Wednesday, July 15, 2009

ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি : বিভ্রান্তিকর শব্দবিন্যাস

আয়োজকরা হয়তো সচেতন ভাবে করছেন না, কিন্তু ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপন আসলে প্রকারান্তরে জনমানসে ঢাকাকে কমবয়সী একটি নগর হিসেবে প্রতীয়মান করছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য অনুসারে ঢাকার বয়স কমপক্ষে ১৭০০ বছর অথবা আরো বেশি।

ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপনের বছরে ঢাকার বয়স প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই ঢাকার বয়স কত-এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রগুপ্তের (৩৩৫-৩৮০ খ্রীস্টাব্দ) এলাহাবাদ প্রশস্তি লিপিসাক্ষ্যটি একবার স্মরণ করেন। কেননা, ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিষয়ে সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত সাক্ষ্য এখনও পর্যন্ত এটিই। এই শিলালিপিটিতে বর্ণিত সমতট জনপদটির একটি নগর হিসেবে "ড্বকা"-র যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিকেই ঢাকা সর্ম্পকে সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ বলে মনে করা হয়।

কুমিল্লা অঞ্চলে প্রাপ্ত অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার, যার বিবরণ দিয়ে গেছেন হিউয়েন সাং (৬০৩-৬৬৪ খ্রীস্টাব্দ), তার ভিত্তিতে কুমিল্লা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলটিকেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক সমতটের সঙ্গে কল্পনা করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রাগুলো (যার বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর) জনপদ হিসেবে সমতটের অবস্থান ঢাকার আরো নিকটবর্তী করে তুলেছে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব হিসেবে সাধারণত মুদ্রার ওজন, আকার এবং প্রতীককে ভিত্তি করে জনপদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এর ভিত্তিতে উয়ারী-বটেশ্বরকে একটি জনপদ এবং একটি সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে প্রমাণ করা যায় (বিস্তারিত জানতে দেখুন EASAA Handbook 2005, University of London)।

সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ লিপিসাক্ষ্যে বর্ণিত ‘ড্বকা’ নগরীকে ঢাকা নামের অপভ্রংশ মনে করা হয়। আর যদি সমতট বর্তমান ঢাকা থেকে বেশি দূরে না হয়, তবে সমুদ্রগুপ্তের "ড্বকা"কেই আমরা বর্তমান ঢাকা বলে মনে করতে পারি। উয়ারী-বটেশ্বরের গবেষণা থেকে সমতট যে ঢাকার অনেক নিকটবর্তী ছিল সেটি একরকম নিশ্চিত।

ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার অভাবে আপাতত আমরা এই তিনটি সম্ভাবনাকে একত্রিত করে, অর্থাৎ এলাহাবাদ লিপিতে বর্ণিত জনপদ সমতট, শহর ড্বকা এবং উয়ারীর মুদ্রা- এই তিন অনুষঙ্গকে মিলিয়ে বলতে পারি, সম্ভবত খ্রীস্টিয় ৩য়-৪র্থ শতকেই ঢাকা একটি নগর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে অর্থাৎ পাল ও সেন যুগেও যে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ একটি নগর ছিল, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। তবে, আমাদের মনে রাখা দরকার, নগর হিসেবে ঢাকাকে কেবল তার বর্তমান সীমারেখার মধ্যে কল্পনা করলে চলবে না। তখনকার যুগে নদীপথ নির্ভরতার কারণে অনেক সময় সুবিধাজনক এলাকায় নগর স্থানান্তরিত হয়েছে। এই বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সাভার এবং ধামরাইকেও ঢাকার মধ্যেই ধরতে হবে।

সুবেদার ইসলাম খাঁ-র ঢাকায় আসার অনেক আগেই ঢাকায় স্থাপিত কমপক্ষে ১৫ টি স্থাপনা এখনও দেখা যায়। এগুলো হলো- সাভারের রাজা হরিশচন্দ্রের ভিটা বলে পরিচিত বিদ্যায়তনটি (৭ম-৯ম শতক), রামপালের বল্লাল বাড়ি (১২শ শতক), বুড়িগঙ্গার তীরে রাজা চাঁদ রায়ের প্রাসাদ এবং মঠ (১৬শ শতক), কাপাসিয়া দুর্গ (১৬শ শতক), কালী বাড়ি (১৬শ শতক), গুরুনানক স্থাপিত কূপ ও মন্দির (১৫শ শতক- বিলুপ্ত), ঢাকেশ্বরী মন্দির (মতান্তরে ১২শ-১৬শ শতক), কেল্লা মোবারকাবাদ (১৫শ শতক), বিনত বিবির মসজিদ (১৫শ শতক), পাগলা সেতু (১৬শ শতক), নাসওয়া গলির মসজিদ (১৫শ শতক), মীরপুরের মাজার ও মসজিদ (১৫শ শতক) (আরো স্থাপনার তালিকা জানতে দেখুন A Guide to Ancient Monuments of East Pakistan by Dr. S.M. Hasan, Society of Pakistan Studies, 1970 এবং বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আ কা মো যাকারিয়া, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৮৪)। এই পনেরটি স্থাপনার বাইরে নারায়ণগঞ্জ (সোনারগাঁও ও বন্দর) এবং মুন্সিগঞ্জের অপর স্থাপনাগুলো ধরলে এই সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাবে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমেও আরো অনেক স্থাপনা পাওয়া সম্ভব বলে আমরা মনে করি, কেননা এখন পর্যন্ত যেখানে খনন হয়েছে সেখান থেকেই প্রাচীনতর স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব স্থাপনা নিঃসন্দেহে নগর হিসেবে ঢাকার প্রাচুর্য ও বিকাশের প্রতিনিধিত্ব করে।

সুবেদার ইসলাম খাঁ-র সুবের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করার দিনটি ইতিহাসের আলোকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐ দিন-তারিখটির উদ্যাপন ইতিহাসের দিকেই আমাদের চোখ ফেরাতে বলে। কিন্তু তা কোনোভাবেই সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে বিয়োজন করে হতে পারে না।


পুনশ্চ: চারশ' বছর পূর্তি হচ্ছে সুবেদার ইসলাম খাঁ-র সুবে-র রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে ঘোষণার। যদিও ঢাকা খুব বেশি দিন সুবে-র রাজধানী থাকেনি, তবু সুবে-র রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে বেছে নেওয়ার কারণে ঢাকা নগরের গুরুত্ব বোঝা যায়। কিন্তু মূল প্রশ্নটা অন্যখানে। এই লেখা পড়ার পর হয়তো আপনারা ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই ধরে ফেলেছেন। সেটি হলো, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যের এক সুবে-র একটি নগরী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করায় তার যদি চারশ' বছর পূর্তি হতে পারে, তবে সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের এক জনপদের নগরী হিসেবে ঢাকার অবস্থানের ১৭০০ বছর পূর্তি কেন হতে পারে না? ইতিহাস তো সমুদ্র গুপ্তকে জাহাঙ্গীরের চেয়ে বড়ো সম্রাট বলেই স্বীকৃতি দেয় এবং জনপদগুলোকেও সুবে-র চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে না। ১৯৯৩ সালে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের সাতশবছর উদযাপনের নামে যারা ইতিহাসবিকৃতির চেষ্টা করেছিলেন, সেই মৌলবাদী শক্তি এখনো সেই চেষ্টাই করছে কিনা, সেটাই মূল প্রশ্ন।


চারশ' বছর হোক, সাতশ বছর হোক, সতেরশ বছর হোক, ইতিহাসের দিকে আরো একটু বেশি সচেতনভাবে এবং আরো নিরপেক্ষভাবে সবাই নজর দিক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment