Thursday, July 16, 2009

রোবাব রোসান এবং ওয়ান টপ আর্কিওলিজস্ট : তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উত্থান (?)

প্রায় ১৫ লাখ বছরের প্রাচীন এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভূমিরূপের দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ বাংলাদেশের ইতিহাসকে প্রাচীন বলতে নারাজ। এরা বাংলাদেশকে বলেন নতুন ভূমির দেশ, যেন পরশু বিকেলে সমুদ্রের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের জন্ম হলো। এইসব বিষয় নিয়েই এই পোস্টটি।

১.
একটি বানর একটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে ২ ফুট ওপরে ওঠে এবং পরবর্তী মিনিটে ৩ ফুট নিচে নামে। ১০ মিনিট পর বানরটি কোথায় থাকবে? হাস্যকর ঠেকতে পারে, এই ভয় না করেই দশকের পর দশক জুড়ে ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি অংশ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে তৈলাক্ত বাঁশের বানরে পরিণত করেছেন।

২.
কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাস্থানগড়ে খননে লিপ্ত বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ দল জোর দাবি জানালো, মধ্যযুগ নয়, মহাস্থানগড়ের বিকাশ মৌর্যযুগে ঘটেছিল। অদ্ভুত...! মহাস্থানগড়কে মধ্যযুগের সাইট বলে কে দাবি করেছে? মহাস্থানগড় অঞ্চলে যে মৌর্য যুগের অনেক আগেই মানুষের বসতি ছিলো, এমন দাবিই তো বরাবর করে আসছিলেন আমাদের দেশের ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা। যৌথ দলের দাবিটা তো রীতিমতো আপনাকে কয়েকধাপ নামিয়ে একধাপ ওপরে তোলার মতো ব্যাপার। আপনি অলরেডি একজন গ্রাজুয়েট, আর কেউ যদি বলে, আপনি একেবারে নিরক্ষর নন, তাহলেও বোধ করি ব্যাপারটা এতো দুঃখজনক হবে না। কারণ আপনার ব্যাপারটা তো একজন ব্যক্তির ব্যাপার, আর মহাস্থান তো একটি জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের প্রতিনিধি।

৩.
ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের অধিনায়ক জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শালে মহাস্থানকে মৌর্য যুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন (১৯৯৮ পৃ ১৯৩)। তার লেখায় তিনি মহাস্থানের নিচে বাংলাদেশের অপর অংশসমূহকে সমুদ্রে-নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ইতিহাস যে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন হতে পারে, ইউরোপীয় জাতদেমাগী সাদা চামড়ার মানুষেরা তা মানতে আগ্রহী নন। তারা বলছেন, মৌর্য আগ্রাসনের মাধ্যমেই বাংলায় নগর-সভ্যতার সূচনা। তার অর্থ কী এটাই দাঁড়ায় না যে, এর আগে বাংলার মানুষ ছিল অসভ্য? অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই তারা বলছেন, বাংলার অধিকাংশ এলাকাই ছিল পানির নিচে নিমজ্জিত। এবং তারাই গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই। কেন? যুক্তি কী? তারা বলছেন, বাংলাদেশ একটি নবগঠিত ব-দ্বীপ, সুতরাং এখানে মানুষ এসেছে অনেক পরে, যখন অন্য সব জায়গায় মানুষ সভ্যতার যুগ শেষের পথে। বাংলাদেশের অনেক ভূমিই গড়ে উঠেছে এই ব-দ্বীপের বিকাশের পর, একথা সত্যি- কিন্তু কত নতুন আমাদের এই দেশ? আসুন একটু ভূগোল ও ভূতাত্ত্বিকরা কী বলেন তা জেনে নিই।

বাংলাদেশের পাঁচটি অঞ্চল গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে। এগুলো হলো- বরেন্দ্রভূমি, মধূপুর গড় অঞ্চল, লালমাই অঞ্চল, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা। পদ্মা ও যমুনাবিধৌত সমভূমি ছাড়া উত্তরবঙ্গের প্রায় পুরোটাই বরেন্দ্রভূমি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও ঢাকা পড়েছে মধুপুর গড় অঞ্চলে, লালমাই অঞ্চলে পড়েছে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই অঞ্চলগুলো, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা মানে প্রায় পুরো সিলেট বিভাগের উচু ভূমি আর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা মানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা এবং ফেনি। বাংলাদেশের আর বাকী থাকলো কী? এই পুরো এলাকাটি গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে, মানে আজ থেকে কমসেকম ১৫ লাখ বছর আগে (সর্বোচ্চ ২৫ লাখ পর্যন্ত বলে থাকেন ভূতাত্ত্বিকরা)। অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা আজ থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ বছর আগে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত ছিল। শুধু উপযুক্ত ছিল বললে কম বলা হবে, কারণ নীল বা সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা বসতি স্থাপনের জন্য ছিল নদী-সহায়তা। মেসোপটেমিয়া ও চীনে অবশ্য কিছুটা অন্য প্রাকৃতিক সুবিধাও ছিল। আর বাংলাদেশে শুধু নদী সুবিধাই নয়, এই অঞ্চলের উচু-নীচু ভূমিরূপ দিচ্ছে তিনটি সুবিধা- এক. উচু ভূমিতে নিরপদে বন্যামুক্তভাবে বসবাস, দুই. মৌসুমী বন্যায় পলিবাহিত নিচু ভূমিতে প্রায় বিনা আয়াসে চাষাবাদ এবং তিন. কাছেই জলাভূমি থাকার কারণে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে ব্যবহার। অন্যান্য সভ্যতার অঞ্চলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশকে ওগুলোর চেয়ে বেটার মনে হয়।

তাহলে কেন আমরা বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি এবং নগর-সভ্যতা খুঁজে পাইনি? কারণ আমরা খুঁজিনি। ইউরোপীয় সাদা চামড়া বলে গেছে, তোমরা তো মাত্র মানুষ হলে... সভ্যতা তোমরা কোত্থেকে পাবে?

অথচ খোঁজা যখন শুরু হলো, তখন কিন্তু পাওয়া গেলো। বাংলার যে পাঁচটি প্লায়োস্টোসিন যুগের অঞ্চলের কথা আগে বলেছি ওই অঞ্চলগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ও অন্যান্য নিদর্শন। ফেনি ও চট্টগ্রামে, সিলেট ও হবিগঞ্জে, কুমিল্লায় এবং উয়ারী-বটেশ্বরে। একমাত্র বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়া অন্য প্রত্যেকটি অঞ্চলে যতটুকু সন্ধান চালানো হয়েছে, তাতেই পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন।

এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরবর্তীতে বাংলাদেশে নগর-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কিনা? মহাস্থান এক ইউরোপীয়-র (কানিংহাম) আবিষ্কার বলে মহাস্থানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এরা মহাস্থানগড়কে মৌর্যযুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন। এমনকি তারা মনে করেন মৌর্য যুগের আগে বাংলাদেশে আর কোনো প্রত্নস্থান থাকতে পারে না? কাজেই যখন উয়ারী-বটেশ্বরে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়, তখন তারা একে মেনে নিতে পারেন না। অথচ উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর হাতিয়ার, তাম্র-প্রস্তর যুগের বসতি ও বস্তু-নিদর্শন এবং তারো পরের যুগের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। আপনি মেনে নিতে না চাইলে কী করবেন? মাটি যে তার সম্পদ উন্মোচিত করছেই!

বাংলার অবশিষ্ট অংশ- যেটা নব-গঠিত ব-দ্বীপ বলে ফেলনা বলে আমাদের ইতিহাস-চিন্তায় প্রোথিত করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে- সেই অঞ্চলটি কত নতুন? ভূতাত্ত্বিক হোসেন মনসুর এবং আরো অনেকের বইতেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। মাত্র ৬ হাজার বছর আগেও সমুদ্র সৈকত এখন যেখানে আছে, তার থেকে বিশাল ৫ কিলোমিটার দূরে ছিল (অনন্ত দূরত্ব!)। বাংলার ব-দ্বীপ এখন থেকে ৫-৬ হাজার বছর আগেই গঠিত হয়েছিল, একথাই জানাচ্ছেন ভূতাত্ত্বিকরা, তবে বর্তমানের মতো পুরো অঞ্চলটাই যে শুকনো ভূমি ছিল, তা নয়। কিন্তু জাতদেমাগী উপস্থাপনে ওরা আপনাকে বলবে যেন মাত্র গত মঙ্গলবার এই ভূমি জেগে উঠেছিল।

তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই বানরের বাঁশে আরোহনের গল্প ফাঁদা কেন? লক্ষ্য করবেন, এই ঘরানার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তাগণ ভারতবর্ষকে আর্য কর্তৃক সভ্যকরণ তত্ত্ব দেন, যেন আর্যরা না এলে (?) আমরা বর্বর থেকে যেতাম। তারাই পরে বলেন, ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন আমাদেরকে ঐতিহাসিক ভাবে মুক্তি দিয়েছে, আমাদেরকে আধুনিক ও সভ্য করেছে। এদের কেউ কেউ এমনকি পাকিস্তানি শাসনও যে আমাদেরকে অনেক সভ্য করেছে, সেই পর্যন্ত অগ্রসর হন। প্রকৃতপক্ষে শত শত বছর ধরে ইউরোপ সারা বিশ্বে যে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও লুটপাট চালিয়েছে, তাকে বৈধ করার জন্য এবং নিপীড়িত দেশগুলোর মানুষের মনে উপনিবেশের স্মৃতি ও বিরোধিতা মুছে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দেশগুলোর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসকে বিকৃত করে। যেন উপনিবেশ না হলে যে আমরা মানুষ-ই হতাম না। কাজেই সাবেক সকল উপনিবেশ ও আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার মাধ্যমে তারা বর্তমান কালেও যেসব আগ্রাসন ও উপনিবেশিক প্রভাব রয়ে গেছে, তাকে বৈধতা দানের চেষ্টা করে। বর্তমান কালে দেশে দেশে পণ্য, তথ্য, জ্ঞান ও গণমাধ্যমের যে আগ্রাসন চলছে উপনিবেশকে কোমলায়িত করে ও উপনিবেশকে মধুমাখা করে তার বৈধতা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে জড়িত লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপকদের একটি অংশও না বুঝে অথবা ক্ষমতার লোভে এই নব্য-উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

রোবাব রোসানকে এই অবস্থানে আমি একটি পক্ষে ফেলতে চাই। কারো কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন- এমন মতের আমি আগেও বিরোধিতা করেছি, এখনো করছি। তিনি ওই ইউরোপীয় জাতদেমাগি ঘরানার ভাঁজ খেয়েছেন। ওরা তাকে যা বুঝিয়েছে, তিনি সেটুকুকে সত্যি বলে মনে করেছেন। একজন সাংবাদিক সব বিষয়ে জ্ঞানী হবেন, তা আশা করা যায় না। কিন্তু সব মহলের বক্তব্য তুলে ধরবেন, এটা আশা করা যায়। কেবল একটি পক্ষের কথা বলবেন তা কি হয়, বিশেষত যে পক্ষটি আবার বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় একটি জাতদেমাগী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত!

বি.দ্র. ২৭ এপ্রিল ২০০৭ দৈনিক নিউ এজে রোবাব রোসানের একটি প্রতিবেদন বিষয়ে এটা দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া।

No comments:

Post a Comment