত সহিদুল্লা বেরুতো হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে। ওরা শুধু খাই খাই করে, খাওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা নাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া, তারপর খাওয়ার জন্য ভাতের বাটি নিয়ে স্কুলের বদলে ছোটে গ্যারেজে, আরও খাবার জোগাড় করার জন্য।

পথে আমার আর সহিদুল্লার বন্ধুদের দেখা পেতাম। ওরা কেউ পড়ে, কেউ কাগজ টোকায়, কেউ ইট ভাঙে, কেউ মুদি দোকানে সহকারী, কেউ আবার গ্যারেজে-গারমেন্টে কাজ করে। প্রায় সবার হাতেই বোঝা--- পাঁচ কেজি, দশ কেজি--- হাতুড়ি, টিফিন ক্যারিয়ার, বই, কাগজের বস্তা ইত্যাদি। সহিদুল্লার গ্যারেজ, আমার স্কুল একই পথে ছিল। এই পথে অনেক গাছের মধ্যে একটি ছিল শিউলি। ভোরবেলা পথে পথে ছড়ানো শিউলি কুড়োতে আমার আনন্দ লাগে। কাগজকুড়োনো, গ্যারেজে কাজকরা ছেলেমেয়েরাও কি মনে করে সহসা শিউলি কুড়াতে শুরু করে। কাগজের বদলে শিউলি কুড়োলে কিংবা ইট ভাঙার বদলে শিউলির দল ভেঙে ফেললে আমরা স্কুলগামী বাচ্চারা বিস্মিত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওদের কালো কালো হাতে সাদা সাদা শিউলি দারুণ ফুটতো। সুতরাং জাত্যাভিমানে আমরা শিউলি ঝরা রাস্তা ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে সুড়সুড় করে স্কুলে চলে যেতাম।

হুড়োহুড়ি, লুটোপুটি করতে করতে ঢুকতে চাইতাম স্কুলে, কাসে। হাতে বেত নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন পিটি স্যার। লাইন করে স্কুলে ঢুকতে হতো। কাসে গিয়ে নিজের আসনে বসতাম : এটেনডেন্স হয়ে গেলে এসেম্বলি হতো- লেফট রাইট লেফট। কান্তসমস্ত হয়ে কাসে ফিরে এলে কেতাদুরস্ত স্যার আসতেন, কী সব বলতেন। পারতপে ব্লাকবোর্ডের ধারেকাছে যেতেন না- চকের গুড়ো লেগে স্যুট-টাই-জুতো নোংরা হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। মাঝে মাঝে কোনো একদিন কাসে ঢুকেই জুতো নোংরা হয়ে যাওয়ার তোয়াক্কা না করেই সোজা ব্লাকবোর্ডে চলে যেতেন, সিদ্ধ হস্তে প্রাণীকোষের ‘চিত্র’এঁকে ফেলতেন। বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করে আমাদেরকে কী বলতেন তিনিই জানেন। আমরা কেউই বোর্ডের প্রাণীকোষটি খাতায় তুলতাম না, কারণ বইয়ে, গাইডবইয়ে এর চাইতে আকর্ষণীয়, রঙিন প্রাণীকোষের ছবি এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া থাকতো। সবচেয়ে বড়ো কথা, বহু আগেই প্রাইভেট টিউটর আমাদেরকে প্রাণীকোষ চিনিয়ে দিতেন। মতিঝিল স্কুলের ছেলেমেয়েরা কাসে প্রাণীকোষ বোঝার অপেক্ষায় বসে থাকে না।

একটি কাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন স্যার ঝড়ের বেগে কাসে ঢুকতেন। তিনি হয়তো খুব ব্লাকবোর্ডপ্রিয় লোক ছিলেন। কাসে এসেই সোজা বোর্ডে গিয়ে প্রাণীকোষের চিত্র ইত্যাদি ডাস্টার দিয়ে ঝেড়ে ফেলে হিজিবিজি রেখা টানতেন, এটা সেটা লিখতেন এবং ক্রমাগত বকতেন। সহজবোধ্য কারণেই আমরা তাতে কর্ণপাত করতাম না।

এইভাবে ঢাকার উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিশুরা স্ব স্ব পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে বিশেষ বিশেষ স্কুলে পড়ে। কোনো কোনো স্কুলের একেকটি শিশুর মাসিক বেতন অপর স্কুলের শিশুর পরিবারের সারামাসের আয়ের চেয়েও বেশি। এসব আয়ব্যয়ের হিসাব আমরা বুঝতাম না। সকাল-বিকেল স্কুল করে, হাউজ টিউটরের কাছে পড়ে আর অতীব জরুরি জৈবিক ক্রিয়াদি করে আমাদের দিন-রাত কেটে যেতো। তবু আমরা যারা পড়াশোনা করতাম, আমাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় আসলে স্কুল। সেখানে বাবা-মা’র শাসন ছিল না, বরং একদল ক্ষুদে শয়তান ছিলো আমারি মতোন। সুতরাং যদি আনন্দ ও মজার কোনো অনুভূতি তৈরি করা যেতো, তবে তা প্রধানত স্কুলেই। এবং দুঃখময়, বিষাদের স্মৃতিগুলোও মূলত স্কুলকেন্দ্রিক।

আমার বাবা বরাবরই খুব গরীব লোক। গরীবেরা মেধাবী না হলে, স্কলারশিপ না পেলে আমার পড়াশোনা বহু আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু তারপরেও প্রাইমারি স্কুলে আমার চেয়ে বড়োলোক সহপাঠী আমি কমই পেয়েছি। হাইস্কুলেই প্রথম গাড়ি করে আসা কোনো ছেলেকে আমার পাশে বসে কাস করতে দেখলাম। এই ছেলেরা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতো। ফুটবল আমি চিনতাম, ক্রিকেট বুঝতাম না। পিংপং নামের অদ্ভুত খেলাটি যে কি সেটি বুঝতে আমার পাঁচ বছর লেগে যায়। নিউজপেপার নামক পণ্যটি যে প্রতিদিন প্রকাশিত হয় এবং সেটি পড়তেও হয় ঐদিনই সেটা তো কেবল সেদিন জানলাম।

আমার সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে কমিকস-এর বই দেয়া-নেয়া করতো। এই ‘কমিকস’ শব্দটি স্কুলগৃহের শিশুতোষ আড্ডাগুলোর প্রধান আলোচিত বিষয়। পরে অবশ্য আমি ‘তিন গোয়েন্দা’র নাম জানতে পারি। আমি শিখি কিভাবে ‘কিশোর কাসিক’গুলো না কিনেও পড়া যায়।

আমাদের বন্ধু রতন কোনো এক লাইব্রেরী থেকে ‘সেবা’র বই নিয়ে আসতো। বহু চালাচালির পর ওটি আবার ফেরৎ যেতো রতন হয়ে ঐ দোকানে। এর মধ্যে দু’টাকা করে প্রতিজনকে দিতে হতো বই পড়ার জন্যে। এইসব বই আমাদেরকে আকৃষ্ট করতো কাসের বইয়ের চেয়েও। সুতরাং একদিন যখন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাদের স্কুলে এসে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা বলে গেলেন এবং সাহিত্যের বই কাসের বইয়ের চেয়ে মূল্যবান বলে গেলেন, সেদিন আমরা হা করে শুনলাম এবং কাসের বাইরের বই পড়ার অপরাধবোধ থেকে কিছুটা মুক্তি পেলাম। কিন্তু আমাদের শিকেরা আমাদেরকে কাসে মনোযোগী করতে চাইতেন। বাবামা’র কাছে রেগুলার স্লিপ পাঠাতেন, মাঝে মাঝে বাসায় গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। চেয়েও আমরা বড়ো হতে পারিনি, ছাত্র রয়ে গেছি।

আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে খ্যাপে যেতো। ওগুলো হলো জনসভার দর্শক হিসেবে কিংবা হরতালে পিকেটিং করতে। আমি একবার মুগদাপাড়া রেলওয়ে মাঠে খালেদা জিয়ার ‘ঐতিহাসিক বিশাল জনসভা’য় দর্শক হিসেবে গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে লজেন্স আর পাঁচ টাকা দিয়েছিল।

১৯৮৬ সালে এরশাদ যখন রেলওয়ে হাসপাতাল উদ্বোধন করতে কমলাপুর এলো সেদিন আমরা স্কুলে এলাম স্কুলড্রেস পরে, সচরাচার যেটি পরা হয় না। স্কুল থেকে আমরা রড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে হাসপাতালের দিকে চললাম। রাস্তায় অনেক আর্মি আর সেনাবাহিনীর গাড়ি ছিল। অবশ্য শেখ মুজিবের মরার পর থেকে সব সময়ই রাস্তায় সেনাবাহিনী থাকছে।

আমরা হাসপাতালে পৌঁছে লাইন ধরে দাঁড়ালাম। উর্দি পরা লোকেরা আমাদেরকে বললো, এরশাদের গাড়িবহর আসামাত্র আমরা যেন ‘স্বাগতম এরশাদ’ বলে চীৎকার করি। দূরে সহিদুল্লাকে দেখতে পেলাম। ওরা কয়েকজন আমাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। আমরা যখন ‘স্বাগতম এরশাদ’ বলে চীৎকার করছি, তখন ওরা এরশাদের গাড়িবহরের দিকে কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ে পালালো। কয়েকজন আর্মি ওদের পিছনে ছুটলো।

সন্ধ্যায় সহিদুল্লার কাছে শুনলাম, আর্মিরা গুলি করে দু’জন লোক আর দু’জন টোকাই মেরেছে। এই দুই টোকাইয়ের একটা আমাদের পাড়ায় থাকতো, সহিদুল্লার সঙ্গে গ্যারেজে কাজ করতো।

রোববারে কিংবা অন্য ছুটির দিনগুলোতে মা বলতেন বাড়িতে বসে বই পড়তে আর আমরা দলবেঁধে প্রকৃতি পড়তে বেরুতাম। কমলাপুরের এক প্রান্তে ছিল গাছগাছালি সমৃদ্ধ বিশাল এক বাগানবাড়ি। তার পাশে ঝিল। লোকে বলতো বুড়ির বাগিচা। ঝিলটার নাম মতি ঝিল। কোনো এক বুড়ি স্মরণাতীত কালে এখানে বিশাল বাগান করেছিলেন; এখানে ছিল ঢাকায় দুর্লভ কমলা। ব্রাহ্মণচিরণ এলাকাটি ক্রমে ক্রমে নাম বদলে হয়ে যায় কমলাপুর, মতিঝিল, মুগদাপাড়া, মায়াকানন, সবুজবাগ, গোপীবাগ, টিকাটুলি ইত্যাদি। আর বুড়ির কমলা বাগান আর মতি ঝিল আমাদের স্বপ্নে বার বার শিশু হয়ে আসে।

কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে কাঁচা রাস্তার পাশে টিনশেড বিল্ডিং দু’একটা, টিনের ঘর, বেড়ার ঘর আর বেশিরভাগই ফাঁকা জায়গা। জনবসতি কম থাকলেও চলার পথ ছিল সরু, কারণ রাস্তার ওপরেই কেউ হয়তো ঘর তুলে ফেলেছে। জমি কার, রাস্তা কার- ওসবের বালাই তখনও ছিল না, এখনও নেই। কমলাপুরের জমি রেলওয়ের, না সরদার পরিবারের, না জালাল মিস্ত্রীর এ নিয়ে মামলা চলছে বছরের পর বছর। আসলে এ জমি ছিল না কারো, দখলেও নেই বেশি দিন ধরে কোনো পরেই, সুতরাং মামলা- আন্ডার ড্রেনেজের কাজ বন্ধ, গ্যাসপানি লাইন বন্ধ- কেবলই বাড়ি আর বাড়ি- ডিআইটি অনুমতি দেয় কিংবা দেয় না, বাড়ি ঠিকই হয়ে যায় বছরের পর বছর। সুতরাং রাস্তাগুলো আরো সরু হয়ে যায়। বিশ বছর আগে এই সরু রাস্তার পাশে কমলাপুরের একমাত্র দোতলা বাড়ি তালুকদার বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের দল ডানে মোড় নিয়ে সম্পূর্ণ কাঠে তৈরি এক বিস্ময় বাড়ি অতিক্রম করতো, ওটা ছিল হাতের বাঁয়ে। ডানে ছিল সম্পূর্ণ টিনের একটা বাড়ি, তারপর বায়ে মোড় নিয়ে সরুতম গলি- যে গলি দিয়ে দুজন শিশুও পাশাপাশি হাটতে পারতো না, সেই গলি দিয়ে লম্বা একটা লাইন ধরে আমরা আবার ডানে, আবার ডানে যেতাম। সেখানে ঢাকা ব্যাটারি। ওখানে ‘বিলাই চিমটি’ পাওয়া যেতো। গাছের ফুল ও ফল চুরিতে ‘বিলাই চিমটি’ কোনো কাজে না লাগলেও ওগুলো আমাদের সঙ্গে থাকতোই। তারপর বাঁয়ে সোজা হেঁটে গেলে দারোগা বাড়ির গেট। এটাই বুড়ির বাগিচা। কোনো এক দারোগা বাগানবাড়িটি বুড়ির কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। বাড়ির গেটে কুকুর, সদা ঘেউ ঘেউ ব্যস্ত। ঘেউ ঘেউ করা কুকুর কদাচিৎ কামড়ায়- এই তত্ত্ব আমরা শিশুবেলায় ব্যবহার করতাম, কারণ পাঁচিলের ওপর আমাদের নাগাল পেতো না ঘেউ ঘেউ কুকুর। সুতরাং নিশ্চিন্তে আম, জাম, পেয়ারা নিয়ে দাড়োয়ান আসার আগেই আমরা কেটে পড়তাম পরদিনের হোমটাস্ক কমপ্লিট করতে।

হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে স্কুলে যেতাম, ওখানে বসে করতাম কাস ওয়ার্ক কমপ্লিট। স্যার বলতেন অনুশীলনী ১৩’র ২৪ ও ২৫ নং অঙ্ক দুটো কমপ্লিট করো। আমরা c/w লেখা খাতাটা তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে বের করে দ্রুত অঙ্ক কমপ্লিট করতে চেষ্টা করতাম।

মাঝে মাঝে স্কুল ছুটির পর ফুটবল খেলা হতো। আবাহনী আর মোহামেডানে ভাগ হয়ে আমরা ফুটবল খেলা শুরু করলে মাঠের মাঝখানে দিয়ে গজ, ফিতা, চেইন নিয়ে দু’জন লোক এমাথা ওমাথার হিসেব টুকে নিতো। ক’দিন পর লোকজন আরও বাড়তো, আমাদের গোলপোস্ট ছোট হতে হতে এত ছোট হতো যে গোলকীপার হিসেবে আমাকে আর হাতে বল ধরতে দেয়া হতো না। কিছুদিন বাদে মাঠটিকে আমরা একটা চারতলা বাড়ি মনে করে আরেকটি চারতলা বাড়ির জন্য জায়গা খুঁজতাম, আমাদের খেলা শুরু হলে দু’জন লোক গজ, ফিতা, চেইন নিয়ে আসতো বাড়ির বীজ বুনতে, খেলা শেষ হবার আগেই ওখানে বেড়ে উঠতো একটা চারতলা বাড়ি গাছের মতো দ্রুত, গাছের বদলে।

প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কয়েকটি কথা

প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা আমার জন্য অন্য অনেক বিষয়ের চেয়ে সহজ। তাই এবারের পোস্টটি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে।

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রত্নতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট আইন কানুন
বাংলাদেশে প্রচলিত প্রত্নতাত্ত্বিক আইনগুলোর মধ্যে ১৯৬৮ সালে প্রণীত ও ১৯৭৬ সালে সংশোধিত পুরাকীর্তি আইন (antiquities act 1968)-টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এই আইনটির কয়েকটি দিক আলোচনা করা হচ্ছে:

  • এই আইনে পুরাকীর্তি (antiquity)-র সংজ্ঞা [2(c)] দিতে দিয়ে বলা হয়েছে, যা কিছু প্রাচীন, সেটাই পুরাকীর্তি। আর প্রাচীন (ancient)-এর সংজ্ঞায় [2(b)] বলা আছে, যার বয়স একশ’ বছর বা তার চেয়ে বেশি তা-ই প্রাচীন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দুষ্প্র্রাপ্য কিন্তু একশ’ বছরের চেয়ে কম বয়সী নিদর্শনও পুরাকীর্তি হিসেবে সংগৃহীত, সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হওয়া উচিত। আইনানুগভাবে এইসব নিদর্শনকে পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত না করলে এবং এখনই সংরক্ষণ না করলে একশ’ বছর পর এসব অনন্য নিদর্শন খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
  • 2(g)-এ অস্থাবর পুরাকীর্তির সংজ্ঞায় কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করা হয়নি, এমনকি পূর্বে ব্যবহৃত প্রাচীন শব্দটিও এখানে ব্যবহৃত হয়নি। ফলে কোন ভবনটি পুরাকীর্তি হবে আর কোন ভবনটি হবে না, তা নির্ধারণ পুরোপুরি একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।
  • 2(h)-এ পুরাকীর্তির মালিক (owner) বলে একটি ধারা যুক্ত হয়েছে যেখানে মালিকের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, ৫ ও ৬ নং ধারায় পুরাকীর্তির মালিকানা ও মালিকবিহীন পুরাকীর্তির ক্ষেত্রে মালিক অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পুরো আইনের কোথাও মালিককে কেন দরকার অথবা মালিকানাধীন পুরাকীর্তির কী হবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। এই সমস্যাটি দেখা গেছে আইনের আরো কয়েকটি ক্ষেত্রেও। যেমন, ধারা ৯-এ বলা হয়েছে লাইসেন্স ছাড়া পুরাকীর্তি বেচা-কেনা বেআইনী, কিন্তু কেউ যদি বেচাকেনা না করে প্রত্নসম্পদ নিজের সংগ্রহে রাখে অথবা দান বা উপহারের মাধ্যমে পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে এবং নিজ জিম্মায় রাখে তাহলে সেক্ষেত্রে কী হবে? একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি জাদুঘর ও সংগ্রহশালাগুলো সম্পর্কেও। আমাদের দেশের বিভিন্ন জাদুঘর, ব্যক্তিগত সংগ্রহ, ধ্বংসাবশেষ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ধর্মীয় ভবনে অসংখ্য পুরাবস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশ, সীমান্ত প্রহরী এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মালখানায়ও আছে অসংখ্য পুরাবস্তু। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে আবিষ্কৃত এবং সংগৃহীত পুরাবস্তুর সংখ্যা বিপুল। এই বিপুল বিশাল সংগ্রহ সম্পর্কে কোনো দিক-নির্দেশনাই অ্যান্টিকুইটি অ্যাক্টে নেই। কোনো ব্যক্তির কাছে যদি কোনো পুরাকীর্তি থাকে এবং যদি তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক যদি জ্ঞাত হন, তখন তিনি ঐ নিদর্শনটিকে অ্যান্টিকুইটি অ্যাক্টের ১০ (১) ধারা অনুসারে সংরতি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে সরকারি গেজেট প্রকাশ করবেন। ঐ গেজেটের একটি কপি ঐ পুরাকীর্তির মালিককে দেয়া হবে। এই আইনের ১২ (১) ধারা অনুসারে, অতঃপর যদি ঐ মালিক মনে করেন, পুরাকীর্তিটির সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে যৌথ অভিভাবকত্বের জন্য চুক্তি করতে পারেন। পুরাকীর্তিটির সংরক্ষণের জন্য অধিদপ্তরের পরিচালক পুরাকীর্তির মালিককে সময় সময় নানা ধরনের (আর্থিকসহ) সহযোগিতা করবেন (ধারা ১৫(১))। ১৫ (১) নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য এর মালিক যদি সরকারের কাছে অনুদান চান তাহলে উক্ত দান যেন কোনোভাবেই এক হাজার টাকার বেশি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বহু বছরের পুরনো এই আইনের সীমাবদ্ধতা হলো এই আইনে ব্যক্তিগত সংগ্রাহক বা মালিকানাধীন পুরাকীর্তির জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ খুবই কম।
  • ১৫ নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তির জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে অর্থাৎ ১৮৯৪ সালের (1 of 1894) ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসরণ করা হয়, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথাযথ ও পরিপূর্ণ নয়। ফলে কোনো প্রত্নস্থানের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ জনগণ সেই প্রত্নস্থানের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কাজে একাত্ম হতে পারে না এবং প্রত্নস্থানের লুন্ঠন, ক্ষতি সাধন প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
  • ক্স অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ১৬ ও ১৭ নং ধারায় ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরাকীর্তির অধিগ্রহণ ও রণাবেণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতা খর্ব করা হয়েছে। আমাদের মনে হয়, ধর্মপালনে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে সংরক্ষণ করবেন এবং সংরণের স্বার্থে অধিগ্রহণ করবেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মীয় স্থানসমূহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি বিশেষ বোর্ড দ্বারা পরিচালিত ও সংরক্ষিত হতে পারে।
  • ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ১৯নং ধারায় বলা হয়েছে, যেসব পুরাকীর্তিকে ১২ নং ধারা অনুসারে সংরতি পুরাকীর্তিরূপে ঘোষণা করা হয়েছে সেসব পুরাকীর্তির ধ্বংস সাধন, ক্ষতিসাধন, পরিবর্তন সাধন, লেখা বা খোদাই করা যাবে না। এরূপ অপরাধের জন্য যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তা হলো ১ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা বা উভয় দন্ড। কিন্তু এ যাবৎকাল পর্যন্ত এই আইন কার্যকর হওয়ার কোন দৃষ্টান্ত আমাদের জানা নেই। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, যেসব পুরাকীর্তিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, সেসব পুরাকীর্তি ধ্বংস করা, ক্ষতিসাধন করা, পরিবর্তন সাধন ইত্যাদি বিষয়ে কোনো দিক-নির্দেশনা নেই।
  • ২১ নং ধারা অনুসারে, পরিচালকের অনুমোদিত লাইসেন্স না নিয়ে কোনো ব্যক্তি পুরাকীর্তি বেচা-কেনা করতে পারবে না। এই আইন থেকে বোঝা যায়, অনুমোদিত লাইসেন্স নিয়ে পুরাকীর্তি বেচা-কেনা করা যাবে। আমরা মনে করি, লাইসেন্স নিয়ে হোক বা না নিয়ে হোক, কোনো ভাবেই প্রত্নসম্পদ বেচা-কেনা করা যাবে না। প্রত্নসম্পদ দেশের সম্পদ, জাতির পরিচয়। সুতরাং তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • ২২ (১) নং ধারা অনুসারে পরিচালকের অনুমোদিত লাইসেন্স ব্যতিরেকে সকল ধরনের পুরাকীর্তি বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ। ২২ (২) নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তিসমূহ আবগারী আইনের ১৬ ধারায় রপ্তানি নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বস্তুসমূহের কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা না থাকায় কাস্টমস অফিসারদের পক্ষে একজন বর্হিগামী যাত্রী বা লাগেজ থেকে পুরাকীর্তি নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পরে। কোনো বর্হিগামী যাত্রী কোনো ঐতিহ্যবাহী বস্তু এদেশ থেকে কিনে বিদেশে নিয়ে যেতে চাইলে পণ্যটি যে পুরাকীর্তি নয়, এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছ থেকে একটি ছাড়পত্র নেন। প্রচলিত পদ্ধতিটি হলো, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক একটি কাগজে বা একটি ছবির পেছনে লিখে দেন ‘এটা পুরাকীর্তি নয়’। এক্ষেত্রে ফাঁকটি হলো, কোনো ব্যক্তি যদি একটি পুরাকীর্তির রেপ্লিকা নিয়ে আসেন এবং ঐ রেপ্লিকার ছবির পেছনে যদি অধিদপ্তরের পরিচালক ‘পুরাকীর্তি নয়’ লিখে দেন এবং ঐ ব্যক্তি যদি এরপর রেপ্লিকা রেখে মূল বস্তুটি নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির হন, তখন কাস্টমস অফিসার কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের ছাড়পত্রকে সম্মান দেখিয়ে বস্তুটিকে ছাড় করে দেন। এভাবেই পুরাকীর্তি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কাস্টমস অফিসারদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অথবা বন্দরগুলোতে পুরাকীর্তি বিষয়ে বিশেষ শাখা/কর্মকর্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
  • ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ২৪ নং ধারায় খনিজ আহরণ ও পাথর (পাহাড়) কাটা বিষয়ক যে বিধির উল্লেখ করা হয়েছে তাতে শুধু সংরতি পুরাকীর্তি বা জ্ঞাত প্রত্নস্থানের ক্ষেত্রে খনিজ আহরণ, পাথর কাটা, উৎখনন, বিস্ফোরক ব্যবহার করে উৎখনন, ভারী যানবাহন চলাচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপের কথা বলা হলেও উপরোক্ত কাজের জন্য লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের কোন প্রয়োগ আছে বলে জানা নেই। বিশেষ করে, সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের অজ্ঞাতসারে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায় এশিয়া এনার্জি যে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তা সুস্পষ্টভাবে এই আইনের লঙ্ঘন। এশিয়া এনার্জি ছাড়াও অন্যান্য সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে তেল-গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধানের জন্য ব্যাপকভাবে যে খনন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রত্নস্থানের পাশ দিয়ে যে ভারী যানবাহন চলছে, তা এই আইনটির অকার্যকারিতা প্রমাণিত করে। এতদসংক্রান্ত আইনের ধারায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল ও হাস্যকর। এখানে বলা হয়েছে যে, এই আইন লঙ্ঘনকারীকে ১ বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু কথা থেকে যায়। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্নস্থানের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে যে অপূরণীয় তি হয় তা কি এই সামান্য শাস্তি দিয়ে পূরণ করা সম্ভব!
  • ২৬ নং অনুচ্ছেদে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি বা তার অংশবিশেষের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু হরহামেশাই জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ সাধারণ দর্শক ও গবেষকদের আলোকচিত্র গ্রহণে বাধা দিয়ে থাকেন। আমরা মনে করি, প্রত্নসম্পদের যথাযথ আলোকচিত্র ও রেপ্লিকা তৈরি করে বহুল প্রচার করলে প্রকারান্তরে তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা এবং জাতীয় সম্পদের প্রতি আগ্রহকেই বৃদ্ধি করবে। এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও পুরাকীর্তির রেপ্লিকা তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আইন ১৯৮৩-তেও জাতীয় জাদুঘরের কার্যাবলিতে রেপ্লিকা তৈরি করা ও তার প্রচারের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই আইনের আলোকচিত্রও গ্রহণ সংক্রান্ত ধারাটি এমনকি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্যও নানা জটিলতার সৃষ্টি করে।