Sunday, May 6, 2007

ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প : ঐতিহ্য???

কয়েকদিন আগে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে। খুবই আগ্রহ নিয়ে, আন্তরকিতার সাথে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক-প্রযোজক ধামরাইয়ে প্রস্তুত কাসা-পিতলের মূর্তিগুলো দেখাচ্ছিলেন। আমরা জানতে পারলাম, সুপ্রাচীন হরিশচন্দ্রপালের বিহারে খনন করেও কয়েকটি তামা-পিতলের মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। সুতরাং সেই পাল আমল থেকেই যে এখানে তামা-পিতলের শিল্প গড়ে উঠেছে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তার ওপরে যুক্ত হয়েছে ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ। মোটামুটি মৌর্য শাসনামল থেকেই যে ধামরাই বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটি তো বাংলার ইতিহাস-রচয়িতারাই বলে দিয়েছেন। সুতরাং টিভি অনুষ্ঠানে যদি ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পকে বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের নিদর্শন বলে প্রচার করা হয় কিংবা ধামরাইয়ের ভাস্কর্য বানানোর পদ্ধতি‌ সেরে পার্দু বা লস্ট ওয়াক্স মেথডকে যদি দুনিয়ার অনন্য পদ্ধতি হিসেবে বলার মধ্য দিয়ে জাতিগত ঐতিহ্য-বোধের অহমিকাকে আরো একটু বাড়ানো যায় তাহলে সে সুযোগ কে নিতে না চাইবে? এজন্য বিদেশি কিছু মানুষের সার্টিফিকেটের যে গুরুত্ব রয়েছে, এটাও আমাদের মিডিয়া বোঝে এবং সে জন্য কিছু সাদা চামড়ার মানুষের মুখ দিয়েও তারা এই ঐতিহ্যবাহী (?) শিল্প সম্পর্কে ছাড়পত্র গ্রহণে পিছপা হয়নি। টিভির একটা অনুষ্ঠান নিয়ে এতো কথা বলার কারণ, ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে বিটিভি যে দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করলো, আমরা সবাই কমবেশি ঐ রকমই ধারণা মনে মনে পোষণ করি। মজার ব্যাপার হলো, ওপরে ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে টিভির যে মতামত আলোচনা করা হলো, তার প্রায় পুরোটাই ভুল। এক কথায় ভুল বলে দেওয়াটা কোনো বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি হতে পারে না। কিন্তু ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে ট্রান্সন্যাশনাল কালচারিস্টরা যে মিথ তৈরি করেছেন, তার বিপরীতে এর চেয়ে ভালো ভাবে বলা সম্ভব নয়। আপনি কি জানেন, ধামরাইয়ের নামকরণ নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে বাংলার ইতিহাসবেত্তাগণ কতো দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং তার প্রায় পুরোটাই করেছেন কোনো ধরনের মনোযোগ না দিয়েই? রূঢ় মনে হচ্ছে বাক্যটি? তাহলে শুনুন, ধামরাইয়ের নাম ধামরাই হয়েছে ধর্মরাজিকা থেকে, একথা তো প্রায় সব ইতিহাসবিদ জানেন। ঐ ধর্মরাজিকা যে সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন এটাও আমাদের প্রায় সবার জানা। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হলেন যে, ধর্মরাজিকা থেকেই ধামরাইয়ের নাম এসেছে? দীনেশচন্দ্র সেন এবং যতীন্দ্রমোহন রায় এ প্রসঙ্গে একটি দলিলের কথা বলছেন। দলিলটি মোগল আমলের, ঐ দলিলেই নাকি লেখা রয়েছে, ধামরাইয়ের নাম ধর্মরাজিকা। দলিলটির একটি কপি আবার ঐ বইয়েই দেয়া আছে। আপনি ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, দলিলটিতে ধামরাই শব্দটি রয়েছে, ধর্মরাজিকা নয়। ধরে নিচ্ছি, দলিলটির অন্য কোথাও হয়তো ধর্মরাজিয়া বা ধর্মরাজিকা শব্দটি ছিল। কিন্তু অশোকের পর প্রায় ১৯০০ বছর কেটে যাওয়ার পর অশোক নির্মিত ধর্মরাজিকার নামের জন্য মোগল আমলের একটি দলিলের শরণাপণ্ন হওয়া কতোটা নির্ভরযোগ্য হতে পারে? আপনি হয়তো বলবেন, কেন, ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ? ওটাকেই তো আমরা সূত্র হিসেবে নিতে পারি। কয়েকজন ইতিহাসবিদ অবশ্য তা-ই নিয়েছেন। সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে বীরেন্দ্রনাথ বসু ঠাকুরের একটি কথা নিয়ে। ঠাকুর তার পূর্ব্ববঙ্গের পালরাজাগণ বইয়ে ধামরাইয়ের অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ধামরাইয়ের পার্শ্ববর্তী শাকাসর নামক গ্রামের একটি স্তম্ভকে অশোক স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বইটি প্রকাশিত হবার পর, স্টেপলটন সাহেবের কাছে সংবাদ পেয়ে তিনি ঐ স্তম্ভটি দেখতে যান। (তার মানে আগের মন্তব্যটি তিনি করেছেন, না দেখেই) স্তম্ভটি দেখার পর তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ঐ বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি সংশোধনী আকারে ধামরাইয়ের তথাকথিত অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে তার নতুন অবস্থান ব্যক্ত করেন। মূল বইয়ে তিনি যেখানে স্তম্ভটিকে অশোক নির্মিত বলে মন্তব্য করেছিলেন, পরিশিষ্টে এটাকে তিনি পরবর্তী পাল-যুগের কোনো রাজাদের নির্মিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। আগে তিনি বলেছিলেন, এটা ধামরাই থেকে শাকাসরে আনা হয়েছে, এখন তিনি বললেন, এটা শাকাসরেরই, ধামরাইয়ের নয়। ঠাকুরের এই মত পরিবর্তন তার সরেজমিন পর্যবেক্ষেণের ফল। কিন্তু আমাদের ইতিহাসবিদরা সরেজমিন পর্যবেক্ষণে অনীহ। মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস নির্মাণে আগ্রহ খুবই কম। পাঠাগারভিত্তিক গবেষণাই যেন পণ্ডিত হবার পথে প্রধান উপায়! আর তাই এমনকি বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বাইবেল নামে খ্যাত আকম যাকারিয়া-র বাংলার প্রত্নসম্পদ বইয়েও এই নিদর্শনটি অনুল্লেখিত। শুধু তাই নয়, ১৯১৩ সালের পর ২০০৭ সালে শাওন আকন্দের লেখা "ধামরাই জনপদের কাঁসা-পিতল শিল্প" বইটিতেই প্রথম এই স্তম্ভ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হলো।



ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্প নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে ধামরাইয়ের ইতিহাস কতোটুকু জরুরি? অনেকটাই। কারণ যদি ইতিহাস সম্পর্কে আপনার পরিচ্ছন্ন ধারণা না থাকে, আপনি মনে করবেন, ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে হয়তো ঐতিহ্য কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আপনি ভাববেন, অশোক না হোক পাল রাজাদের সাথে একটা যোগাযোগ নিশ্চয়ই ছিল! এভাবে আপনি একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যিক সম্ভ্রম নিয়ে ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়াবেন। স্বভাবতই আপনার চিন্তা কিছুটা প্রভাবিত হবে। এবং মজার ব্যাপার হলো, আপনি সম্ভবত ভুলকে সঙ্গী করেই এগুবেন। বস্তুত ধামরাইয়ের কাসা-পিতলের শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি ব্যবসা। সেটি হলো এন্টিক ব্যবসা। ১৯৭০-র দশক পর্যন্ত সত্যিকারেরর এন্টিক-ই কেনাবেচা হতো ধামরাইয়ে। এন্টিক যখন শেষ হয়ে যেতে থাকলো, তখন, এন্টিকের মতো ভাস্কর্য তৈরি করে বিক্রি করার আগ্রহ থেকে ১৯৮০-র দশকে প্রথম এখানে কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য নির্মাণ করা শুরু হয়। যে পদ্ধতিতে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়, বাংলাদেশে তা নতুন হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তা নতুন নয়। বরং কয়েক হাজার বছরের পুরনো। এভাবেই শাওন আকন্দ ধামরাইয়ের কাসা-পিতল শিল্পের ধাতব জগতে প্রবেশের আগে আমাদেরকে ধামরাই অঞ্চলের এ যাবত কালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা করেন। আর ধামরাই অঞ্চলের কাঁসা পিতলের শিল্প সম্পর্কে বাংলা ভাষায় লিখিত সবচেয়ে দরদী বিবরণটি আমরা পাই শাওনের এই বই থেকেই। সেরে পার্দু বা লস্ট ওয়াক্স মেথড ছাড়াও আরো দুয়েকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন লেখায় কিছু কিছু তথ্য পাই, কিন্তু শাওন আকন্দ কয়েক বছর ধরে ধামরাই ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের কারিগরদের সংস্পর্শে থেকে, নিজে কাঁসা-শিল্পবস্তু তৈরি করে পদ্ধতিগুলোর যে বিবরণ দেন, তা তুলনাবিহীন। হয়তো নিজের অগোচরেই পদ্ধতির বর্ণনায় তিনি মাঝে মাঝে উত্তম পুরুষে চলে আসেন "এবার আমাদের দরকার পড়বে দুই খণ্ডে বিভক্ত একটি..." ইত্যাদি বলার একটু পরেই আবার বলেন "কারিগর হাত দিয়ে ঠেসে ঠেসে এমনভাবে মাটি প্রয়োগ করে যেন..." ইত্যাদি, এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের আর কারিগরের মধ্যকার সীমারেখাটি মাঝে মাঝে ভুলে যান। আর তার মাধ্যমেই তিনি যখন ধামরাই অঞ্চলের শিল্পীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অনুভূতি তুলে আনার চেষ্টা করেন তার মধ্যে এক গভীর মমতা প্রকাশ পায়। ধামরাইয়ের কারিগর শ্রেণীর চর্চিত উৎসব, রীতিনীতি, দৈনন্দিনতার সঙ্গে শাওন গভীরভাবে মিশে যান, এরই ফলে এই কারিগরেরা তার কাছে বলতে পারেন ঘরের কথা, নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসের কথা। এমনকি সৃষ্টিকর্তা বিষয়েও মাঝে মাঝে তাদের মনে যে প্রশ্ন জন্মায় কিংবা সব ধর্মের প্রভু যে আসলে মূলে এক - এই ধরনের দার্শনিক চিন্তাও অবলীলায় তারা শাওনের সাথে আলাপ করে। আর শাওন আমাদের সাথে আলাপ করেন ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্পের শিল্পকলার দিকটি নিয়ে, কিভাবে পশ্চিমা শিল্পবোধ একটি দেশের একটি জাতির প্রধান শিল্প-ঘরানাকে লোকশিল্পের তকমা লাগিয়ে শিল্প নামক অভিজাত ধারণার বাইরে ঠেলে দেয় অন্যদিকে ধামরাইয়ের কারিগরের নয়শো টাকার জিনিশ মহাজন কিভাবে নয় হাজার টাকার বিক্রি করেন আবার তা-ই কিভাবে আমেরিকান মহাজনেরা তাদের বাজারে নব্বই হাজার টাকায় বিক্রি হয় অথচ ধামরাইয়ের শিল্পীরা বছরের পর বছর "শিল্পী হইয়া দাম পাইলাম না" ধরনের কথা বলেই যান। শাওন সম্ভবত প্রথম গবেষক যিনি ধামরাই সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন দলিলপত্র ও শিলালেখসমূহ অনুবাদ ও পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন, যা এই বইয়ের পরিশিষ্টে সংযুক্ত করা হয়েছে।



বি.দ্র. এই লেখাটি গত ৪ মে ২০০৭ দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছুটা পরিবর্তন করে তা এই ব্লগে প্রকাশ করা হলো।