একটা ঘরের ভেতরে আমাকেসহ ৫/৬ জনকে আটকে রাখা হলো। বাইরে থেকে তালাবন্ধ। ভেতরে কোনো আলো নেই। দুপুরে কি খেয়েছিলাম, মনে নেই। এরপর ৩/৪ টা গোল্ডলীফ/নেভী/কেটুর ভাগ পেয়েছি। নিজের টাকায় সিগারেট কেনার মতো টাকাও তেমন ছিল না। রাতে খাওয়া হয়নি। যে ঘরে বন্দী আছি, সেখানে খাবার মতো পানিও নেই। বাথরুম? অকল্পনীয়! তবে বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে হবে না, সেটা জানি। ভোরের সূর্য ওঠার আগে যেভাবে দেয়াল বেয়ে এখানে এসেছি, সেভাবেই দেয়াল বেয়ে এই বন্দীশালার বাইরে চলে যেতে হবে। যেতে হবে মিছিলে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণবিরোধী প্রথম আন্দোলনের (১৯৯৮) সময়ের কথা বলছি। প্রতি রাতেই আন্দোলনকারী ছেলেদেরকে ছাত্রলীগের ধর্ষক গ্রুপ মারধোর করছে, এ কারণে নিজের হলে নিজের ঘরে যাওয়া আমাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। বাপী ভাই এম এইচ হলের কয়েকটি ঘরের চাবি জোগাড় করে রেখেছিলেন, মূলত সেইসব ছেলেদের যারা আন্দোলনে সহিংসতার ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে গিয়েছিলো। হলে প্রবেশমুখে ছাত্রলীগের প্রহরা, তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের ঘরগুলোতে এসে তল্লাশী চালিয়ে যায় তারা। ভাঙচুর-ও করেছে অনেক ঘর। আর তাই নিজের হলে নিজের ঘরে না গিয়ে এবং সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে, দেয়াল বেয়ে সেইসব নিরীহ ছাত্রদের ঘরে এসেছি আমরা। বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখা হয় এবং ভেতরে আলো জ্বালানো হয় না। ছাত্রলীগ বাহিনী যাতে বুঝতে না পারে ভেতরে কয়েকজন আন্দোলনকারী অবস্থান করছে। দিনের আলো ফোটার আগে আবার এই পথেই ফিরে যেতে হবে। অবস্থানের সময় বলতে রাত ১২টা/১টা থেকে ভোর ৫টা/৬টা পর্যন্ত। ভোর থেকেই আবার মিছিল, আবার স্লোগান, আবার প্রশাসনিক ভবনের (রেজিস্ট্রার বিল্ডিং) সামনে অবস্থান। সকাল ৯ টার দিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আসেন, সিন্ডিকেট বসে, তদন্ত কমিটি বসে, বিচারশালিস নানা কিচ্ছাকাহিনী। এভাবে দীর্ঘ ২ মাস ধরে চলার পর, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রায়- অধিকাংশ অপরাধী খালাস, তদন্ত কমিটির সামনে সদাচারণের জন্য শাস্তি মওকুফ, বাকিদের ১/২ বছরের বহিষ্কারাদেশ ইত্যাদি। ধর্ষকদের পক্ষে আলাউদ্দীন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উৎসাহ তাদেরকে বেপরোয়া করে দেয়, ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে তারা ক্যাম্পাসে নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অবশেষে ২ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মিছিল করে প্রতিটি হলে গিয়ে ধর্ষকদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। বরাবরের মতো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবারো ধর্ষকদের পক্ষ নেয়। তাদের এই পক্ষাবলম্বন এমন চরম মাত্রায় পৌঁছায় যে, ২০০০ সালে আন্দোলনের সময় তারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
বরাবর ধর্ষক নিপীড়কের পক্ষেই প্রশাসনের অবস্থান থাকা সত্ত্বেও মানিক-তানভীর-মোস্তফারা টিকতে পারেনি। তার প্রধান কারণ জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের অদম্য সাহস এবং সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। এতোসব সত্ত্বেও কাফী এবং সানীর মতো দুই লম্পট ক্যাম্পাসে ক্ষমতাচর্চার মধ্য দিয়েই বেঁচে গেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই দুইজনের অসীম চামচামির গুণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষক সবসময় তাদের সমর্থন দিয়ে গেছেন। সেই সাথে রাজাকার-সান্নিধ্য তাদের টিকে থাকাটাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সামনে এই দুই শিক্ষক যেভাবে জুতোপেটার স্বীকার হয়েছেন, তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেই লজ্জা পাওয়ার কথা। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন এবং দীর্ঘ জিহ্বার অধিকারী এই দুই শিক্ষক ক্ষমতাধরদের পদলেহন করে টিকে আছেন আজো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি কিন্তু গোপন নয়, নিপীড়িতরা সবার সামনে এসে অভিযোগ করেছেন, বিচার চেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাদের তদন্তের ফাইল হারিয়ে যায়, সাক্ষ্যপ্রমাণের কাগজপত্র গায়েব হয়ে যায়। নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে থাকে। আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে ধর্ষক-নিপীড়কের পক্ষাবলম্বনের জন্য যতো ধরনের কৌশল করা যায়, তার সবই করে যাচ্ছে।
আমরা এই ঘটনায় আর কালক্ষেপন করতে আগ্রহী নই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা এবং তাদের সাথে একাত্ম অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি এই বিষয়ে নিজের নিজের অবস্থান থেকে এবং সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত ২৬ এপ্রিল মধুর ক্যান্টিনে অনুষ্ঠিত এক সম্মিলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজের বলয়ে এই বিষয়ে যথাসম্ভব কাজ করবেন। লেখকরা লিখবেন, সাংবাদিক প্রতিবেদন করবেন, অ্যাক্টিভিস্ট আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, সংগঠকরা সংগঠিত করবেন, পেশাজীবীরা নিজ নিজ পেশার পরিমণ্ডলে প্রচারণা চালাবেন, আইনজীবীরা আইনী লড়াই করবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাফীর বিরুদ্ধে যৌননিপীড়নের অভিযোগের ১২ বছর হতে চললো। আফসার আহমেদ এক যুগ ধরে খোঁজাখুঁজি করেও হারিয়ে যাওয়া ফাইলের হদিশ করতে পারলেন না। সানীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে ৩ বছরের-ও বেশি সময় ধরে। প্রশাসন চলছে ঢিমেতেতালা মেজাজে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই এবার নাড়া দেওয়ার সময় এসে গেছে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই কাজটি হতে পারে।
আমাদের প্রাণে প্রাণ মেলানো এবং প্রাণের বন্ধনীতে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১০ শুক্রবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই বন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিটি মানুষকে আহ্বান জানাই, এই সংহতিতে অংশ নিন। (ভুলে যাওয়া) পুরনো মুখগুলোকে আবার দেখে নেয়ার, নিজেকে শানিয়ে নিয়ে নিপীড়নহীন স্বপ্ন পূরণের চেষ্টাকে আরো জোরালো করার এই বন্ধনীতে সবাইকে স্বাগত জানাই।