Thursday, July 16, 2009

প্রত্নসম্পদ বেচাকেনা ও পাচার



প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন
বাংলাদেশের প্রচলিত প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ক আইনটি কেবল পুরনোই নয়, বরং সমকালীন বাস্তবতা-বিবর্জিত। ১৯০৪ সালে প্রণীত একটি আইনের আলোকে ১৯৬৮ সালে প্রণীত এই আইনটি ১৯৭৬ সালে সংশোধন করা হলেও এখানে প্রত্নসম্পদ পাচার ও কেনা-বেচা সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের কারাদণ্ড অথবা ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটির বিধান একাধারে অ-যুগোপযোগী এবং সেই সাথে এটি অকার্যকরও বটে।

পরশপাথর না কষ্টি পাথর না কালো পাথর
সংবাদমাধ্যমে এটি প্রায়ই দেখা যায়, উদ্ধারকৃত মূর্তিটি ‘কষ্টি পাথরে তৈরি’। সম্প্রতি উদ্ধারকৃত কিছু মূর্তির মধ্যে ২টি নাকি ‘পরশ পাথরে’র তৈরি। মূর্তিটি প্রকৃতপক্ষে কোন্ পাথরে তৈরি তা যথাযথ গবেষণার আগে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে কষ্টি পাথর বা পরশ পাথর বলে কোনো পাথর পৃথিবীতে নেই। সাধারণ ভাবে ব্লাক ব্যাসাল্টকে অনেকে কষ্টি পাথর বলে থাকেন। কিন্তু উদ্ধারকৃত মূর্তিগুলো ব্লাক ব্যাসাল্টের তৈরি কিনা তা-ও তো আগে নিশ্চিত হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী উদ্ধারকারী দলে কি কখনও কোনো পাথর-বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে?

প্রত্নসম্পদের মূল্য : কোটি টাকা না তারও বেশি?
প্রায়ই আমরা দেখে থাকি ‘৫০ কোটি টাকা মূল্যের কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার’। এই মূল্য নির্ধারণ কে করলো? বাজারে ব্লাক ব্যাসাল্টের (কষ্টি পাথরের!) মূল্য কিরূপ? বাজারে প্রতি টন ব্লাক ব্যাসাল্টের দাম ৭০০০ টাকা। তাহলে ২০ কেজি ওজনের কষ্টি পাথরের মূর্তির মূল্য কি করে ৫০ কোটি টাকা হয়? প্রকৃতপক্ষে প্রত্নসম্পদের মূল্য কোনোভাবেই টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এই মূল্য নির্ধারণ ও প্রচার পরোক্ষভাবে পাচারকারীদের উৎসাহিত করে।

উদ্ধার > অযত্ন > ধ্বংস?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মূর্তিগুলো উদ্ধার হওয়ার পর সেগুলো কোথায় যায়? সেগুলো কি আইন-রক্ষাকারী বাহিনীর গুদামেই পরে থাকে? সেগুলোকে কি প্রত্নসম্পদ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়? আমাদের প্রস্তাব হলো, উদ্ধারকৃত প্রত্নসম্পদ যথাসম্ভব দ্রুত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে এবং যোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হোক। উপযুক্ত গবেষণার পর তা যেন জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়, তার ব্যবস্থা করা উচিৎ। কেবল উদ্ধার এবং অযত্নে গুদামে পরে থাকা প্রকৃত অর্থে প্রত্নসম্পদকে ধ্বংসই করে।

প্রত্নসম্পদের প্রকৃত মালিক ও সংরক্ষক
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী সাংস্কৃতিক সম্পদের প্রকৃত মালিক এই দেশের জনগণ। জনগণকে প্রত্নসম্পদের প্রকৃত পরিচয় অবহিত না করলে জনমনে ভুল ধারণা তৈরি হয়। আমরা মনে করি, পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আগে স্থানীয় জনগণ ওই স্থানের প্রত্নসম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন থাকে। পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু হওয়ার পর অনেকে ধারণা করতে থাকে, সরকারি আমলা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা এখান থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণাকাজে অবশ্যই স্থানীয় মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করা উচিত। কিছু মানুষ প্রতক্ষ্যভাবে কাজ করবেন, অন্যরা কাজ দেথবেন। তারা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কাজ এবং আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু দেখবেন। তখনই যদি বোঝানো হয়, কীভাবে ভাঙ্গা মৃৎপাত্র থেকেও আমাদের অমূল্য ইতিহাস ও সংস্কৃতি বোঝা সম্ভব, তাহলে সেখানে অ-পদ্ধতিগত খনন অনেক কমে যাবে, এমনকি গবেষক দলের অনুপস্থিতিতে কোথাও কোনো প্রত্নসম্পদ পাওয়া যাওয়ামাত্র তাদের কেউ কেউ আপনাকে ফোন করবে, খবর পাঠাবে। বাইরে থেকে গিয়ে কারো পক্ষে ঐ অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ, বেচা-কেনা এবং পাচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।

রেপ্লিকা ও আলোকচিত্র
আর একটি কাজও করতে হবে, তা হলো, প্রত্নসম্পদের যথাযথ আলোকচিত্র ও রেপ্লিকা তৈরি করে বহুল প্রচার। এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা এবং জাতীয় সম্পদের প্রতি আগ্রহকেই বৃদ্ধি করবে। এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও পুরাকীর্তির রেপ্লিকা তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আইন ১৯৮৩-তেও জাতীয় জাদুঘরের কার্যাবলিতে রেপ্লিকা তৈরি করা ও তার প্রচারের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নেই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করুন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন


সংরক্ষণ ও পুনরায়নের নামে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সোনারগাঁয়ের পানাম সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো একে একে ধ্বংস করে ফেলছে। ভেঙ্গে ফেলেছে পানাম নগরীর ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার, ভেঙ্গেচুড়ে নষ্ট করেছে এই ঐতিহাসিক নগরীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন। ভবনের নকশা তুলে ফেলে দিয়ে ভবনগুলোকে সম্পূর্ণ শ্রীহীন করে ফেলেছে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন দি ডেইলী স্টারের বৃহস্পতিবারের সংখ্যাটি। ওয়েব লিঙ্ক : [wjsK= Click This Link
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের বিষয়ে এটা কোনো বিদেশী ষড়যন্ত্র কিনা, সেটা ভেবে দেখা দরকার। কারণ পুরো প্রকল্পটি একজন ব্যক্তি পরিচালনা করছেন, তিনি হলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক শফিকুল আলম। ফ্রান্সের সাথে অসম চুক্তির প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ প্রসঙ্গে যার বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। আমরা অবিলম্বে শফিকুল আলমকে গ্রেফতার করে সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী ধ্বংসের ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

জামাল ভাস্করের নাফ নদী দর্শন, আমেরিকার কনডম ব্যবসা এবং কনডমের ভেতরকার শক্ত বস্তুটির মাজেজা

আসল কথা হইলো- ট্যাক কার কাছে? ট্যাক আমার কাছে থাকলে আমিই বস, আপনার কাছে থাকলে আপনে। এবং এই সত্যটা প্রমোট করাই আমেরিকার (এবং ইহুদিবাদীদের) প্রধান লক্ষ্য বলে আমার কাছে মনে হয়। কিন্তু এর সাথে সাথে বলা দরকার, ট্যাক-এর জোরই সবসময় সবাইরে টিকাইয়া না-ও রাখতে পারে। বহু ট্যাকলু ইতিহাসে কানতাছে। কনডম কিছু না, কনডমের পিছনে যেইটা থাকে- ওইটার জোর যে কনডম কোম্পানীর মালিকের চেয়ে কনডম-পরা কারখানার শ্রমিকের বেশি থাকতে পারে, এইটাও প্রমোট করা দরকার।

এতো কথার হেতু রয়েছে জামাল ভাস্করের নাফ নদী দেখতে যাওয়ার শানেনজুলের মধ্যে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী প্রমাণ করার জন্য জামাল ভাস্করকে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। বহুত হাইপোথিসিসও নাকি খাড়া করতে হয়েছে। (অথচ রিফুজি সবসময়েই ভালনারেবল, এর জন্য হাইপোথিসিসের কোনো দরকার নেই; আমেরিকায় যেসব রিফুজি ক্যাম্প আছে (যেমন কিউবান) ওখানকার জনগোষ্ঠীকে তো ওরা ভালনারেবল-ই বলে। আর জামাল ভাস্কর বললেই যতো সমস্যা!)

এবং এইসবের লক্ষ্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এইডসের হাত থেকে বাঁচানো! এইডস বলে আদৌ কোনো জীবনঘাতী রোগ আছে কিনা, এই নিয়েই বিতর্ক* আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিতর্ক এই অসুখকে নিয়ে ব্যবসা করা নিয়ে। জামাত কায়দায় মানুষের দুর্বল জায়গা নিয়ে ব্যবসা করতে আমেরিকা (এবং ইহুদিবাদ) তো সবসময়ই সক্রিয়। এখানেই ইউএনএফপিএ কিংবা মার্কিন কংগ্রেসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা একেকজন কনডম কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার- আর আমাদের নাকি এইডস! সুতরাং লাগাও বাজি।

হাজার হাজার আফ্রিকান যখন শেল-ইউনিক্যাল আর নানা ইঙ্গ-মার্কিন কোম্পানির আগ্রাসনে না খেয়ে মরছিলো, তখন আমেরিকা আর ব্রিটেন আবিষ্কার করলো- "না! না খেয়ে মরছে না তারা, মরছে এইডসে!" এইডস যদি এতোই ঘাতক হতো, তবে আমেরিকানরা মারা যেতো সবচেয়ে বেশি। যতই অসচেতন বলা হোক না কেন, আফ্রিকার মুসলিম এবং এথনিক জনগোষ্ঠীর যৌনতাবোধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে কোনো তথাকথিত সভ্যদেশের চেয়ে বেশি নিরাপদ। বরং মাত্র ৫%** কনডম ইউজারের দেশ আমেরিকায় কেন এইডস-এ মৃত মানুষের সংখ্যা এতো কম, সেই প্রশ্ন নিদ্বির্ধায় তোলা যায়।

আসল কথা আগেই বলে ফেলেছি! শেষে আবার বলি, কনডম যতো ইলেকট্রিক শক-দেওয়াই হোক, টানলে যতোই লম্বা হোক, যতো হার্ড বা হার্ডকোর হোক- আসল কাম কিন্তু করে কনডমের পিছনেরটা। যতোই তারে আটকাইয়া রাখা হোক, যতোই ঢেকেঢুকে রাখা হোক, যতই বলা হোক- আমেরিকা-ইউএন-কনডম কোম্পানীর ট্যাকের জোর বেশি, কার্যক্ষেত্রে সবসময় তা না-ও হতে পারে। অন্তত ইতিহাস থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পাই।


*এইডস সম্পর্কে যত কথা বলা হয়, যতো লোক মারা যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়, সেই তথ্যের সত্যতা নিয়ে ব্যাপক বিরোধ আছে। এই বিষয়ে আগামীতে একটা পোস্ট দিবো।

**এই হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে কনডম-প্রচারণার আগের বর্তমানে এই হার ১৮%।

খরায় পানি কম? বর্ষায় পুষিয়ে দিমুনে...


এস পি কাকরান বললেন, বর্ষায় পদ্মায় পানিপ্রবাহের ব্যাপারটি তারা বিবেচনা করবেন। এস পি কাকরান হলেন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ভারতীয় পক্ষের সদস্য। আজ সকালে এই কমিশন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পদ্মায় পানি প্রবাহের অবস্থা দেখতে যান। কমিশন দেখতে পায়, ওখানে ২০ হাজার কিউসেক পানি কম আছে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি পানি কমের বিষয়টি তুলে ধরলে, এস পি কাকরান বললেন, বর্ষায় পানি বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি তারা বিবেচনা করবেন। সেই সময় পানি সংরক্ষণাগার করে পানি সংগ্রহ করে রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।


এস পি কাকরানের ইন্টারভিউটি টিভিতে প্রতিটি খবরেই দেখাচ্ছে, পারলে দেখে নিন।
২৮ শে মে, ২০০৭

আমার প্রিয় ছবি


বিনত বিবির মসজিদ এবং আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ

'এসো সম্মিলনের জন্য'- এই শব্দ ঝঙ্কারের তানে
আহা, দ্যাখো! ভিখারীর এই মসজিদ কী মনোহর ভূষণে!
------------------------------মারহামাত-এর কন্যা বখত।


মারহামাত-এর কন্যা বখত কিংবা বখত বিনত মারহামাত, যা-ই বলুন না কেন, বখত বিবির সম্বন্ধে যতো মুখরোচক গল্পই থাকুক না কেন বাজারে- সর্বজনস্বীকৃত তারিখ অনুযায়ী ঢাকার সর্বপ্রাচীন প্রার্থনাঘরটি কিন্তু ভেঙ্গে গেছে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায় ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কখন? ২০০৬ সালে। যখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ঢাকার ৪০০ বছর উদযাপনের। ইতোমধ্যে ঢাকার চারশত বছর উদযাপনের জন্য বেসরকারিভাবে একটি জাতীয় কমিটিও গঠিত হয়েছে। নগর যদিও বাংলাদেশে কোনো নতুন অভিজ্ঞান নয়, কিন্তু ইয়োরোপীয় বাত্তি জ্বলার (এনলাইটমেন্ট) পর দেশে দেশে যে নগর-পত্তন শুরু হয়, সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সুবেদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক বুড়িগঙ্গার তীরে যে প্রাদেশিক (সুবা) রাজধানী স্থাপন, তার মধ্য দিয়ে নগর হিসেবে ঢাকার পুনর্জন্ম লাভের চারশ’ বছর উদযাপনের জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ তখন, তখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বখত নির্মিত ঢাকার মুসলমানদের প্রথম প্রার্থনাঘরটি।

ঠিক ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে শব্দটা এখানে পুরোপুরি প্রযোজ্য হবে না। কারণ এটা চাঙমা রাজার বাড়িও না কিংবা রমনার কালী মন্দিরও না। এটা একটা মসজিদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে মসজিদ ভেঙে ফেলা হবে, এমন দুঃসাহস কারো হবার কথা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হচ্ছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে বখত বিনত মারহামাতের মসজিদ। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, অনেক আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। সত্যি, বখত বিনত মারহামাত-এর নির্মিত সাড়ে চারশো বছরের পুরনো মসজিদটি এর আগে কয়েকবার সংস্কারের জন্য ভাঙচুর করা হয়েছে। বর্তমান মসজিদটি ঠিক বখত বিনত মারহামাত-এর নির্মিত মসজিদ নয়, কিংবা এটা প্রাক-মুঘল যুগের স্থাপত্য-শৈলীও পুরোপুরি ধারণ করে না।

বিশেষ করে, পণ্য অর্থনীতির ব্যাপক প্রসারের কারণে অকস্মাৎ ঐতিহ্য-বোধ জেগে ওঠার যে প্রবণতা; ঢাকার চারশো বছর উদযাপনের প্রাক্কালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ও অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণের দাবি তাই বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী শাখারিবাজার সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী আরমানিটোলা সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী লালকুঠি সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী ফরাশগঞ্জ সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী গুলিস্থান সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী রমনা পার্ক সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী ইত্যাদি ইত্যাদি বহু কিছু সংরক্ষণের কথাবার্তা গত কয়েক বছরে বেশ শুনছি আমরা। এবং এও শুনছি, এসব সংরক্ষণের জন্য অ্যাডভোকেসি, পিপল অ্যাওয়ারনেস ইত্যাদি প্রোগ্রামে নাকি বহু ডলার-পাউন্ডও আসছে।

ভেঙে কী ফেলা হয়নি অথবা ভেঙে কি যায়নি প্রাচীন সব স্থাপত্য নিদর্শনগুলো? আমাদের কি ধারণা? আমরা যে লালবাগ কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ কিংবা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কিংবা ময়নামতির আনন্দবিহারের সামনে দাঁড়াই তা কি ৭ম, ৮ম কিংবা ১৬শ শতকে নির্মিত? মোটেই নয়! এই স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কালের বিবর্তনে যাওয়ারই কথা। কিন্তু নিয়ম হলো, যখন নতুন করে নির্মাণ করা হবে, তা অবশ্যই পুরনো স্থাপনা-শৈলী এবং নির্মাণ উপকরণ দিয়ে করতে হবে। বলা বাহুল্য, এই নিয়ম প্রযোজ্য কেবল যৌথ সম্পদের ক্ষেত্রেই। আপনার দাদার তৈরি করা বাড়ি ভেঙে আপনি যেভাবে খুশি নতুন করে বানাতে পারেন, কিন্তু বখত বিনত মারহামাত-এর ওয়াক্ফ করা স্থাপনা আপনি খেয়াল-খুশি মতো ভাঙচুর করতে পারেন না। সাংস্কৃতিক এবং প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সনদের তা স্পষ্ট লঙ্ঘন। বলা দরকার, বাংলাদেশ ঐ সনদগুলো স্বাক্ষর করেছে। এবং গরীব দেশ বলে বাংলাদেশের পক্ষে এই সনদ মেনে চলা যেন কষ্টকর না হয়, এজন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, যার বেশির ভাগ অংশটাই চিরস্থায়ী দান।

বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের একটা তালিকা আছে, তাতে চারশো’রও বেশি ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকাভুক্ত কোনো স্থাপনায় যদি আপনি কখনো বেড়াতে যান, দেখতে পাবেন অথবা বলা যায় খুঁজলে দেখতে পাবেন, একটা নীল সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, এই স্থাপনাটি প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের ১৮৫৪ সালের (১৯৬৯ সালে সংশোধিত) আইন অনুসারে সংরক্ষিত, এর কোনোরূপ ক্ষতি সাধন, আঁচড় কাটা, লেখা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই আদেশ অমান্যকারীকে এতো টাকা জরিমানা কিংবা এতো বছরের কারাদন্ড কিংবা উভয় শাস্তি বিধান করা যাইতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ নীল সাইনবোর্ডটি ২৫ বা তার চেয়ে বেশি সময়ের পুরনো। বাংলাদেশে যেদিন সাইনবোর্ড সংরক্ষণের আইন হবে, সেদিন ঐ সাইনবোর্ডগুলোর সামনে লাগানো থাকবে আরেকটি সাইনবোর্ড, 'এই সাইনবোর্ডগুলো অমুক সালের সাইনবোর্ড সংরক্ষণের আইন কর্তৃক সংরক্ষিত... ...'। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কমবেশি চারশো স্থাপনার অধিকাংশই নাজুক অবস্থায় আছে। যেগুলো সংস্কার করা হয়েছে, সেসব সংস্কার কমিটিতে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞ কাউকে রাখা হয়নি। বলতে গেলে, সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি, এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। (চলবে)

রোবাব রোসান এবং ওয়ান টপ আর্কিওলিজস্ট : বালস্য বাল

তার মতো কত শত বালস্য বাল, হরিদাস পাল
পৃথিবীর প্রগাঢ় প্রস্রাবের ফেনায় ভেসে গেছে!

আমরা যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অংশ নিয়েছি নিউ এজের সাংবাদিক রোবাব রোসান আমাদেরকে বলেছেন অযোগ্য, অনভিজ্ঞ, নবিস, শিক্ষার্থী। তার কথার সমর্থনে তিনি আবার এক বালস্য বাল টপ আর্কিওলজিস্টের বালের তলে আশ্রয় নিয়েছেন। কে এই বালস্য বাল? রোবাব রোসান তার নাম বলার সাহস পাননি। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে যাদেরকে বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে তারা হলেন ড. এনামুল হক, ড. মোজাম্মেল হক, ড. কামরুল আহসান এবং একজন বালস্য বাল "টপ আর্কিওলজিস্ট"। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন নিয়ে এই বিশেষজ্ঞদের কথা বলার অধিকার আছে কিনা এই বিষয়টি বহু বছর ধরেই প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ এদের কারোরই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ভাবা হয় এমন কয়েকজনের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের অভিজ্ঞতা নিচের ছকে দেখাচ্ছি। শেষে আমার অভিজ্ঞতাটাও যুক্ত করছি (যদিও আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই)।

বিশেষজ্ঞের নাম---------------------খননের অভিজ্ঞতা
ড. এনামুল হক------------------------------০
ড. মোজাম্মেল হক --------------------------১
ড. একেএম শাহনাওয়াজ---------------------০
ড. আব্দুল মমিন চৌধুরী-----------------------০
ড. কামরুল আহসান--------------------------১
ড. এম আর খান (ফিজু)----------------------০
ড. মোস্তাফিজুর রহমান (লাল)-----------------১২
ড. অসিত বরণ পাল--------------------------০
ড. আইয়ুব খান------------------------------০
স্বাধীন সেন----------------------------------২
বুলবুল আহমেদ-------------------------------০
মাসুদ ইমরান মান্নু-----------------------------২
জয়ন্ত সিংহ রায়-------------------------------০
মালিহা নার্গিস---------------------------------০
রূপালি আক্তার--------------------------------০
সীমা পাওয়ানকার------------------------------০
এবং
সোহেইল জাফর (বিশেষজ্ঞ নই)-----------------৫
(এই তালিকায় সামান্য ভুলত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা হবে)

আমার প্রত্নতাত্ত্বিক খননের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো ব্যক্তি বাংলাদেশে একজনই আছেন, তিনি ড. মোস্তাফিজুর রহমান লাল। কোনো বালস্য বাল টপ আর্কিওলজিস্ট বা সাংবাদিকের নাই। ওই বালস্য বাল টপ আর্কিওলজিস্ট তো সিভিলাউজেশনের সংজ্ঞাই জানে না! তার মন্তব্য শুনুন, "কয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক পাথর পেলেই তাকে সভ্যতা বলা যায় না"। আরে চুদির ভাই, প্রাগৈতিহাসিক পাথর পেলে তাকে সভ্যতা বলে তোর কোন্ বাপ? প্রাগৈতিহাসিক পাথর তো প্রস্তর যুগের হাতিয়ার রে! ওইটা তো সভ্যতার সময় না। সভ্যতা তো আসলো আরো কয়েক হাজার বছর পর। এই সাধারণ তথ্যটাই জানিস না, আবার টপ আর্কিওলজিস্ট হয়ে গেলি।

আর যে সাংবাদিক তাকে টপ আর্কিওলজিস্ট বানালো তার জ্ঞানের বহর দেখুন। প্রতিবেদনের ভূমিকায় উনি লিখছেন- উয়ারী-বটেশ্বরের সময় ৪৫০ বিসি, এটা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সমসাময়িক। আরে ব্যাটা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সময়কাল ২৭০০ বিসি, এটা ধ্বংসই হয়ে যায় ১৭০০ বিসি-তে, তো কীভাবে উয়ারী-বটেশ্বর হরপ্পার সমসাময়িক হলো?

তোর মতো কত শত বালস্য বাল, হরিদাস পাল
পৃথিবীর প্রগাঢ় প্রস্রাবের ফেনায় ভেসে গেছে!

বি.দ্র. ২৭ এপ্রিল ২০০৭ দৈনিক নিউ এজে রোবাব রোসানের একটি প্রতিবেদন বিষয়ে এটা প্রথম প্রতিক্রিয়া।

কৃতজ্ঞতা- কবি জোর্তিময় নন্দীর কবিতাটা আবারো ব্যবহার করলাম, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

রোবাব রোসান এবং ওয়ান টপ আর্কিওলিজস্ট : তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উত্থান (?)

প্রায় ১৫ লাখ বছরের প্রাচীন এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভূমিরূপের দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ বাংলাদেশের ইতিহাসকে প্রাচীন বলতে নারাজ। এরা বাংলাদেশকে বলেন নতুন ভূমির দেশ, যেন পরশু বিকেলে সমুদ্রের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের জন্ম হলো। এইসব বিষয় নিয়েই এই পোস্টটি।

১.
একটি বানর একটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে ২ ফুট ওপরে ওঠে এবং পরবর্তী মিনিটে ৩ ফুট নিচে নামে। ১০ মিনিট পর বানরটি কোথায় থাকবে? হাস্যকর ঠেকতে পারে, এই ভয় না করেই দশকের পর দশক জুড়ে ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি অংশ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে তৈলাক্ত বাঁশের বানরে পরিণত করেছেন।

২.
কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাস্থানগড়ে খননে লিপ্ত বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ দল জোর দাবি জানালো, মধ্যযুগ নয়, মহাস্থানগড়ের বিকাশ মৌর্যযুগে ঘটেছিল। অদ্ভুত...! মহাস্থানগড়কে মধ্যযুগের সাইট বলে কে দাবি করেছে? মহাস্থানগড় অঞ্চলে যে মৌর্য যুগের অনেক আগেই মানুষের বসতি ছিলো, এমন দাবিই তো বরাবর করে আসছিলেন আমাদের দেশের ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা। যৌথ দলের দাবিটা তো রীতিমতো আপনাকে কয়েকধাপ নামিয়ে একধাপ ওপরে তোলার মতো ব্যাপার। আপনি অলরেডি একজন গ্রাজুয়েট, আর কেউ যদি বলে, আপনি একেবারে নিরক্ষর নন, তাহলেও বোধ করি ব্যাপারটা এতো দুঃখজনক হবে না। কারণ আপনার ব্যাপারটা তো একজন ব্যক্তির ব্যাপার, আর মহাস্থান তো একটি জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের প্রতিনিধি।

৩.
ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের অধিনায়ক জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শালে মহাস্থানকে মৌর্য যুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন (১৯৯৮ পৃ ১৯৩)। তার লেখায় তিনি মহাস্থানের নিচে বাংলাদেশের অপর অংশসমূহকে সমুদ্রে-নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ইতিহাস যে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন হতে পারে, ইউরোপীয় জাতদেমাগী সাদা চামড়ার মানুষেরা তা মানতে আগ্রহী নন। তারা বলছেন, মৌর্য আগ্রাসনের মাধ্যমেই বাংলায় নগর-সভ্যতার সূচনা। তার অর্থ কী এটাই দাঁড়ায় না যে, এর আগে বাংলার মানুষ ছিল অসভ্য? অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই তারা বলছেন, বাংলার অধিকাংশ এলাকাই ছিল পানির নিচে নিমজ্জিত। এবং তারাই গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই। কেন? যুক্তি কী? তারা বলছেন, বাংলাদেশ একটি নবগঠিত ব-দ্বীপ, সুতরাং এখানে মানুষ এসেছে অনেক পরে, যখন অন্য সব জায়গায় মানুষ সভ্যতার যুগ শেষের পথে। বাংলাদেশের অনেক ভূমিই গড়ে উঠেছে এই ব-দ্বীপের বিকাশের পর, একথা সত্যি- কিন্তু কত নতুন আমাদের এই দেশ? আসুন একটু ভূগোল ও ভূতাত্ত্বিকরা কী বলেন তা জেনে নিই।

বাংলাদেশের পাঁচটি অঞ্চল গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে। এগুলো হলো- বরেন্দ্রভূমি, মধূপুর গড় অঞ্চল, লালমাই অঞ্চল, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা। পদ্মা ও যমুনাবিধৌত সমভূমি ছাড়া উত্তরবঙ্গের প্রায় পুরোটাই বরেন্দ্রভূমি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও ঢাকা পড়েছে মধুপুর গড় অঞ্চলে, লালমাই অঞ্চলে পড়েছে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই অঞ্চলগুলো, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা মানে প্রায় পুরো সিলেট বিভাগের উচু ভূমি আর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা মানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা এবং ফেনি। বাংলাদেশের আর বাকী থাকলো কী? এই পুরো এলাকাটি গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে, মানে আজ থেকে কমসেকম ১৫ লাখ বছর আগে (সর্বোচ্চ ২৫ লাখ পর্যন্ত বলে থাকেন ভূতাত্ত্বিকরা)। অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা আজ থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ বছর আগে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত ছিল। শুধু উপযুক্ত ছিল বললে কম বলা হবে, কারণ নীল বা সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা বসতি স্থাপনের জন্য ছিল নদী-সহায়তা। মেসোপটেমিয়া ও চীনে অবশ্য কিছুটা অন্য প্রাকৃতিক সুবিধাও ছিল। আর বাংলাদেশে শুধু নদী সুবিধাই নয়, এই অঞ্চলের উচু-নীচু ভূমিরূপ দিচ্ছে তিনটি সুবিধা- এক. উচু ভূমিতে নিরপদে বন্যামুক্তভাবে বসবাস, দুই. মৌসুমী বন্যায় পলিবাহিত নিচু ভূমিতে প্রায় বিনা আয়াসে চাষাবাদ এবং তিন. কাছেই জলাভূমি থাকার কারণে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে ব্যবহার। অন্যান্য সভ্যতার অঞ্চলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশকে ওগুলোর চেয়ে বেটার মনে হয়।

তাহলে কেন আমরা বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি এবং নগর-সভ্যতা খুঁজে পাইনি? কারণ আমরা খুঁজিনি। ইউরোপীয় সাদা চামড়া বলে গেছে, তোমরা তো মাত্র মানুষ হলে... সভ্যতা তোমরা কোত্থেকে পাবে?

অথচ খোঁজা যখন শুরু হলো, তখন কিন্তু পাওয়া গেলো। বাংলার যে পাঁচটি প্লায়োস্টোসিন যুগের অঞ্চলের কথা আগে বলেছি ওই অঞ্চলগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ও অন্যান্য নিদর্শন। ফেনি ও চট্টগ্রামে, সিলেট ও হবিগঞ্জে, কুমিল্লায় এবং উয়ারী-বটেশ্বরে। একমাত্র বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়া অন্য প্রত্যেকটি অঞ্চলে যতটুকু সন্ধান চালানো হয়েছে, তাতেই পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন।

এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরবর্তীতে বাংলাদেশে নগর-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কিনা? মহাস্থান এক ইউরোপীয়-র (কানিংহাম) আবিষ্কার বলে মহাস্থানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এরা মহাস্থানগড়কে মৌর্যযুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন। এমনকি তারা মনে করেন মৌর্য যুগের আগে বাংলাদেশে আর কোনো প্রত্নস্থান থাকতে পারে না? কাজেই যখন উয়ারী-বটেশ্বরে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়, তখন তারা একে মেনে নিতে পারেন না। অথচ উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর হাতিয়ার, তাম্র-প্রস্তর যুগের বসতি ও বস্তু-নিদর্শন এবং তারো পরের যুগের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। আপনি মেনে নিতে না চাইলে কী করবেন? মাটি যে তার সম্পদ উন্মোচিত করছেই!

বাংলার অবশিষ্ট অংশ- যেটা নব-গঠিত ব-দ্বীপ বলে ফেলনা বলে আমাদের ইতিহাস-চিন্তায় প্রোথিত করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে- সেই অঞ্চলটি কত নতুন? ভূতাত্ত্বিক হোসেন মনসুর এবং আরো অনেকের বইতেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। মাত্র ৬ হাজার বছর আগেও সমুদ্র সৈকত এখন যেখানে আছে, তার থেকে বিশাল ৫ কিলোমিটার দূরে ছিল (অনন্ত দূরত্ব!)। বাংলার ব-দ্বীপ এখন থেকে ৫-৬ হাজার বছর আগেই গঠিত হয়েছিল, একথাই জানাচ্ছেন ভূতাত্ত্বিকরা, তবে বর্তমানের মতো পুরো অঞ্চলটাই যে শুকনো ভূমি ছিল, তা নয়। কিন্তু জাতদেমাগী উপস্থাপনে ওরা আপনাকে বলবে যেন মাত্র গত মঙ্গলবার এই ভূমি জেগে উঠেছিল।

তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই বানরের বাঁশে আরোহনের গল্প ফাঁদা কেন? লক্ষ্য করবেন, এই ঘরানার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তাগণ ভারতবর্ষকে আর্য কর্তৃক সভ্যকরণ তত্ত্ব দেন, যেন আর্যরা না এলে (?) আমরা বর্বর থেকে যেতাম। তারাই পরে বলেন, ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন আমাদেরকে ঐতিহাসিক ভাবে মুক্তি দিয়েছে, আমাদেরকে আধুনিক ও সভ্য করেছে। এদের কেউ কেউ এমনকি পাকিস্তানি শাসনও যে আমাদেরকে অনেক সভ্য করেছে, সেই পর্যন্ত অগ্রসর হন। প্রকৃতপক্ষে শত শত বছর ধরে ইউরোপ সারা বিশ্বে যে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও লুটপাট চালিয়েছে, তাকে বৈধ করার জন্য এবং নিপীড়িত দেশগুলোর মানুষের মনে উপনিবেশের স্মৃতি ও বিরোধিতা মুছে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দেশগুলোর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসকে বিকৃত করে। যেন উপনিবেশ না হলে যে আমরা মানুষ-ই হতাম না। কাজেই সাবেক সকল উপনিবেশ ও আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার মাধ্যমে তারা বর্তমান কালেও যেসব আগ্রাসন ও উপনিবেশিক প্রভাব রয়ে গেছে, তাকে বৈধতা দানের চেষ্টা করে। বর্তমান কালে দেশে দেশে পণ্য, তথ্য, জ্ঞান ও গণমাধ্যমের যে আগ্রাসন চলছে উপনিবেশকে কোমলায়িত করে ও উপনিবেশকে মধুমাখা করে তার বৈধতা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে জড়িত লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপকদের একটি অংশও না বুঝে অথবা ক্ষমতার লোভে এই নব্য-উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

রোবাব রোসানকে এই অবস্থানে আমি একটি পক্ষে ফেলতে চাই। কারো কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন- এমন মতের আমি আগেও বিরোধিতা করেছি, এখনো করছি। তিনি ওই ইউরোপীয় জাতদেমাগি ঘরানার ভাঁজ খেয়েছেন। ওরা তাকে যা বুঝিয়েছে, তিনি সেটুকুকে সত্যি বলে মনে করেছেন। একজন সাংবাদিক সব বিষয়ে জ্ঞানী হবেন, তা আশা করা যায় না। কিন্তু সব মহলের বক্তব্য তুলে ধরবেন, এটা আশা করা যায়। কেবল একটি পক্ষের কথা বলবেন তা কি হয়, বিশেষত যে পক্ষটি আবার বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় একটি জাতদেমাগী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত!

বি.দ্র. ২৭ এপ্রিল ২০০৭ দৈনিক নিউ এজে রোবাব রোসানের একটি প্রতিবেদন বিষয়ে এটা দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া।

কড়ি

আমার মাতামহী পরম সযতনে একটি রূপোর বিছা আমার কোমরে পরিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেদের কোমরের বিছায় কড়ি গেঁথে দিতে হয়, যুগান্তরের এই লোকসংস্কারের নিগুঢ় রহস্য তিনি জানতেন না। সুতরাং আমার শিশ্নছোঁয়া কড়িটির দিক তর্জনি বাড়িয়ে ঘুঙুরের মতো নাচালে সেটি কেবলি আমার শিশ্ন ছোঁয়, শব্দ করে না। ক্রমাগত শিশ্ন আর কড়ির এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় আমি বিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি মায়ের কোলে বসলে আচমকা বুঝতাম আমার শিশ্নের মুণ্ড কড়িতে আটকে গেছে। রেগে গিয়ে বলতাম মাকে, 'মাগো, এই কড়ি ফেলে দাও।' মাতামহী দ্রুত ছুটে এসে বলতেন, সোনারে, ছেলের বিছায় কড়ি যে দিতেই হবে। সুতরাং কড়ি-শিশ্নের ছোঁয়াছুঁয়ি আর কড়িতে শিশ্ন-মুণ্ড আটকে যাওয়ায় আমার বিরক্তি রোজই বাড়তে থাকে।

মাতামহী জানতেন কিনা, কখনও বলেননি। আমিও তো সেদিন জানলাম- কড়ি যোনির চিহ্ন।

গল্প

রায়হান রাইন অদ্ভুত গল্প লেখেন। তার গল্পে ভৌতিক যুগের বিষয়আশয় এসে হাজির হয়। গ্রামে গ্রামে ডানাঅলা ঘোড়া আর অশরীরী চিল দেখা যায়। রায়হান রাইন এই ঘোড়ায় চড়ে সিরাজগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল চলে আসেন। তারপর টাঙ্গাইল থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর যাওয়ার রোডপ্লান দেখার জন্য গড অব স্মল থিংগস খুলে বসেন। অশরীরী চিল তার সফরসঙ্গী ছিল; শরীর না থাকলেও ক্ষুধাতৃষ্ণা বিশেষত কামবোধ এই পাখির প্রবল। সে মিষ্টির দোকানগুলোতে ঢুকে পোড়োবাড়ির চমচম সাবাড় করে দিয়ে রঙমালা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের টিনের চালে বসা এক মেয়ে কবুতরকে ধর্ষণ করে রায়হান রাইনের কাঁধে এসে বসে। রায়হান না দেখেও দেখার ভাণ করে বই ফেলে ঘোড়ায় চড়ে বসেন। জানা গেছে, ক্রমাগত উত্তর দিকে যেতে থাকলে তবেই ১২ দিন ১৩ রাতের পর কালিয়াকৈর পৌঁছানো যাবে। রায়হান রাইন পণ করেছেন সেখানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর একটা শব্দও লিখবেন না। তিনি পৌঁছুতে পারেননি, বলাই বাহুল্য। পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার পণ রক্ষার আর কোন যৌক্তিকতা থাকে না। তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করেন। পরলোকে একমাত্র প্রচার মাধ্যম স্বপ্ন। ইহলৌকিক বাসিন্দারা স্বপ্ন ব্যতীত অন্য কোন মাধ্যমে রায়হানের গল্প পড়তে পারে না। আমি মাঝে মধ্যে দু'একটা পড়ি। তো, যা বলছিলাম, রায়হান রাইন অদ্ভুত গল্প লেখেন। তার গল্পে ভৌতিক যুগের.......।

উপন্যাস

ভাবছিলাম একটা উপন্যাস লিখবো।
একটা মেয়ে যশোর থেকে ঢাকা আসছে,
পথে বিচিত্র যে-সব ঘটনা ঘটবে, সে-সব নিয়েই উপন্যাস।
তারপর ভাবলাম, গল্প লিখবো। সবই ঠিক থাকবে, তবে ঘটনাগুলো কাটছাট করে ঘটবে।
তারপর লিখলাম।
মেয়েটি বাসে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো, জেগে দেখে ঢাকা।

১৬ অক্টোবর ১৯৯৯

জানবিবি

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। তড়িঘড়ি পকেটে ভরে ফেলুন। কাপড় কেটে বুক ছিড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়- সেক্ষেত্রে চোরা পকেটে রাখুন, সহজে হৃদপিণ্ডের নাগাল পাবে কাঁচখণ্ড। হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা কম; থাকলে আপনিই সবচেয়ে প্রথমে পাস করে গেলেন।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। তড়িঘড়ি লুকিয়ে ফেলুন। বাড়ি গিয়ে রূপোর কৌটোয় সযত্নে ভরে রাখুন। মাঝে মাঝে খুলে দেখবেন, মন খারাপ হলে। হতাশ, বিষন্ন, দুঃখবাদী হয়ে গেলে; আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগলে; জগতের সবকিছু অর্থহীন মনে হলে কাঁচের টুকরোটি বার করে দেখবেন সূর্যের আলোয়।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। পকেট না থাকলে, লুকোতে না পারলে, তড়িঘড়ি গিলে ফেলুন। মোক্ষম সুযোগ, সর্বশেষ। চিরকালের জন্য শুদ্ধ হয়ে যাবেন। যারা মৃত্যুর ভয় দেখায়, কাঁচ মুখে পোরার আগে ওদের মুখে একদলা থু থু ছিটিয়ে নিন। কাঁচ খাওয়া মুখের থুথুর যোগ্য সবাই নয়।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। হুড়োহুড়ি করে, লুটোপুটি করে সংগ্রহ করুন। পাশের বন্ধুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে, সামনের পেছনের মানুষগুলোর হাতে পা তুলে দিয়ে সকলকে নিবৃত্ত করুন। সজোরে সবেগে সংগ্রহ করুন কাঁচখণ্ড। কাঁচের টুকরো হাতে থাকলে বজ্রমুষ্ঠি হবে আপনার। সচীত্কারে বলতে পারবেন, আমি জানবিবির সন্তান, ধর্ষক নই!


(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা হলগুলোতে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধর্ষণকারী এবং তাদের সহযোগীদের হল থেকে বিতাড়ন করে। এই রণমিছিল চলাকালে আন্দোলনকারী ক'জন ছাত্রছাত্রী হলের তালা এবং কিছু চিহ্নিত ঘরের দরজা-জানলা ভাঙচুর করে। কেউ কেউ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের রক্তমাখা কাঁচ সংগ্রহ করেছিল। জানবিবি আমাদের মা। জানবিবির হল আমাদের প্রিয়, হলের ঘর আমাদের প্রিয়; ঘরের দরজা, জানলা, জানলার কাঁচ আমাদের প্রিয়।)

পেট্রোল

পেট্রোল
০০০০
প্রতি লিটার ২৪.৫০ টাকা

অয়েল স্টেশনে দাঁড়ানো পেট্রোল/ডিজেল/অকটেনের পাম্পকে শিবলিঙ্গের মতো মনে হয়। রঙবেরঙের কচি, বুড়ো, খুকি, মধ্যবয়সী, ঝোলামাই, ডবকামাই, চকচকে, ময়লা- একেকটি গাড়িনারী পাম্পলিঙ্গের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ তোলে, কেউ তোলে না- কিন্তু সকলেই ফুটো উন্মোচন করে। আর পাম্পশিব তার সুবিশাল লিঙ্গ যোনিতে সজোরে প্রবেশ করিয়ে সবেগে সঘন বীর্যঅয়েল ঢেলে দেয়। খেয়াল করলে দেখবেন, গাড়িমেয়ের সঙ্গে পাম্পশিবের এই সঙ্গমক্রিয়া অবলোকনে আরোহী মেয়ে কিংবা মহিলা খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে, আর অপরাপর পুরুষজনেরা তখন উক্ত নারীদের স্তন এবং নাভীমূল সন্ধান করে থাকে সচরাচর।

বিয়ে

রোববার আপুমণির বিয়ে। রাফি ভাই, আপার বান্ধবীর বড় ভাই, সে-ই বর। ওরা খুব ধনী, সুতরাং রাফি ভাইয়ের বাবা বিয়েতে রাজি নন। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে, বিয়ে হবেই, রাফি ভাই-আপা বিয়ে করবেই।

সামনের রোববার আপা বিয়ে করছে। রাফি ভাইই বর, যাকে বিয়ে করবে বলে আপা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে। বাবা রাজি ছিলেন না, কারণ আমরা বড়লোক। রাফি ভাইয়ের বাবাও রাজি ছিলেন না, কারণ ওরা আরও বড়লোক। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছেই, কারণ রাফি ভাইও ঘোষণা করেছিল, সে আপাকেই বিয়ে করবে।

রোববার আপার বিয়ে। রাফি ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা এ বিয়েতে রাজি নন, কারণ রাফি ভাইরা খুব গরীব। রাফি ভাইয়ের বাবাও রাজি নন, কারণ আমরা আরও গরীব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হচ্ছেই, কারণ আপা-রাফি ভাই বিয়ে করবেই।

হাতে গোনা আর চারটে দিন আছে মাঝখানে, এরপর রবিবার- আপার বিয়ে। বাবা ঠিক করেছেন রাফি ভাইয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলে। আমরাও বড়লোক ওরাও বড়লোক, সুতরাং বাবারা বিয়েতে রাজি। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে না- আপা, রাফি ভাই কেউ বিয়েতে রাজি নয়।

আগামী রোববার আপার বিয়ে। বর রাফি ভাই। রাফি ভাইয়ের বাবা এসে বিয়ে ঠিক করে গেছেন, বাবার সঙ্গে কথা বলে। আমরাও গরীব ওরাও গরীব; সুতরাং কোনোমতে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছেন বাবারা। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে না। রাফি ভাই, আপা বিয়েতে রাজি নয়।

রোববার আপার বিয়ে। বর সেই রাফি ভাই। আমাদের বাবা নেই। রাফি ভাইয়েরও বাবা নেই। সুতরাং বিয়েতে বাবাদের কোনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। অতএব বিয়েটা হচ্ছেই, কারণ আপা-রাফি ভাই পরস্পরকে ভালবাসে।

আসছে রোববার আপুমণির বিয়ে। রাফি ভাইয়ের সঙ্গে। রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই কিংবা ঐশ্বর্য নেই। আমাদের দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সুতরাং বিয়েতে ধনী-দরিদ্রের কোনো মৌলিক প্রশ্নও নেই। আর বিয়েটা তাই হচ্ছে, কারণ আপা-রাফি ভাই দুজন দুজনকে ভালবাসে।

আগামী রোববার বড় আপার বিয়ে। বর রাফি ভাই; রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই, ঐশ্বর্যও নেই। বড় আপারও দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সুতরাং বিয়েতে ধনী-গরীব বৈষম্যের মৌলিক কোনো প্রশ্নও নেই। রাফি ভাইয়ের বাবা নেই। বড় আপারও বাবা নেই সুতরাং সমাজের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধেরও কোনো বালাই নেই। অতএব বিয়েটা হচ্ছে, কারণ আপা রাফি ভাইকে ভালবাসে, রাফি ভাই আপাকে ভালবাসে এবং ওরা পরস্পরকে ভালবাসে।

আপুমণির বিয়ে রোববার। রাফি ভাইই শেষপর্যন্ত বর। রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই, ঐশ্বর্যও নেই। আপুমণিরও দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সমাজে ধনী-গরীব বৈষম্য নেই বলে বিয়েতে অর্থনীতির কোনো মৌলিক প্রশ্নও নেই। রাফি ভাইয়ের বাবা নেই। আপুরও বাবা নেই। তাই প্রতিক্রিয়াশীলতার বালাই নেই। কিন্তু সমাজে বৈষম্য নেই বলে, প্রতিক্রিয়াশীলতা নেই বলে, সকলে স্বাধীন-সত্তা এবং স্বতন্ত্র চেতনার অধিকারী বলে রাফি ভাই এবং আপুমণি পরস্পরকে ভালবাসে না।

আর তাই যে বিয়েটা হবার কথা সেটি হচ্ছে না।

বাংলা

প্রিয় মেহজাবিন কান্তা, এইবারো বাংলা। এবং পেনসিল। এবং সিগারেটের গন্ধ। এইবারো।

স্প্যানিশ ভুলে গেছি, লিখতে পারি না একদম- যা লিখি নিজেই বুঝি না; সুতরাং বাংলা। গভীর বাংলা। গভীরতম বাংলা। প্রিয় মেহজাবিন কান্তা।

কলম পাচ্ছি না; সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছি। সম্ভবত অন্য অনেক কিছুর, অন্য অনেক জনের মতো। পেনসিল। চলবে? সিগারেটের মতো?

এক প্যাকেট বেনসনের আর তিনটে বাকি। জীবনটাই তো ফাঁকি। তাই না? প্রিয় মেহজাবিন কান্তা!

অবশ্য...হ্যা এখানে একটা অবশ্যের অনিশ্চয়তা থেকে যায়- যেমন তুমি। হ্যা, অবশ্য...। আমার এক বন্ধু, বন্ধুই বোধহয়, না করেছিল প্রচুর সিগারেট খেতে- তোমার মতো। ও বোধহয় ষষ্ঠ বা সপ্তম, যে অ্যাতো আন্তরিক ভাবে বলেছিলো। বলেছিলো আরো অনেক কথা। যেমন- রাত দুটোয় যেন আমি মেহজাবিন কান্তাকে না লিখি। তুমিও বলতে, একসময়। কিন্তু রঞ্জু তেমন-ই রয়, চিরকাল। এক বিরক্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক, হাত-পিপাসু, অবোধ বালক কিংবা মনুষ্য-আকৃতিবিশিষ্ট বালকসদৃশ। ইশ! অনেকদিন- কতো দিন? কুচকুচে (এখন বাজে আড়াইটা, প্যাকেট আর দুটো সিগারেট এবং পেনসিল এবং বাংলা) কালো, বিশ্রী, তিলভর্তি, লোমশ, ঘিনঘিনে, গা রি রি করা, এক জোড়া হাত আমি ধরি না। প্রিয় মেহজাবিন কান্তা!

পর সমাচার এই যে, দুটি বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া গত তিন মাসে আমার মধ্যে ঘটেনি- এমন কোনো সুসমাচার বাইবেলে লেখা নাই। সুতরাং এইবার তুমি ডন কুইক্সোট পড়া শুরু করতে পারো। হ্যা, অবশ্যই, মূল স্প্যানিশে।

তারপর বাংলা। ডন কুইক্সোট পার্ট টু- এইবার শূন্য লড়াই করবে ডন কুইক্সোটের বিরুদ্ধে। লড়াইটা শেষ হলেই লেখাটা শুরু করবো।

বি.দ্র. কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে এই গল্পের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর মিল থাকলে তা কাকতালমাত্র।

প্রাণীকোষ

আবুল কাশেম স্যার কেবল নবম শ্রেণীতেই জীববিজ্ঞান পড়ান। তিনি স্যুটেড বুটেড হয়ে স্কুলে আসেন; পারতপক্ষে ব্লাক বোর্ডের ধারে কাছে ঘেঁষেন না- চকের গুড়ো লেগে স্যুট টাই নোংরা হয়ে যায়।

কিন্তু আজ তিনি ক্লাসে এসেই চক নিয়ে সোজা বোর্ডে গেলেন; আমাদের দিকে দূরে থাক, নিজের জুতো-টাইয়ের দিকেও একবার তাকালেন না।

পুরো চল্লিশ মিনিট ধরে, কপালে চিক চিক ঘাম তৈরি করে আবুল কাশেম স্যার ব্লাক বোর্ডে একটি প্রাণীকোষের চিত্র আঁকলেন। প্রাণীকোষটির বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করে আমাদের বোঝাতে পারলেন না, কারণ বাইরে বারেক মোল্লা স্যার দাঁড়িয়ে আছেন- আবুল কাশেম স্যার পাঁচমিনিট লেট।

আমরা কেউই প্রাণীকোষটি খাতায় তুললাম না, কারণ বইয়ে, গাইডবইয়ে এর চাইতে আকর্ষণীয়, রঙিন প্রাণীকোষের ছবি এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে। তাছাড়া বহু আগেই প্রাইভেট টিউটর আমাদেরকে প্রাণীকোষ চিনিয়েছে। মতিঝিল স্কুলের ছেলেমেয়েরা ক্লাসে প্রাণীকোষ বোঝার অপেক্ষায় বসে থাকে না।

স্যুট, টাই, প্যান্ট এমনকি জুতোভর্তি চকের গুড়ো নিয়ে আবুল কাশেম স্যার টিচার্স লাউঞ্জের দিকে চলে গেলেন।

বারেক মোল্লা স্যার ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকলেন, বোর্ডে গেলেন, ডাস্টার দিয়ে প্রাণীকোষ ঝেড়ে ফেললেন, চকে লিখলেন 'কপোতাক্ষ নদ', বললেন 'মাইকেল মধুসূদনই ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম বিদ্রোহী সাহিত্যিক......'

জীবন

জীবন মানে দুঃখ রোয়া এক সমুদ্র বুক
জীবন মানে সাগর পাড়ে রক্তিম ঝিনুক।

Wednesday, July 15, 2009

মহররম

কুফা এক নগরী ছিল দজলার পাড়ে
নবীর নাতিরে উম্মত দাওয়াত করে।
সোস্যালিস্ট ছিল না মোটে হোসেন হাসান
পুঁজির প্রোডাক্ট ওসব আল্লাহর দান।
তবু শুধু দাওয়াতী এনে মাবিয়ার পোলা
দজলার পানি বান্ধে দাড়িমুখী ঠোলা।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ৬ষ্ঠ কিস্তি

রঙপুকুরের নাম কেন রঙপুকুর হলো, সেই প্রশ্নের জবাব গত ১০ বছরে আমি পাইনি। তবে এই পুকুরের ঘাট রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে যদি “ঘাটের কথা” বলতো, তবে ঘাটের কথা গল্প না হয়ে নির্ঘাত ৭৭২ খণ্ডের উপন্যাস হতো! এই পুকুরের পাড়েই ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদ ভবন, মেডিক্যাল সেন্টার, পরিবহন অফিস এবং ফজিলাতুন্নেসা হলের অংশবিশেষ। শিক্ষার্থীদের আড্ডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সুপারিতলা, এই পুকুরের পাড়েই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রেমাপ্রেম সম্যক সম্মোহে আর কোন্ জায়গা এতো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে?
এই পুকুরের পাড়েই জাকসু ভবন। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সেটি তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এখানকার একটি ঘর খুলে তাকে রাখা হয়*। আর একটি ঘর, যেটি জাকসুর মূল সভাকক্ষ- কোনো গুরুত্বপূর্ণ সভাটভা হলে ওটাকে খুলে দেয়া হয়। দু'তিন বছর পর পর এমন সভা হয়ে থাকে।
নূরুল কুদ্দুসের আহ্বানে শঙ্কু-শমী বিষয়ক রুদ্ধদ্বার সভার জন্য এই জায়গাকে বেছে নেয়া হলো। দুই-তিন বছরের আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য ওই ঘর পরিষ্কার না করে আমাদেরকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে একদিন ঝাড়ু দেয়ার দায়িত্ব দিলেও মনে হয় এর চেয়ে কম খাটুনি যেতো। দেড় দিনের পরিচ্ছন্নতা অভিযান শেষ হলে এলেন কমরেড কুদ্দুস। ডেইরি ফার্মে রাজ্জাকের দোকানে অর্ডার দেওয়া হলো খাবারের জন্য। নিয়মিত খাবারের চেয়ে একটু বেশি উন্নত বলা যায় সেটাকে। নারী কমরেডরা কয়েকদিন ধরে আচার-টাচার কি কি সব তৈরি করে রেখেছেন, সেগুলোর গন্ধও পেলাম।
আলোচনা শুরু হলো। মানুষের মানবিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এবং কমরেডদের পারষ্পরিক সম্পর্ক নিয়ে শিবদাসঘোষীয় আলোচনা শুনতে শুনতে ঘুম এসে যাচ্ছিলো। বিশেষ করে আমি ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই জানি না। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশগ্রহণের যে বিশেষ ব্যাজ লাগে তা-ও আমার ছিল না। কেবল ঝাড়া-মোছার কাজে ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণেই বোধহয় ঐ বৈঠকে আমি অংশ নেবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তা না হলে বিকেলে মূল আলোচনা শুরুর আগেই এমন একটা আবেগ-বিধ্বংসী ঘটনা ঘটতো না।
সায়েম সৌগত দিলখোলা একজন মানুষ। যখন যেটা বোঝেন সেটা করতে বা ঐ বিষয়ে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে তার বাধে না। মেধাবী এবং সরল- এই দুয়ের অদ্ভুত সমন্বয় তার মাঝে জায়গা নিয়েছে। শঙ্কুর স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, একই ধরনের চর্চার সাথে শৈশব থেকেই থাকার কারণে শঙ্কু এবং সৌগত-কে আমরা হরিহর আত্মা বলেই মনে করতাম। শঙ্কু-শমীকে খুব সহজেই শঙ্কু-শমী-সৌগত বলা যেতো। কিন্তু তা হলো না।
সৌগত এমন একটি ঘটকালি টাইপ অনুষ্ঠানের জন্য বেশ উৎসাহী ছিলেন। তার ধারণা ছিল, কমরেড কুদ্দুস শঙ্কু এবং শমীকে হাত ধরে বলবেন- "তোমার হাতে ওকে সপে দিলাম"।- এমন একটা আমেজ নিয়ে রীতিমতো সেজেগুজে রঙপুকুরের সামনে এসে হাজির হলেন সৌগত।
পুকুরের ঘাটে আমরা যখন আড্ডা দিচ্ছি, সৌগত-ও আমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমরেড নূরুল কুদ্দুস ক্যাম্পাসের কমরেড ন্যান্সিকে বললেন, ডাকো সবাইকে। ন্যান্সির আহ্বানে আমরা সবাই একে একে ঢুকে যেতে থাকলাম প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে ঠাসা ভবনের কিছুটা পরিচ্ছন্ন ঘরের ভেতরে।
"তুমি না"
সৌগতকে আটকে দিলেন ন্যান্সি। কেন সে নয়? শঙ্কু-শমী বিষয়টি তো তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না! তো সৌগত নয় কেন?
"কারণ সৌগত-র রুদ্ধদ্বার ব্যাজ নেই।"
সকলেই কমরেড কুদ্দুসের দিকে তাকালেন, কারণ একমাত্র তিনিই বিশেষ ক্ষমতাবলে সৌগতে ঢোকার অনুমতি দিতে পারেন। কুদ্দুস ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন, ন্যান্সি দুঃখপ্রকাশ করলেন সৌগতের কাছে।
সৌগতের জন্য এই অনধিকার শাপে বর হয়ে এলো। সকাল থেকে আরো একজন অনাহূত ছিল আমাদের মাঝে। শিস নামে ফার্স্ট ইয়ারের ওই মেয়েটি বসে থাকতো রঙপুকুরের ঘাটে। সভাবিরতির আড্ডাবাজিতে সে আমাদের সঙ্গে মেতে উঠতো। আর আমরা যারা ধূম্রসেবী, তারা বেরিয়ে এলে একটু ওর সাথে খুনসুটি করে যেতাম।
বিকেলের মূল সভা শুরু হলে, সবাই যখন রুদ্ধদ্বার, সৌগত তখন শিসের জন্য তার দ্বার খুলে দিলো। রঙপুকুরের ঘাটে তাদের এই স্বেচ্ছা-নিঃসঙ্গতা কয়েক বছর চললো।
* মাহবুব মোর্শেদ একবার অসুস্থ হয়ে ওখানে মাসকাল ছিল, ওকে ধরলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশবিহারের কিছু গোপন খবর জানা যাবে।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ৫ম কিস্তি

নতুন সমস্যাটা যে নতুন না, এটা বুঝতে আমার প্রায় ছয় মাস লেগে গেলো। এমনকি বিশেষ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যখন আবেগের সকল ধরনের প্রকাশ ঘটে গেল, তখনও আমি বুঝতে পারিনি এই স্বতঃস্ফূর্ত (!) আবেগ প্রকাশের হেতু কী? রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলেও বৈঠকে কথা বলার অনুমতি মেলেনি -এক অর্থে। (রূপ মেলে তো রূপাই মেলে না!)। আরো পরে, যখন আমি নিজেই সমস্যায় পড়ে গেলাম, তখনও বুঝিনি এখানে কোনো সমস্যা আছে। আমি আছি আমার নিজের ধান্দায়, ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে যেভাবে থাকে। কিছু আড্ডাবাজি, কিছু ঘোরাঘুরি, কিছু পড়াশোনা, কিছু রাজনীতি, কিছু নারী-প্রীতি ইত্যাদি। হ্যা, সঙ্গটা ভালো ছিল, সঙ্ঘটাও।

শঙ্কু মহারাজকে দিয়েই সমস্যার শুরু বলে আমার জানা। পরে অবশ্য জানলাম, এটা যুগ-যুগান্তরের সমস্যা! অ্যাডাম-ঈভের সময়কার। ব্রেখট তো বলেই গেছেন, পৃথিবীতে মৌলিক কিছু করে থাকলে সেটা করেছে অ্যাডাম আর ঈভ, বাকী সবই অ-মৌলিক। কিন্তু আমার কাছে তো ইউনিভার্সিটি একটা নতুন জায়গা, যা দেখি নতুন লাগে। ভেবেছিলাম, এটাও একটা নতুন ব্যাপার।

অ্যাডাম-ঈভ কী করেছে জানি না, তবে মহারাজ মহাপাপ করেছে, শুনলাম। পাপ হলো- তিনি একটা মেয়ের সঙ্গে বেশি মিশছেন। একই চিন্তার, একই সংগঠনের, একই বিভাগের একই ইয়ারের একটি মেয়ের সঙ্গে শঙ্কু মহারাজকে বেশি দেখা যাচ্ছে। সমস্যাটা আরো গভীর বলে মনে হলো, যখন প্রকাশ পেলো মেয়েটা একই ধর্মীয়ও বটে।

ঘটনা আর কিছু না। ঢাকা থেকে ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমরেড নূরুল কুদ্দুস এসেছিলেন পাঠচক্র করাতে। তার চোখ তো চোখ না, একেবারে শকুনের চোখ; বহুদূর থেকেও তিনি ঠিকই বুঝতে পারেন কোথায় কী হচ্ছে। শ্রবণ তার বাদুরের মতো, সাহস বাঘের মতো, কিন্তু চলাচল করেন বেড়ালের মতো- সন্তপর্নে। তিনি ঠিকই বুঝলেন।

-"শঙ্কু আর শমীকে সবসময় একসাথে দেখা যাচ্ছে কেন?"

ক্যাম্পাসের কমরেড বললেন, ওরা তো একসাথে পড়ে তাই।

কমরেড কুদ্দুস বললেন, না! ওরা তো একসাথেই এলো। ছেলেমেয়ে তো এক হলে থাকে না।

ইউনিটের কমরেড বললেন, ওরা এক সাথে ক্লাস করে এসেছে তো, তাই।

কেন্দ্রীয় কমরেড বললেন, না। কাভি নেহি। এর মাঝে ওরা একসাথে বেরিয়েও গেছে।

ইউনিটের কমরেড বললেন, কই আমি তো দেখিনি!

কমরেড নূরুল কুদ্দুস বললেন, সাবধান, আরো সাবধান হতে হবে তোমাদের। এখনই বেখেয়াল হলে চলবে? আমরা ওদের বাবার বয়সী, ওরা তো আমাদের ছেলেমেয়ের মতো। ওদের ভালোমন্দ তো আমাদেরকেই দেখতে হবে। ডাকো রুদ্ধদ্বার সভা, বিষয়টা সুরাহা হওয়া দরকার।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ৪র্থ কিস্তি

ক্যাম্পাসে গিয়েই আমি একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম, বলা বাহুল্য একটি বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে। বাম হইলে কেন জানি, পিতামাতাবোনভ্রাতাবন্ধুস্বজন সবাইরে বাম বানাইতে ইচ্ছে করে। আমিও সেই সুবাধে আমার শৈশবের সব বন্ধুরে বাম বানানোর প্রজেক্ট হাতে নিলাম। ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হিসেবে আলম-কেও বাম বানালাম, কিন্তু পীরের নাতি বাম হইলেই কী আর না হইলেই কী! ওর ধান্দা কীভাবে জাহাঙ্গীরনগরের কথা বইলা মানিকগঞ্জ যাবে। তবুও আমার সঙ্গে দেখা হলে ওর ডায়লগ থাকতো- "তোমাদের সংগঠনের খবর কী? থুক্কু আমাদের সংগঠনের খবর কী?" এই জাতীয়।

এইবারে যখন প্রেম, নারী এবং রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম, ও সাথে সাথে ব্যাপারটাকে রিলেট করে ফেলতে পারলো। "ও! এই বিষয়েই না গত ফেব্রুয়ারিতে একবার কী ঝামেলা হইছিলো, তোমাদের সম্মেলনের সময়, থুক্কু আমাদের সম্মেলনের সময়?"

হ্যা, যদিও সংগঠনের সম্মেলন প্রতি বছরই হয় না, কিন্তু হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মীনার জন্মদিন চার বছরে একবারই আসে। ফলে একটি সন্ধ্যা ওর সাথে কাটাবার ইচ্ছে হয়েছিলো আমার। ইচ্ছেটা একসময় তাড়নায় এবং শেষ পর্যন্ত জেদে রূপ নেয়- আমি যাবোই। কমরেডরা যতই 'না' বলুক, সংগঠনের গতি যতই বাধাপ্রাপ্ত হোক- বের হবার, বেড়ে ওঠার আকাঙ্খাকে শৃঙ্খলিত করে বনসাই হবো না আমি! ইউনিটের কমরেডকে ব্যাপারটা জানাই আমি- আসাদ ভাই, কটা দিন আপনার পাশে থাকতে পারবো না।

শুনে তিনি রেগে যান। জন্মদিন? সম্মেলন রেখে জন্মদিন? এবং অতঃপর জন্মদিন বিষয়ে লেনিনের কোনো এক সমালোচনা 'নিজের ভাষায়' শুনিয়ে দেন, লেনিনের প্রবন্ধটি যোগাড় করা গেলে সম্মেলনের পর এ বিষয়ে একটা পাঠচক্র করা হবে।

আসাদ ভাইকে পাত্তা না দিয়ে আমি ব্যাগ গোছাতে থাকি। কমরেড জি.এস.-এর সঙ্গে দেখা করতে তার হলে যাই। "অঞ্জনদা' চললাম"।

তিনি কিছু বলেন না প্রথমে। এবং যখন বলেন তখন বলেন, কিছু বলবো না আমি। সিদ্ধান্ত তোমার।

বরং আমার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয় এমন একটি গল্প শোনান তিনি। সেই কমরেডের গল্প, যিনি পরম ভালবাসায় সংগঠনের কাজে এমনি মিশে গিয়েছিলেন, কাজ করতে করতে পার্টি অফিসেই তিনি মারা গেলেন। মজার ব্যাপার হলো মরার এগারো মাস পর এক মহিলা এসে বললেন, কমরেড শরীফুল ইসলাম তার স্বামী, যিনি বছরের কয়েকটা মাত্র দিনই বাড়ি থাকেন। কমরেড শরীফের খোঁজ তিনি করতেন না, যদি তার শ্বাশুড়ি মৃত্যুপথযাত্রী না হতেন। কান্নাহীন, সম্ভবত বেদনাহীন, নির্লিপ্ত মিসেস শরীফ জানতে চান, বুড়িকে কিভাবে কমরেড শরীফের হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলবেন।

অঞ্জনদা' গল্প বলেন হাসিমুখে; কিন্তু ভরাট গলায়, কান্না জমানো। আমি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি। সূর্য ডুবছে আনমনে। আমি সেন্ট্রাল মাঠে শুয়ে ভাবি, যাবো? শেষ শীতের হাওয়া গলার ভেতরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। যাবো? দূরে দিগন্তের কালশিরা- যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। যাবো?

মীনাই সব কিছু নয়। সব হলেও- হারাতে ভয় নেই। জন্মদিন কিছুই না, বছর বছর আসে। একটা লাল সন্ধ্যা, লাল পতাকার চেয়ে লাল নয়। আর ইচ্ছে? কিছু ব্যক্তিক ইচ্ছে, ব্যক্তিবাদিতা বাদ না দিলে বিপ্লব হয়? উই শ্যাল ওভারকাম সামডে...।

পথে পথে শত শত ঘরে ফেরা মানুষের মিছিল ভাবনার পথ বদলে দেয়। মানুষ- শ্রমজীবী মানুষ; মেহনতী। দিনভর প্রাণান্ত খেটে যায়, জীবনভর যুদ্ধ করে যায়। তারপর জীবনের যুদ্ধটা অসমাপ্ত রেখেই প্রকৃতি তাকে ছুটি দেয়, মাইনে বকেয়া রেখেই। ইতিহাসে তার নাম থাকে না, কারণ জীবনে তার সুখ থাকে না।

আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর
উড়িবার ইতিহাস
তবু উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ৩য় কিস্তি

সারাদিনের রাজনীতি শেষ করে মধ্যরাতে ঘরে ফেরে মাহবুব মোর্শেদ। প্রচণ্ড গরমে ঘরে বসে থাকাই যখন দায়, তখন সারাটা দিন রাজনীতির উষ্ণ মাঠে দিন কাটিয়ে ঘরে কই একটু রেস্টটেস্ট নিবে, তা না করে আরেকবার জনসেবা করতে হচ্ছে মাহবুবকে। ঐ দিন ও কী কী করেছিলো ঠিক মনে নেই আমার, সম্ভবত মাথায় পানি-টানি দিয়েছিলো, নোংরা ঘরটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করেছিল, এইসব। মাহবুব ওই রাতটা আমাকে বলতে গেলে বাঁচিয়ে রাখে। সকালে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই।

দুটি বৃষ্টির আর পাঁচটি জ্বরের রাত কাটিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। যাত্রাপথে যাত্রাবাড়িতে থামি আমার শৈশবের বন্ধু আলমের সাথে দেখা করার জন্য। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে?-এই প্রশ্নের জবাবে একসময় আমি ওর নামই বলতাম। বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী পীরের নাতি ও। কথায় কথায় আধ্যাত্মিকতা আর রহস্যময়তা রাখতে পছন্দ করতো, ভাবের চর্চাও করতো। বিষয়টা ও পেয়েছিলো পারিবারিকভাবে। এই অতি ভাব আর রহস্যময়তার কারণে শেষ পর্যন্ত নিজের প্রেমটাকেও হারাতে হয়েছে আলমকে। কিন্তু এই হারানোটাকেও মধুর করে তুলেছে "বিরহ বড়ো ভালো লাগে" টাইপের বেশভূষণ আর আচরণের মাধ্যমে। "যাকে চাইলাম তাকে পেলাম না, আর অন্য কার কাছে যাবো?"-ইত্যাদি মার্কা কথাবার্তা আরকি! অবশ্য এইসব গল্প অনেক পরের। সেদিন যখন আলমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখনও পর্যন্ত গল্পটা প্রেমের রহস্যেই ছিল, বিরহের রহস্যে ছিল না।

আলম যে মেয়েটাকে পছন্দ করতো সে থাকতো মানিকগঞ্জ। প্রায়ই 'জাফরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি' বলে বাসা থেকে বেরিয়ে বাসে চড়ে আলম ঘুমিয়ে পড়তো। সাভার-নবীন গড়*-ধামরাই পেরিয়ে সে যখন ভুলে মানিকগঞ্জ চলে আসতো, তখন তার ঘুম ভাঙ্গতো। পীরের নাতি হিসেবে এইভাবে সে মিথ্যে না বলেও নিজের প্রেমের সাথে দেখা করে আসতে পারতো। কিন্তু পীরের নাতি না হওয়ার আমাকে প্রায়ই আলমদের বাড়িতে আলমের মায়ের কাছে মিথ্যে বলতে হতো। বিষয়টা অবশ্যই ওর প্রেম এবং জাহাঙ্গীরনগর গমন।

এইবার অবশ্য আলমের না, নিজের প্রেম নিয়েই এসেছি ওর কাছে। আমার প্রেম মানে আমি যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছি বলে আমার সঙ্গী-সাথীরা মনে করছে সেই বিষয়টি নিয়েই ওর সাথে আলাপ করতে এসেছি। কারণ বিষয়টি নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। ঝামেলা মানে চরম অবস্থা। আমি পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারিনি। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ প্রায়। কিন্তু ঘটনা হলো, আমি প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার ওপরে চেপেছে। আমার সাথীরা, এমনকি ঐ মেয়েটিও ভাবছে আমি প্রেমে পড়েছি। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থা।



* নবীন গড়-কে অনেকে ভুল করে নবীনগর লিখে থাকে।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ২য় কিস্তি

বৃষ্টি শেষ করে আমি জ্বরে পড়লাম। ভুলেই গিয়েছিলাম, প্রচণ্ড জ্বরের কারণেই আমি ক্যাম্পাসের তুমুল আন্দোলন ফেলে বাড়ি চলে এসেছি। বাড়ির একটু বেশি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসে ক্যাম্পাসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম- এই কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। বৃষ্টিসঙ্গ কয়েকদিন স্বাভাবিকভাবেই বিছানায় থাকার অজুহাত এনে দিয়েছিল। বৃষ্টি সেরে যেতেই জ্বর ঝেকে বসলো। এমন জ্বর আমার বাপের জন্মেও আসেনি। আমার পুরো ক্যাম্পাস লাইফে কেউ আমাকে এতো অসুস্থ দেখেনি। অবশ্য এটাও দেখেনি তেমন কেউ- এক মাহবুব মোর্শেদ ছাড়া।

ক্যাম্পাস থেকে যেদিন এলাম, তার আগের দিন সন্ধ্যায় মাহবুবদের সঙ্গে দেখা। মাহবুবরা মানে ক্যাম্পাসের প্রভাবশালী এবং ত্যাগী নেতাদের কথা বলছি। রিকশা থেকে হলের গেটে নেমে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠলে কয়েকধাপ বেশি পেরুতে হবে, এই ভয়ে আমি উত্তর দিকের সিঁড়ির দিকে এগুতেই ওদের সামনে পড়ে যাই। মনিমোহন দাশগুপ্ত, আবু সাঈদ আকিজ, মাহবুব মোর্শেদ, ফারুক ওয়ারিদ প্রমুখ নেতা হলের বারান্দার বাঁধানো রেলিংয়ে বসে কর্মপরিকল্পনা করছিলেন। আমার এক হাতে পাউরুটি আর কয়েকটা ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, অন্য হাতে একটা সিরাপের শিশি।

ফারুক ওয়ারিদ আমাকে ডাকলেন- 'কই থাকো সারাদিন?'

-শরীর খুব খারাপ, সারাদিন ঘুমাইছি, কিছু খাই নাই। এখন উঠে ডেইরিতে গিয়ে খেলাম আর এই ওষুধ নিয়ে আসলাম।

আমি আমার হাতের ওষুধ আর রুটি ফারুককে দেখালাম।

- ঘুমাও, রোম যখন পোড়ে নিরো তখন বাঁশি বাজায়। ক্যাম্পাসের তুমুল আন্দোলন, আর তুমি ঘুমাও!

জ্বর আর মাথা ব্যথার কারণে ফারুক ওয়ারিদের সু-সত্য প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার মাথায় আসছিলো না। ক্যাম্পাসে তুমুল আন্দোলনের সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার অপরাধবোধে আনত হয়ে আমি ধীরে ধীরে জানলার কাঁচভাঙ্গা আমার ৩২৭ নম্বরের ডেরার দিকে চলতে থাকলাম। কোনো আন্দোলন হলেই কেনো ক্ষমতাসীন দলের ছেলেরা আমাদের ঘরের জানলার কাঁচ ভাঙ্গে- এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা না করেই আমি তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম এবং ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিলাম।

৭৭২ পর্বের দীর্ঘ উপন্যাস : ১ম কিস্তি

আমি যখন প্রিমিয়ামে জাহাঙ্গীরনগর থেকে ঢাকা আসছিলাম, তখনও আমি ঘামছিলাম। আমার সহপাঠীদের কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন- গরম তো আর কম না, গাড়ির গরম, বাতাসের গরম, সূর্যের গরম, মানুষের গরম- সব মিলে গরম এত বেশি যে এসি গাড়িতেও আমাকে ঘামতে হচ্ছে।

ঢাকা থেকে রূপগঞ্জের পথে গরমে আমি কোমল পানীয় পান করতে বাধ্য হই, যার কোনো ফুড ভ্যালু নেই। এবং খেয়াতে নদী পাড় হবার সময় আমি নদীর পানিতে হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হতে চেষ্টা করি। এ নদীটিকে স্থানীয় লোকেরা বালু নদী বলে।

আমি যখন বাড়ি এসে পৌঁছাই, বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার বোন হাতপাখা এনে দেয়। কারণ অনেকদিন ধরে এলাকায় বিদ্যুত নেই। আমি হাতপাখা নাড়ি। কিন্তু একটু পরেই থেমে যাই। ক্লান্তিতে নয়, বাড়ির চারপাশের গাছগুলো প্রচণ্ডভাবে নড়ছে, সুতরাং বইছে বাতাস প্রবলভাবে। সূর্যের নীচে প্রচুর কালো মেঘ, আমাদের মাথার ওপর- তাই সূর্যের উত্তাপ এবং আলো দুইই উধাও।

একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হলো। প্রচণ্ড বৃষ্টি। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি। আমার পিচ্চি বোনটা 'ভাইয়া দেখ মেঘ' বলে চীত্কার করতে থাকে। আমি মেঘ দেখি। দেখি থামার কোনো লক্ষণ নেই। আমরা বৃষ্টিকে অনন্ত ধরে কাজের পরিকল্পনা করি। তখন দুপুর সাড়ে তিনটাতেই ঘরে হ্যারিকেন-মোমবাতি জ্বলে ওঠে। আমি দুপুর সাড়ে তিনটাতেই দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলি, বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকি না।

এবং সেই দুপুর সাড়ে তিনটাকেই আমাদের কাছে সন্ধ্যা মনে হয়। সন্ধ্যাকে মনে হয় নিশুতি।

সেই সন্ধ্যা বা রাতে আমি ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে লিখতে বসি, তবু দরজা-জানলার ফাঁক দিয়ে হুড়মুড় করে বাতাসের, পানির ঝাপটা এসে টেবিল ভিজিয়ে দেয়, হ্যারিকেন নিভিয়ে দিতে চায়।

সে রাতে আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি, পরদিন সকালে আকাশ উজ্জ্বল হলে আবার লিখবো কিংবা দিনের বাকি কাজগুলো করবো ভেবে। কিন্তু সকালে দেখি বৃষ্টি ঝরছেই। বৃষ্টি ঝরতেই থাকে। আমি আবারও রাত হলে শুয়ে পড়ি। কিন্তু আমার কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। এ প্রচণ্ড শীতে যখন আমি কম্বলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি, তখনও মশারির বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমি লিখতে চাই। সুতরাং লেখার জন্য উঠি এবং লিখি।

তখনই একদল রংবেরংয়ের পোকা আমার হাতে, কাগজে, গায়ে এসে বসে। ওরা বাইরে থাকতো, বৃষ্টি ওদের বাইরে থাকতে দেয়নি।

রাজাকারদের দোসর কারা?




বদলে দেয়ার ভণ্ডামি

প্রথম আলোর “বদলে যাও, বদলে দাও”-এর যে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো বানানো হয়েছে, সেগুলোতে প্রথম আলোর চরিত্র বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। ধরুন ঐ বিজ্ঞাপনটার কথা যেখানে দু’জন লোক দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে প্রথম আলো স্টাইলে আলোচনা করতে করতে ফুটপাত ধরে হাটেন, ছোট একটি ছেলে তাদের পথে এসে হাজির হলে তারা তাকে এমনভাবে সরিয়ে দেন যে ওর খাবারগুলো রাস্তায় পড়ে যায়। ঝাক্কাস। পুরা প্রথম আলো। প্রথম আলো ওই আলোচকদ্বয়ের মতোই কেবল ‘যা কিছু ভালো’ টাইপের কিছু সস্তা কথা বলে যায়, কখনো সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে না, সমাধানের প্রশ্ন তো ওঠেই না।

ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি : বিভ্রান্তিকর শব্দবিন্যাস

আয়োজকরা হয়তো সচেতন ভাবে করছেন না, কিন্তু ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপন আসলে প্রকারান্তরে জনমানসে ঢাকাকে কমবয়সী একটি নগর হিসেবে প্রতীয়মান করছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য অনুসারে ঢাকার বয়স কমপক্ষে ১৭০০ বছর অথবা আরো বেশি।

ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপনের বছরে ঢাকার বয়স প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই ঢাকার বয়স কত-এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রগুপ্তের (৩৩৫-৩৮০ খ্রীস্টাব্দ) এলাহাবাদ প্রশস্তি লিপিসাক্ষ্যটি একবার স্মরণ করেন। কেননা, ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিষয়ে সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত সাক্ষ্য এখনও পর্যন্ত এটিই। এই শিলালিপিটিতে বর্ণিত সমতট জনপদটির একটি নগর হিসেবে "ড্বকা"-র যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিকেই ঢাকা সর্ম্পকে সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ বলে মনে করা হয়।

কুমিল্লা অঞ্চলে প্রাপ্ত অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার, যার বিবরণ দিয়ে গেছেন হিউয়েন সাং (৬০৩-৬৬৪ খ্রীস্টাব্দ), তার ভিত্তিতে কুমিল্লা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলটিকেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক সমতটের সঙ্গে কল্পনা করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রাগুলো (যার বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর) জনপদ হিসেবে সমতটের অবস্থান ঢাকার আরো নিকটবর্তী করে তুলেছে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব হিসেবে সাধারণত মুদ্রার ওজন, আকার এবং প্রতীককে ভিত্তি করে জনপদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এর ভিত্তিতে উয়ারী-বটেশ্বরকে একটি জনপদ এবং একটি সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে প্রমাণ করা যায় (বিস্তারিত জানতে দেখুন EASAA Handbook 2005, University of London)।

সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ লিপিসাক্ষ্যে বর্ণিত ‘ড্বকা’ নগরীকে ঢাকা নামের অপভ্রংশ মনে করা হয়। আর যদি সমতট বর্তমান ঢাকা থেকে বেশি দূরে না হয়, তবে সমুদ্রগুপ্তের "ড্বকা"কেই আমরা বর্তমান ঢাকা বলে মনে করতে পারি। উয়ারী-বটেশ্বরের গবেষণা থেকে সমতট যে ঢাকার অনেক নিকটবর্তী ছিল সেটি একরকম নিশ্চিত।

ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার অভাবে আপাতত আমরা এই তিনটি সম্ভাবনাকে একত্রিত করে, অর্থাৎ এলাহাবাদ লিপিতে বর্ণিত জনপদ সমতট, শহর ড্বকা এবং উয়ারীর মুদ্রা- এই তিন অনুষঙ্গকে মিলিয়ে বলতে পারি, সম্ভবত খ্রীস্টিয় ৩য়-৪র্থ শতকেই ঢাকা একটি নগর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে অর্থাৎ পাল ও সেন যুগেও যে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ একটি নগর ছিল, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। তবে, আমাদের মনে রাখা দরকার, নগর হিসেবে ঢাকাকে কেবল তার বর্তমান সীমারেখার মধ্যে কল্পনা করলে চলবে না। তখনকার যুগে নদীপথ নির্ভরতার কারণে অনেক সময় সুবিধাজনক এলাকায় নগর স্থানান্তরিত হয়েছে। এই বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সাভার এবং ধামরাইকেও ঢাকার মধ্যেই ধরতে হবে।

সুবেদার ইসলাম খাঁ-র ঢাকায় আসার অনেক আগেই ঢাকায় স্থাপিত কমপক্ষে ১৫ টি স্থাপনা এখনও দেখা যায়। এগুলো হলো- সাভারের রাজা হরিশচন্দ্রের ভিটা বলে পরিচিত বিদ্যায়তনটি (৭ম-৯ম শতক), রামপালের বল্লাল বাড়ি (১২শ শতক), বুড়িগঙ্গার তীরে রাজা চাঁদ রায়ের প্রাসাদ এবং মঠ (১৬শ শতক), কাপাসিয়া দুর্গ (১৬শ শতক), কালী বাড়ি (১৬শ শতক), গুরুনানক স্থাপিত কূপ ও মন্দির (১৫শ শতক- বিলুপ্ত), ঢাকেশ্বরী মন্দির (মতান্তরে ১২শ-১৬শ শতক), কেল্লা মোবারকাবাদ (১৫শ শতক), বিনত বিবির মসজিদ (১৫শ শতক), পাগলা সেতু (১৬শ শতক), নাসওয়া গলির মসজিদ (১৫শ শতক), মীরপুরের মাজার ও মসজিদ (১৫শ শতক) (আরো স্থাপনার তালিকা জানতে দেখুন A Guide to Ancient Monuments of East Pakistan by Dr. S.M. Hasan, Society of Pakistan Studies, 1970 এবং বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আ কা মো যাকারিয়া, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৮৪)। এই পনেরটি স্থাপনার বাইরে নারায়ণগঞ্জ (সোনারগাঁও ও বন্দর) এবং মুন্সিগঞ্জের অপর স্থাপনাগুলো ধরলে এই সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাবে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমেও আরো অনেক স্থাপনা পাওয়া সম্ভব বলে আমরা মনে করি, কেননা এখন পর্যন্ত যেখানে খনন হয়েছে সেখান থেকেই প্রাচীনতর স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব স্থাপনা নিঃসন্দেহে নগর হিসেবে ঢাকার প্রাচুর্য ও বিকাশের প্রতিনিধিত্ব করে।

সুবেদার ইসলাম খাঁ-র সুবের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করার দিনটি ইতিহাসের আলোকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐ দিন-তারিখটির উদ্যাপন ইতিহাসের দিকেই আমাদের চোখ ফেরাতে বলে। কিন্তু তা কোনোভাবেই সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে বিয়োজন করে হতে পারে না।


পুনশ্চ: চারশ' বছর পূর্তি হচ্ছে সুবেদার ইসলাম খাঁ-র সুবে-র রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে ঘোষণার। যদিও ঢাকা খুব বেশি দিন সুবে-র রাজধানী থাকেনি, তবু সুবে-র রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে বেছে নেওয়ার কারণে ঢাকা নগরের গুরুত্ব বোঝা যায়। কিন্তু মূল প্রশ্নটা অন্যখানে। এই লেখা পড়ার পর হয়তো আপনারা ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই ধরে ফেলেছেন। সেটি হলো, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যের এক সুবে-র একটি নগরী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করায় তার যদি চারশ' বছর পূর্তি হতে পারে, তবে সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের এক জনপদের নগরী হিসেবে ঢাকার অবস্থানের ১৭০০ বছর পূর্তি কেন হতে পারে না? ইতিহাস তো সমুদ্র গুপ্তকে জাহাঙ্গীরের চেয়ে বড়ো সম্রাট বলেই স্বীকৃতি দেয় এবং জনপদগুলোকেও সুবে-র চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে না। ১৯৯৩ সালে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের সাতশবছর উদযাপনের নামে যারা ইতিহাসবিকৃতির চেষ্টা করেছিলেন, সেই মৌলবাদী শক্তি এখনো সেই চেষ্টাই করছে কিনা, সেটাই মূল প্রশ্ন।


চারশ' বছর হোক, সাতশ বছর হোক, সতেরশ বছর হোক, ইতিহাসের দিকে আরো একটু বেশি সচেতনভাবে এবং আরো নিরপেক্ষভাবে সবাই নজর দিক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।