টিএসসি সড়ক দ্বীপে সমগীতের ১ম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কফিল আহমেদের গান শুনলাম আজ (শনিবার)। সেটিকে প্রেক্ষিত করেই দু’চারটি কথা লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু লেখাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমনিতেই লোকে আমার লেখা পড়ে না (আগের লেখাটি পঠিত হয়েছে সাকুল্যে ৭ বার)। দীর্ঘ লেখা দিলে আরো পড়বে না। সেই ভয়ে কেটেছেটে এবং কেটে কেটে দিলাম।
●●●
কল্পনা করুন শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস নাটকের সেই দৃশ্যটি যখন ওশেনাসের কন্যারা এলো নিঃসঙ্গ প্রমিথিউসের করুণ পরিণতি দেখতে। তারা জানতে চাইলো- সময়ের দেবতা হয়ে, যখন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই আপনার নখদর্পণে, তখন আপনি এই নিষ্ঠুর পরিণতি কেন এড়িয়ে গেলেন না? প্রমিথিউসের জবাবটিও প্রণিধানযোগ্য- “জানা আর না জানা, সমান আমার কাছে”। কেননা, অসহায় এবং মরণশীল মানুষের অন্তরে আগুন জ্বেলে দিতে তিনি কখনো পিছপা নন।
●●●
ঘোড়াউত্রা নদীতীরের কবি স্বভাবের লাজুক ছেলে কফিল আহমেদ। হাওড়ের ভাটিয়ালি আর ভাসান গানের মুগ্ধ রাতজাগা শ্রোতা। জেলা শিক্ষা অফিসারের ছেলে হিসেবে কফিল আহমেদের ভাইয়েরা প্রত্যেকেই মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষিত। ছোট ছেলে কফিল যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তখন অপর ভাইদের একজন আমেরিকা, একজন ইংল্যান্ড এবং একজন ফ্রান্সে বসবাস করছেন। বাবামায়ের আশা- মেধাবী ছাত্র কফিল-ও কোনো একটি স্কলারশীপ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে বড়ো কোনো ডিগ্রি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। সে আয়োজনও সম্পন্ন হলো। ফরাসী দেশের শিল্প ও শিক্ষার আকর্ষণে প্যারিসের টিকেট হাতে নিয়ে বিমানবন্দর পর্যন্তই যেতে পারলেন। তারপর আর নয়। দেশ ছাড়তে পারলেন না। বাবামা কঠোর হলেন, “ঠিক আছে- এই দেশে থাকতে হলে একটি শর্তেই থাকতে পারবে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হবে”। তখন দেশে সেনাশাসন চলছে। সেনাদের জয়জয়কার চারিদিকে। কফিল আহমেদ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হলেন। কিন্তু পালালেন সেখান থেকেও। এমন ‘ভাড়াটে সৈনিকে’র জীবন তার নয়। বাবামা অবশেষে শর্ত দিলেন- যেহেতু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আছেন, জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজি বিভাগটি ভালো, সেখানে ভর্তি হতে হবে এবং পাস করে বিসিএস দিয়ে পররাষ্ট্র বিভাগে চাকরি নিতে হবে। শান্ত সুবোধ ছেলের মতো মায়ের বাধ্যগত লাজুক ছেলেটি এইবার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভর্তি হলেন, ইংরেজি বিভাগে। পাস করে বিসিএস দিয়ে ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এ চাকরিও পেয়ে গেলেন। কিন্তু হাওড়ে তখন শুরু হয়েছে- ভাসানপানির আন্দোলন এবং “জাল যার জলা তার” শ্লোগানে জলমহালের ইজারাবিরোধী লড়াই। যে জেলেদের সাথে আশৈশব আকণ্ঠ আবদ্ধ ছিলেন ভাটিয়ালি-ভাসান গানের সুরের বাঁধনে, তাদের লড়াইয়ের শ্লোগানেও কণ্ঠ মেলালেন তিনি। অন্য এক কফিল আহমেদের সৃষ্টি তখনি। আসন্ন আয়েসী জীবনের হাতছানি ফেলে অসহায়-মরণশীল জেলেদের অন্তরে আগুন জ্বেলে দিতে এলেন কফিল আহমেদ।
লড়াই সশস্ত্র হলো। ইজারাদারদের ভাড়াটে “লোকাল” এবং তাদের প্রহরী বহিরাগত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে অগ্নিস্নাত জেলেদেরও হয়ে পড়তে হয় হত্যাপ্রবণ। কফিল বলেন, “আগুন তুমি ভাড়াটে লোকালের ভোট চাওয়া নও, হত্যাপ্রবণ”। যে আগুনের পরিণতি ছিলো সিগারেটের ছাইভস্মে তা এসে আশ্রয় নিলো “গেরিলার বুকে লুকিয়ে থাকা গ্রেনেডে”।
●●●
গত ২৫ বছর ধরে অবিরাম আপোসহীন লড়াইয়ে বাংলা গানের ধারায় তিনি যুক্ত করেছেন এক নতুন মাত্রা। প্রচলিত “গণসঙ্গীত” কিংবা “আধুনিক গান”-এর “প্রকরণ” থেকে কফিল আহমেদ অনেক দূরবর্তী। বস্তুত জীবন ও শিল্পের সকল প্রকরণই কফিলের কাছে “সোনার রাজার মতোই কুৎসিত”। কেননা কফিল “সাতটা শঙ্খ একবারে” বাজাতে চান। কফিল আহমেদের গান তাই না গণসঙ্গীত, না আধুনিক, না লোকগীতি। কফিলের গান আসলে অগ্নিসঙ্গীত। দাহিকা বলাই সবচেয়ে ভালো হয়। কফিল আহমেদের গান হৃদয়ে দহনের সৃষ্টি করে। সে দহন রাজনীতি হোক কিংবা প্রেম! কফিল মানুষ এবং মানুষের জীবনের জটিলতায় অগ্নি প্রজ্বলন করেন। কাজে কাজেই ভদ্রলোকীয় তাল ঠুকতে ঠুকতে কফিলের গান শোনা অসম্ভব, ধারণ করা দুঃসাধ্য। কাজেই মসৃণ মানসে কিংবা মাধ্যমের ত্বকে কফিলের “বালিঘষা”(১) কণ্ঠ সহ্য করা সম্ভব হয়নি।
পাহাড় পোড়ানোর আকাঙ্খায় জনমানসে আগুন প্রজ্বলনের কাজে কফিল আহমেদ শুরু থেকেই নিঃসঙ্গ। এই ধারার সূচনা গৌতম ঘোষদের “মহীনের ঘোড়াগুলি” থেকেই সূচিত হয় বলা চলে। অনুসরণ করেছেন সুমন, নচিকেতারাও। তবে কফিল তাদের থেকে স্পষ্টভাবেই ভিন্ন। ‘সমাজতান্ত্রিক’ পশ্চিমবঙ্গে (ও কলকাতায়) যে নাগরিক চেতনা বিকশিত হয়েছে, বাংলাদেশে তা হয়নি একেবারেই। ২০১১ সালেও এই দেশে জলাধারের অধিকারের জন্য হাওড়ের জেলেদের লড়াই চলছেই। শহুরে নাগরিক এবং গ্রাম বা মফস্বলের শ্রমিক-কৃষক-জেলে এই উভয় জনমানসের আকাঙ্ক্ষার সুর একমাত্র কফিলই ধারণ করেছেন। বরং শহরের শিক্ষিত জনসমাজের চেয়ে কফিলের গান বেশি জনপ্রিয় হাওড়ের জেলে ও কৃষকদের কাছে। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যখন জানা যায়, তার প্রথম অ্যালবামের অর্ধেকেরও বেশি ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে হাওড় অঞ্চলে কৃষকজেলেদের কাছে। সেই দিক বিবেচনায় সুমন, নচিকেতারা একেবারেই খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
সমকালের বাংলাদেশে এই ধারায় গান গেয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবু, অর্ণব, অরূপ রাহী, কৃষ্ণকলি প্রমুখ কিছুটা খ্যাতিও পেয়েছেন। শুরুর দিকে এদের কারো কারো মধ্যে দাহিকাও দেখা গেছে। কেউ কেউ সমৃদ্ধ করেছেন এই ধরনের গানের ধারাকেও। বিশেষ করে বাবুর “হরেক রকম দিন কাটিলো” এবং রাহীর “কাকে তুমি প্রেম বলো, বলো ইতিহাস” তেমনই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু আধুনিক গানের মসৃণ মাধ্যমে এদের অনেকেই মিশে গেছেন অবলীলায়। হারিয়ে গেছে গানের সেই দাহিকাও।
কিন্তু কফিল প্রজ্বলিত থেকেছেন। এবং নিঃসঙ্গও। শুধু তাই নয়, এই নিঃসঙ্গ যাত্রা থেকে কফিলকেও বিরত করে তাকে নিয়ে যেতে চান অনেকেই। এমনকি যিশুও। “যিশু আমার চন্দ্র হাতে পাতালপুরে যায়/ সে আমায় নিয়ে যেতে চায়”। কিন্তু কফিল তো যাওয়ার পাত্র নন। তার সাফ জবাব, “আমার চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম/ আমি যাই নাই রে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না”।
এবং তারপর কফিল আহমেদ তার চোখের সামনের পোড়োগ্রামের সেই আগুনের “রূপকথাটা ছড়িয়ে” দিয়েছেন সবার “চোখের সামনে”। কিন্তু কেউ তা দেখে, কেউ দেখে না। যেমন প্রমিথিউসের করুণ পরিণতি দেখে হেফাস্টাসের মনে হয়, “সবকিছুই চোখের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে, তবু কিছুই দেখতে পাই না”।
(চলবে)
Sunday, January 2, 2011
কফিল আহমদ : নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
পরের লেখাটা কই?
ReplyDelete