Sunday, January 2, 2011

ভারতীয় বিচারব্যবস্থা ও বিনায়ক প্রশ্ন

স্ত্রী ইলিনা সেনকে বিয়ের আগে প্রেমপত্র (আদালতের ভাষায়, “লাভ লেটার”) লেখার অভিযোগসহ ১১ টি অভিযোগে ছত্তিশগড়ের বিশেষ আদালত ডাক্তার বিনায়ক সেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। ছত্তিশগড়ে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরা যা করে চলেছে, সেই তুলনায় একে সামান্যই বলা চলে। একটি ভিডিও-কে রেফারেন্স করে বিবিসি জানিয়েছে, মাওবাদীদের সাথে যোগাযোগ আছে এই অভিযোগে ভারতীয় পুলিশ গ্রামের এক নারীকে গণধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করেছে। বিনায়ক সেন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন তার অন্তত সেরকম কিছু হয়নি।

যদিও শেষাবধি মাওবাদীরা বিনায়ক সেনের প্রহসনমূলক শাস্তির প্রতিবাদে “প্রতিবাদসপ্তাহ” পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, কিন্তু শুরু থেকেই তাকে তাদের দলীয় কর্মী বলে স্বীকার করেনি দলটি। বিনায়ক নিজেও কখনো সেই দলের কর্মী ছিলেন না বলে দাবী করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিনায়ক একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং মানবাধিকারকর্মী। ভেলোর ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ ডাক্তারি পাস করে ছত্তিশগড়ের আদিবাসী শিশু ও দুঃস্থ মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন এক হাসপাতাল। মানবতার সেবার জন্য তাকে ইউনেস্কো পদক, গ্লোবাল হেলথ কাউন্সিল এওয়ার্ড সহ বহু আন্তর্জাতিক সম্মাননা দেয়া হয়। জাতিসংঘ আহ্বান জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদীরা যেন তার মডেলকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসেন।

আসুন দেখা যাক, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ করছে ভারত সরকার। বিনায়ক সেনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি আটক মাওবাদী দার্শনিক নারায়ণ সান্যালের চিঠি কলকাতার ব্যবসায়ী পীযূষ গুহের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বিনায়ক সেন জানিয়েছেন, জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নারায়ণের সাথে দেখা করেছেন বিনায়ক। চিঠি চালাচালির কথাও স্বীকার করেছেন বিনায়ক, নারায়ণ এবং পীযূষ- তিনজনেই। তারা জানিয়েছেন, যথাযথ জেল কোড মেনেই সে চিঠি নেয়া হয়েছিলো, জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও সীলমোহর-ও ছিল তাতে।

কিন্তু তাতে কী? নারায়ণের জেলে আটক থাকার প্রায় ১ বছর পর পুলিশ উদ্ধার করে ৩ টি চিঠি, যেগুলোতে জেল কর্তৃপক্ষের কোনো সীল নেই। পুলিশ বলেছে, এই চিঠিগুলো নারায়ণের লেখা এবং সেগুলো পাঠানো হয়েছিল পীযূষকে এবং তা বয়ে নিয়ে গেছেন বিনায়ক। এই ৩ টি চিঠি ও অভিযোগ ৩ টির কথা তিনজনেই অস্বীকার করেন। কিন্তু আদালত মেনেছেন পুলিশের অভিযোগই। যে আইনে বিনায়কের বিচার হচ্ছে, সেই বিশেষ আইনের ১০ (ক)-এর ১ ধারা মতে বিনায়কের সর্বোচ্চ ২ বছরের সাজা হবার কথা এই অভিযোগে। আর ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০(খ) ধারা অনুসারে, “গুরুতর” শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীর অননুমোদিত চিঠি বহনের শাস্তি সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড।

বিনায়কের বিরুদ্ধে ২ নম্বর অভিযোগ, বিনায়ক সেন আটক মাওবাদী দার্শনিক নারায়ণ সান্যালের সাথে ৩০ দিনে ৩৩ বার দেখা করেছেন। বিনায়ক জানিয়েছেন, নারায়ণের সার্জারির ডাক্তার হিসেবে পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের স্বাক্ষরিত অনুমতি নিয়েই তিনি তার সাথে দেখা করেছেন। সেই অনুমতিপত্রও আদালতকে দেখানো হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে ৩ নম্বর অভিযোগ, স্ত্রী ইলিনাকে প্রেমপত্র লেখা। রাজনন্দীগাঁও থেকে পুলিশ এই চিঠি উদ্ধার করেছে। পুলিশের অভিযোগ, তাদের ব্যক্তিগত চিঠি সেখানে কিভাবে গেল? বিনায়ক সেন জানিয়েছেন, বিয়ের আগে যেহেতু তারা দু’জন দুই জায়গাতে থাকতেন, কাজেই চিঠিটি অন্যত্র পাওয়া গেছে।

৪ নম্বর অভিযোগ, ফারসগড়-এর ডাস্টবিন থেকে গোন্ডি (গোদ আদিবাসীদের ভাষা) ভাষায় লেখা কিছু ময়লা কাগজের টুকরা পাওয়া গেছে। এগুলোর কোনোটিতে বিনায়কের নাম, কোনোটিতে ইলিনার নাম, কোনোটিতে রাজেন্দ্র সায়্যালের নাম লেখা। বিনায়কের আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, ডাস্টবিনের ময়লা কাগজগুলো থেকে কোনো কিছুই স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে না, সুতরাং এই বিষয়ে তারা ডিফেন্ড করা থেকে বিরত থেকেছেন।

বিনায়কের বিরুদ্ধে ৫ নম্বর অভিযোগ হলো- বিনায়ক নারায়ণের সুস্থতা কামনা করে একটি শুভেচ্ছা কার্ড পাঠিয়েছেন। বিনায়ক জানিয়েছেন, চিকিৎসক হিসেবে রোগীর সুস্থতা প্রত্যাশা করেছেন তিনি।

৬ নম্বর অভিযোগ হলো- মদনলাল বারকাদে নামে জনৈক ব্যক্তি ডাকযোগে বিনায়ককে একটি চিঠি দিয়েছেন। মদনলাল তখন বিলাসপুর জেলে আটক ছিলেন, তিনি চিঠিতে জেলখানায় তার ওপর নিপীড়নের চিত্রটি বিনায়ককে জানান। বিনায়ক জানিয়েছেন, জেল থেকে কেউ তাকে চিঠি লিখলে, সে বিষয়ে তাকে কেন দোষী করা হবে? তাছাড়া জেলখানার যথাযথ অনুমোদন নিয়েই ডাকযোগে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে এবং মানবাধিকার সংস্থা পিইউসিএল-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিনায়ক সেন এই চিঠি প্রেস কনফারেন্স করে সাংবাদিকদেরকে দেখান। সুতরাং এখানে তার পক্ষ থেকে লুকোছাপার কোনো ব্যাপার ছিল না।

৭ নম্বর অভিযোগ- স্বামী তুষার কান্তি ভট্টাচার্যকে লেখা স্ত্রী সোমা সেনের চিঠি। তুষার কান্তি তখন নকশাল আন্দোলনে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী। বিনায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নকশালদের সহযোগিতা করেছেন। বিনায়ক জানিয়েছেন, খেলরন্জি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য তার সংগঠন কাজ করেছে এবং তারা এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছেন।

বিনায়কের বিরুদ্ধে ৮ নং অভিযোগ, বিনায়ক সেন একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেন। হাস্যকর ঠেকলেও এটাই সত্যি এবং এই ধরনের অভিযোগেই তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় অপরাধ তদন্তকারী সংস্থা তার কম্পিউটারটি জব্দ করে নিয়ে যায় এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায়, এর মাধ্যমে কিংবা এর মধ্যে বেআইনী কাজের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভারতীয় পুলিশ কম্পিউটারটিকেও একটি অপরাধ হিসেবে আদালতে অভিযোগ দায়ের করে।

৯ নম্বর অভিযোগ হচ্ছে, সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদপত্রের সংবাদ বিনায়ক পত্রিকা কেটে সংরক্ষণ করেন এবং টিভির সংবাদ রেকর্ড করে সিডিতে রাখেন। বিনায়ক জানিয়েছেন, মানবাধিকার সংগঠনের এটি একটি নিত্যকার কাজ।

বিনায়কের বিরুদ্ধে ১০ নম্বর অভিযোগ পিএইচডি গবেষক অমৃতা শ্রীবাস্তব ছত্তিশগড়ে একটি ব্যাংক খোলার সময় বিনায়ক তার ইন্ট্রোডিউসার (পরিচয় দানকারী) ছিলেন। ছত্তিশগড় কিংবা ভারতের কোনো ব্যাংক থেকেই এই ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য অমৃতা শ্রীবাস্তব ২০০৫ থেকে নিখোঁজ। পুলিশের অভিযোগ সে নকশালপন্থী, বর্তমানে সে আত্মগোপনে আছে, তবে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।

বিনায়কের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ, অমৃতা শ্রীবাস্তবের বাসা খুঁজে দেয়ার জন্য বিনায়ক সহযোগিতা করেন এবং তাকে সেই বাড়িতে ওঠান যেখানে আগে নারায়ণ সান্যাল থাকতেন। বিনায়ক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অমৃতা যে বাড়িতে থাকতেন ছত্তিশগড় পুলিশ দাবি করেছে, তারা সেই বাড়ি থেকেই নারায়ণ সান্যালকে গ্রেফতার করেছে; অন্যদিকে অন্ধ্র পুলিশ দাবি করেছে, তারা ভদ্রচলম থেকে নারায়ণ সান্যালকে গ্রেফতার করে ছত্তিশগড়ের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে।


এ-ই। সর্বমোট ১১ টি অভিযোগ। এবং অভিযোগগুলোর প্রতিটিই প্রমাণ করা গেছে বলে আদালত মন্তব্য করেছে। সুতরাং অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।

কী বলবেন?

কফিল আহমদ : নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস

টিএসসি সড়ক দ্বীপে সমগীতের ১ম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কফিল আহমেদের গান শুনলাম আজ (শনিবার)। সেটিকে প্রেক্ষিত করেই দু’চারটি কথা লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু লেখাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমনিতেই লোকে আমার লেখা পড়ে না (আগের লেখাটি পঠিত হয়েছে সাকুল্যে ৭ বার)। দীর্ঘ লেখা দিলে আরো পড়বে না। সেই ভয়ে কেটেছেটে এবং কেটে কেটে দিলাম।

●●●

কল্পনা করুন শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস নাটকের সেই দৃশ্যটি যখন ওশেনাসের কন্যারা এলো নিঃসঙ্গ প্রমিথিউসের করুণ পরিণতি দেখতে। তারা জানতে চাইলো- সময়ের দেবতা হয়ে, যখন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই আপনার নখদর্পণে, তখন আপনি এই নিষ্ঠুর পরিণতি কেন এড়িয়ে গেলেন না? প্রমিথিউসের জবাবটিও প্রণিধানযোগ্য- “জানা আর না জানা, সমান আমার কাছে”। কেননা, অসহায় এবং মরণশীল মানুষের অন্তরে আগুন জ্বেলে দিতে তিনি কখনো পিছপা নন।

●●●

ঘোড়াউত্রা নদীতীরের কবি স্বভাবের লাজুক ছেলে কফিল আহমেদ। হাওড়ের ভাটিয়ালি আর ভাসান গানের মুগ্ধ রাতজাগা শ্রোতা। জেলা শিক্ষা অফিসারের ছেলে হিসেবে কফিল আহমেদের ভাইয়েরা প্রত্যেকেই মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষিত। ছোট ছেলে কফিল যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তখন অপর ভাইদের একজন আমেরিকা, একজন ইংল্যান্ড এবং একজন ফ্রান্সে বসবাস করছেন। বাবামায়ের আশা- মেধাবী ছাত্র কফিল-ও কোনো একটি স্কলারশীপ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে বড়ো কোনো ডিগ্রি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। সে আয়োজনও সম্পন্ন হলো। ফরাসী দেশের শিল্প ও শিক্ষার আকর্ষণে প্যারিসের টিকেট হাতে নিয়ে বিমানবন্দর পর্যন্তই যেতে পারলেন। তারপর আর নয়। দেশ ছাড়তে পারলেন না। বাবামা কঠোর হলেন, “ঠিক আছে- এই দেশে থাকতে হলে একটি শর্তেই থাকতে পারবে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হবে”। তখন দেশে সেনাশাসন চলছে। সেনাদের জয়জয়কার চারিদিকে। কফিল আহমেদ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হলেন। কিন্তু পালালেন সেখান থেকেও। এমন ‘ভাড়াটে সৈনিকে’র জীবন তার নয়। বাবামা অবশেষে শর্ত দিলেন- যেহেতু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আছেন, জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজি বিভাগটি ভালো, সেখানে ভর্তি হতে হবে এবং পাস করে বিসিএস দিয়ে পররাষ্ট্র বিভাগে চাকরি নিতে হবে। শান্ত সুবোধ ছেলের মতো মায়ের বাধ্যগত লাজুক ছেলেটি এইবার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভর্তি হলেন, ইংরেজি বিভাগে। পাস করে বিসিএস দিয়ে ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এ চাকরিও পেয়ে গেলেন। কিন্তু হাওড়ে তখন শুরু হয়েছে- ভাসানপানির আন্দোলন এবং “জাল যার জলা তার” শ্লোগানে জলমহালের ইজারাবিরোধী লড়াই। যে জেলেদের সাথে আশৈশব আকণ্ঠ আবদ্ধ ছিলেন ভাটিয়ালি-ভাসান গানের সুরের বাঁধনে, তাদের লড়াইয়ের শ্লোগানেও কণ্ঠ মেলালেন তিনি। অন্য এক কফিল আহমেদের সৃষ্টি তখনি। আসন্ন আয়েসী জীবনের হাতছানি ফেলে অসহায়-মরণশীল জেলেদের অন্তরে আগুন জ্বেলে দিতে এলেন কফিল আহমেদ।

লড়াই সশস্ত্র হলো। ইজারাদারদের ভাড়াটে “লোকাল” এবং তাদের প্রহরী বহিরাগত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে অগ্নিস্নাত জেলেদেরও হয়ে পড়তে হয় হত্যাপ্রবণ। কফিল বলেন, “আগুন তুমি ভাড়াটে লোকালের ভোট চাওয়া নও, হত্যাপ্রবণ”। যে আগুনের পরিণতি ছিলো সিগারেটের ছাইভস্মে তা এসে আশ্রয় নিলো “গেরিলার বুকে লুকিয়ে থাকা গ্রেনেডে”।

●●●

গত ২৫ বছর ধরে অবিরাম আপোসহীন লড়াইয়ে বাংলা গানের ধারায় তিনি যুক্ত করেছেন এক নতুন মাত্রা। প্রচলিত “গণসঙ্গীত” কিংবা “আধুনিক গান”-এর “প্রকরণ” থেকে কফিল আহমেদ অনেক দূরবর্তী। বস্তুত জীবন ও শিল্পের সকল প্রকরণই কফিলের কাছে “সোনার রাজার মতোই কুৎসিত”। কেননা কফিল “সাতটা শঙ্খ একবারে” বাজাতে চান। কফিল আহমেদের গান তাই না গণসঙ্গীত, না আধুনিক, না লোকগীতি। কফিলের গান আসলে অগ্নিসঙ্গীত। দাহিকা বলাই সবচেয়ে ভালো হয়। কফিল আহমেদের গান হৃদয়ে দহনের সৃষ্টি করে। সে দহন রাজনীতি হোক কিংবা প্রেম! কফিল মানুষ এবং মানুষের জীবনের জটিলতায় অগ্নি প্রজ্বলন করেন। কাজে কাজেই ভদ্রলোকীয় তাল ঠুকতে ঠুকতে কফিলের গান শোনা অসম্ভব, ধারণ করা দুঃসাধ্য। কাজেই মসৃণ মানসে কিংবা মাধ্যমের ত্বকে কফিলের “বালিঘষা”(১) কণ্ঠ সহ্য করা সম্ভব হয়নি।

পাহাড় পোড়ানোর আকাঙ্খায় জনমানসে আগুন প্রজ্বলনের কাজে কফিল আহমেদ শুরু থেকেই নিঃসঙ্গ। এই ধারার সূচনা গৌতম ঘোষদের “মহীনের ঘোড়াগুলি” থেকেই সূচিত হয় বলা চলে। অনুসরণ করেছেন সুমন, নচিকেতারাও। তবে কফিল তাদের থেকে স্পষ্টভাবেই ভিন্ন। ‘সমাজতান্ত্রিক’ পশ্চিমবঙ্গে (ও কলকাতায়) যে নাগরিক চেতনা বিকশিত হয়েছে, বাংলাদেশে তা হয়নি একেবারেই। ২০১১ সালেও এই দেশে জলাধারের অধিকারের জন্য হাওড়ের জেলেদের লড়াই চলছেই। শহুরে নাগরিক এবং গ্রাম বা মফস্বলের শ্রমিক-কৃষক-জেলে এই উভয় জনমানসের আকাঙ্ক্ষার সুর একমাত্র কফিলই ধারণ করেছেন। বরং শহরের শিক্ষিত জনসমাজের চেয়ে কফিলের গান বেশি জনপ্রিয় হাওড়ের জেলে ও কৃষকদের কাছে। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যখন জানা যায়, তার প্রথম অ্যালবামের অর্ধেকেরও বেশি ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে হাওড় অঞ্চলে কৃষকজেলেদের কাছে। সেই দিক বিবেচনায় সুমন, নচিকেতারা একেবারেই খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।

সমকালের বাংলাদেশে এই ধারায় গান গেয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবু, অর্ণব, অরূপ রাহী, কৃষ্ণকলি প্রমুখ কিছুটা খ্যাতিও পেয়েছেন। শুরুর দিকে এদের কারো কারো মধ্যে দাহিকাও দেখা গেছে। কেউ কেউ সমৃদ্ধ করেছেন এই ধরনের গানের ধারাকেও। বিশেষ করে বাবুর “হরেক রকম দিন কাটিলো” এবং রাহীর “কাকে তুমি প্রেম বলো, বলো ইতিহাস” তেমনই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু আধুনিক গানের মসৃণ মাধ্যমে এদের অনেকেই মিশে গেছেন অবলীলায়। হারিয়ে গেছে গানের সেই দাহিকাও।

কিন্তু কফিল প্রজ্বলিত থেকেছেন। এবং নিঃসঙ্গও। শুধু তাই নয়, এই নিঃসঙ্গ যাত্রা থেকে কফিলকেও বিরত করে তাকে নিয়ে যেতে চান অনেকেই। এমনকি যিশুও। “যিশু আমার চন্দ্র হাতে পাতালপুরে যায়/ সে আমায় নিয়ে যেতে চায়”। কিন্তু কফিল তো যাওয়ার পাত্র নন। তার সাফ জবাব, “আমার চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম/ আমি যাই নাই রে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না”।

এবং তারপর কফিল আহমেদ তার চোখের সামনের পোড়োগ্রামের সেই আগুনের “রূপকথাটা ছড়িয়ে” দিয়েছেন সবার “চোখের সামনে”। কিন্তু কেউ তা দেখে, কেউ দেখে না। যেমন প্রমিথিউসের করুণ পরিণতি দেখে হেফাস্টাসের মনে হয়, “সবকিছুই চোখের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে, তবু কিছুই দেখতে পাই না”।

(চলবে)

Saturday, January 1, 2011

সুপ্রভাত ২০১১

খ্রিস্ট্রীয় নববর্ষ একবারই ঘটা করে পালন করেছিলাম, সেটা ২০০০ সালের প্রথম দিন। তখন সবে প্রেমে পড়েছি, কাজেই প্রেম উদযাপনেরও এক উপলক্ষ পাওয়া গিয়েছিলো। নববর্ষ টববর্ষ কিছু না, দু'জনে সারারাত একসঙ্গে থাকা- সেটিই ছিল মূল ব্যাপার। এরপর নববর্ষের খোঁজখবর আর রাখিনি। কিন্তু এবার রেখেছি। কারণ মরার ২০১০ সালটি কবে চোখের সামনে থেকে বিদেয় হবে, সেই অপেক্ষায় ছিলাম। বছরটি একেবারেই ভালো কাটেনি। বলা উচিৎ- এটি ছিল আমার জন্য দুর্ঘটনার বছর। বছরের শুরুর দিন থেকে শেষ দিন অবধি অ্যাকসিডেন্ট আর অ্যাকসিডেন্ট। অন্তত দু'বার বড়ো ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা আর তিনচারবার ছোটোখাটো, সেই সাথে ডিসেম্বরের ২৫ থেকে ৩১-এর মধ্যে ২ বার দুটি নাটকীয় দুর্ঘটনায় মনে হচ্ছে, বছরটিও আমার সাথে তার শত্রুতার ব্যাপারটি যাবার বেলাতেও ভুলতে পারেনি।

বছরের শুরুর দিন যদিও পহেলা জানুয়ারি, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবেই ৩১ ডিসেম্বর রাতটিই প্রধান উপজীব্য। কাজেই ৩১ তারিখ সকাল সকাল ঢাকায় পৌঁছুতে না পারলে সবকিছুই মাটি হয়ে যাবে ভেবে ৩০ তারিখ রাতেই ঠাকুরগাঁও থেকে বাসে উঠে বসলাম। হানিফ আমার পছন্দের তালিকায় একেবারে শেষের দিকে থাকলেও টিকেট জুটলো ওই হানিফেরই। এমনিই শীতের রাত, তার ওপর কুয়াশাও ছিল প্রচণ্ড। টাঙ্গাইলের কাছে এসে সামনের এক মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিল আমাদের গাড়ি। আমাদের গাড়িরও কিছু ক্ষতি হলো, আমি বসেছিলাম বি-১ নম্বর সীটে, কাজেই ধাক্কার কিছুটা জের আমার দেহে এসেও লাগলো। তবু ভাগ্য ভালো বলতেই হবে, কেননা আমি বাসেই ছিলাম, মাইক্রোবাসে না। দুর্ঘটনা ঘটলো এবং এরপর সেই শীতের কুয়াশাস্তীর্ণ রাতে ২/৩ ঘণ্টা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে নতুন একটি গাড়ি আসার অপেক্ষা। কাজেই ঢাকা পৌঁছে নড়াচড়া করার মতো অবস্থাও আর আমার থাকলো না, থার্টি ফার্স্ট তো দূরের কথা।

কিন্তু এই দুর্ঘটনাটিকে আমি রেখেছি "ছোটোখাটো দুর্ঘটনাসমূহ"-এর তালিকায়। বড়ো দুর্ঘটনা বলতে বোঝাতে চাই যেদিন খুলনা থেকে মধ্য রাতে বৃষ্টির মধ্যে মাওয়া হয়ে ঢাকা আসছিলাম এবং পদ্মা পেরুনোর জন্য পুলিশ ইত্যাদিদের ঘুষ দিয়ে একটি স্পীড বোটে করে নদী পেরুলাম এবং যখন সেই স্পীড বোট মাঝনদীতে এসে নদীতে পোতা কোনো খুঁটির সাথে ধাক্কা লাগিয়ে প্রায় উল্টে যায় যায়...। এই দুর্ঘটনায়ও আমার কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এই দুর্ঘটনা আমাকে দুর্ঘটনার ভয় বিষয়ে এক গভীর ধারণা দিয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনেও আর স্পীড বোটে পদ্মা পাড় হবো না।

তবে সত্যিকারের শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন আমি হই দুটি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়। এর একটি ঢাকা এবং একটি সাতক্ষীরায়। এই দুই দুর্ঘটনায় আমার হাত/পা-এ কিঞ্চিৎ রক্তপাত ঘটে, তবে হাড়গোড় ভাঙ্গেনি এটা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এমনকি আমি মোটরারোহী না হয়েও বাসার সামনের রাস্তা পেরুতে গিয়ে মোটরের সামনে গিয়ে পড়বো, সেটিকে আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বিশেষ করে আমার সাথে তখন ল্যাপটপ, ক্যামেরা সহ নানা ধরনের সেনসিটিভ জিনিসপত্র ছিল। এবং মেনে নিতে পারছি না অফিসের কাচের দেয়াল কিভাবে আমি কার্টুন ছবির মতো ভেদ করে বেরিয়ে গেলাম! মানলাম, আমি খুব দ্রুত বেগে যাচ্ছিলাম এবং আমার দৃষ্টিও সামনের দিকে ছিল না, নিচে তাকিয়ে হাটছিলাম আমি। কিন্তু তাই বলে কাচ ভেদ করে কেন বেরুবো? কাচে ধাক্কা খাবো, মাথায় টাথায় ব্যথাট্যথা পাবো, কাচ ফেটেও যেতে পারে। টম এন্ড জেরির কার্টুন ছাড়া কাউকে কাচের দেয়াল ভেদ করে বের হবার কথা কেউ কি কোনোদিন শুনেছে? এই ঘটনাটিতেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমি। আমার সারা শরীরের প্রতিটি জায়গা অর্থাৎ হাত পা গলা পেট ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় কাচেরা জায়গা করে নিয়েছিলো, আমার খুবই পছন্দের শার্ট এবং প্যান্ট কেটেকুটে চিরতরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

এবং ৩১ ডিসেম্বরের ঘটনাটি তো আরো হাস্যকর। বাইজিদ ম্যাচ কোম্পানী-কুষ্টিয়ার "টু স্টার" নামে একটা দেয়াশলাই আছে, যেটি কার্বরাইজড করা হয়নি বলে আমার ধারণা, অথচ বেশি লাভের আশায় দোকানদাররা আজকাল সেটিই বেশি বিক্রি করে। সিগারেট ধরানোর জন্য যেই না আমি দেয়াশলাই বক্সে ঠুকেছি, ফট করে জ্বলন্ত বারুদ ছুটে আমার বাম চোখের ভেতর ঢুকে গেলো এবং বলা বাহুল্য, সেখানে চোখের আয়তনের অনুপাতে বড়োসড়ো এক গর্তের সৃষ্টি হলো- একেবারে ফায়ারহোল যাকে বলে। ২০১০ সালটি যদি আমার সাথে শত্রুতাই না করবে, তবে কেন এই হাস্যকর কিন্তু জঘন্য একটি দুর্ঘটনাটি দিয়ে আমাকে বছর শেষ করতে হবে?