বাংলাদেশে প্রচলিত প্রত্নতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট আইন কানুন
বাংলাদেশে প্রচলিত প্রত্নতাত্ত্বিক আইনগুলোর মধ্যে ১৯৬৮ সালে প্রণীত ও ১৯৭৬ সালে সংশোধিত পুরাকীর্তি আইন (antiquities act 1968)-টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এই আইনটির কয়েকটি দিক আলোচনা করা হচ্ছে:
- এই আইনে পুরাকীর্তি (antiquity)-র সংজ্ঞা [2(c)] দিতে দিয়ে বলা হয়েছে, যা কিছু প্রাচীন, সেটাই পুরাকীর্তি। আর প্রাচীন (ancient)-এর সংজ্ঞায় [2(b)] বলা আছে, যার বয়স একশ’ বছর বা তার চেয়ে বেশি তা-ই প্রাচীন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এবং সাংস্কৃতিক ও জাতিতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দুষ্প্র্রাপ্য কিন্তু একশ’ বছরের চেয়ে কম বয়সী নিদর্শনও পুরাকীর্তি হিসেবে সংগৃহীত, সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হওয়া উচিত। আইনানুগভাবে এইসব নিদর্শনকে পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত না করলে এবং এখনই সংরক্ষণ না করলে একশ’ বছর পর এসব অনন্য নিদর্শন খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
- 2(g)-এ অস্থাবর পুরাকীর্তির সংজ্ঞায় কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করা হয়নি, এমনকি পূর্বে ব্যবহৃত প্রাচীন শব্দটিও এখানে ব্যবহৃত হয়নি। ফলে কোন ভবনটি পুরাকীর্তি হবে আর কোন ভবনটি হবে না, তা নির্ধারণ পুরোপুরি একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।
- 2(h)-এ পুরাকীর্তির মালিক (owner) বলে একটি ধারা যুক্ত হয়েছে যেখানে মালিকের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, ৫ ও ৬ নং ধারায় পুরাকীর্তির মালিকানা ও মালিকবিহীন পুরাকীর্তির ক্ষেত্রে মালিক অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পুরো আইনের কোথাও মালিককে কেন দরকার অথবা মালিকানাধীন পুরাকীর্তির কী হবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। এই সমস্যাটি দেখা গেছে আইনের আরো কয়েকটি ক্ষেত্রেও। যেমন, ধারা ৯-এ বলা হয়েছে লাইসেন্স ছাড়া পুরাকীর্তি বেচা-কেনা বেআইনী, কিন্তু কেউ যদি বেচাকেনা না করে প্রত্নসম্পদ নিজের সংগ্রহে রাখে অথবা দান বা উপহারের মাধ্যমে পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে এবং নিজ জিম্মায় রাখে তাহলে সেক্ষেত্রে কী হবে? একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি জাদুঘর ও সংগ্রহশালাগুলো সম্পর্কেও। আমাদের দেশের বিভিন্ন জাদুঘর, ব্যক্তিগত সংগ্রহ, ধ্বংসাবশেষ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ধর্মীয় ভবনে অসংখ্য পুরাবস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশ, সীমান্ত প্রহরী এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মালখানায়ও আছে অসংখ্য পুরাবস্তু। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে আবিষ্কৃত এবং সংগৃহীত পুরাবস্তুর সংখ্যা বিপুল। এই বিপুল বিশাল সংগ্রহ সম্পর্কে কোনো দিক-নির্দেশনাই অ্যান্টিকুইটি অ্যাক্টে নেই। কোনো ব্যক্তির কাছে যদি কোনো পুরাকীর্তি থাকে এবং যদি তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক যদি জ্ঞাত হন, তখন তিনি ঐ নিদর্শনটিকে অ্যান্টিকুইটি অ্যাক্টের ১০ (১) ধারা অনুসারে সংরতি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে সরকারি গেজেট প্রকাশ করবেন। ঐ গেজেটের একটি কপি ঐ পুরাকীর্তির মালিককে দেয়া হবে। এই আইনের ১২ (১) ধারা অনুসারে, অতঃপর যদি ঐ মালিক মনে করেন, পুরাকীর্তিটির সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে যৌথ অভিভাবকত্বের জন্য চুক্তি করতে পারেন। পুরাকীর্তিটির সংরক্ষণের জন্য অধিদপ্তরের পরিচালক পুরাকীর্তির মালিককে সময় সময় নানা ধরনের (আর্থিকসহ) সহযোগিতা করবেন (ধারা ১৫(১))। ১৫ (১) নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য এর মালিক যদি সরকারের কাছে অনুদান চান তাহলে উক্ত দান যেন কোনোভাবেই এক হাজার টাকার বেশি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বহু বছরের পুরনো এই আইনের সীমাবদ্ধতা হলো এই আইনে ব্যক্তিগত সংগ্রাহক বা মালিকানাধীন পুরাকীর্তির জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ খুবই কম।
- ১৫ নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তির জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে অর্থাৎ ১৮৯৪ সালের (1 of 1894) ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসরণ করা হয়, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথাযথ ও পরিপূর্ণ নয়। ফলে কোনো প্রত্নস্থানের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ জনগণ সেই প্রত্নস্থানের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কাজে একাত্ম হতে পারে না এবং প্রত্নস্থানের লুন্ঠন, ক্ষতি সাধন প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
- ক্স অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ১৬ ও ১৭ নং ধারায় ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরাকীর্তির অধিগ্রহণ ও রণাবেণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতা খর্ব করা হয়েছে। আমাদের মনে হয়, ধর্মপালনে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে সংরক্ষণ করবেন এবং সংরণের স্বার্থে অধিগ্রহণ করবেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মীয় স্থানসমূহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি বিশেষ বোর্ড দ্বারা পরিচালিত ও সংরক্ষিত হতে পারে।
- ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ১৯নং ধারায় বলা হয়েছে, যেসব পুরাকীর্তিকে ১২ নং ধারা অনুসারে সংরতি পুরাকীর্তিরূপে ঘোষণা করা হয়েছে সেসব পুরাকীর্তির ধ্বংস সাধন, ক্ষতিসাধন, পরিবর্তন সাধন, লেখা বা খোদাই করা যাবে না। এরূপ অপরাধের জন্য যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তা হলো ১ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা বা উভয় দন্ড। কিন্তু এ যাবৎকাল পর্যন্ত এই আইন কার্যকর হওয়ার কোন দৃষ্টান্ত আমাদের জানা নেই। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, যেসব পুরাকীর্তিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, সেসব পুরাকীর্তি ধ্বংস করা, ক্ষতিসাধন করা, পরিবর্তন সাধন ইত্যাদি বিষয়ে কোনো দিক-নির্দেশনা নেই।
- ২১ নং ধারা অনুসারে, পরিচালকের অনুমোদিত লাইসেন্স না নিয়ে কোনো ব্যক্তি পুরাকীর্তি বেচা-কেনা করতে পারবে না। এই আইন থেকে বোঝা যায়, অনুমোদিত লাইসেন্স নিয়ে পুরাকীর্তি বেচা-কেনা করা যাবে। আমরা মনে করি, লাইসেন্স নিয়ে হোক বা না নিয়ে হোক, কোনো ভাবেই প্রত্নসম্পদ বেচা-কেনা করা যাবে না। প্রত্নসম্পদ দেশের সম্পদ, জাতির পরিচয়। সুতরাং তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হবে।
- ২২ (১) নং ধারা অনুসারে পরিচালকের অনুমোদিত লাইসেন্স ব্যতিরেকে সকল ধরনের পুরাকীর্তি বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ। ২২ (২) নং ধারা অনুসারে পুরাকীর্তিসমূহ আবগারী আইনের ১৬ ধারায় রপ্তানি নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বস্তুসমূহের কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা না থাকায় কাস্টমস অফিসারদের পক্ষে একজন বর্হিগামী যাত্রী বা লাগেজ থেকে পুরাকীর্তি নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পরে। কোনো বর্হিগামী যাত্রী কোনো ঐতিহ্যবাহী বস্তু এদেশ থেকে কিনে বিদেশে নিয়ে যেতে চাইলে পণ্যটি যে পুরাকীর্তি নয়, এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছ থেকে একটি ছাড়পত্র নেন। প্রচলিত পদ্ধতিটি হলো, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক একটি কাগজে বা একটি ছবির পেছনে লিখে দেন ‘এটা পুরাকীর্তি নয়’। এক্ষেত্রে ফাঁকটি হলো, কোনো ব্যক্তি যদি একটি পুরাকীর্তির রেপ্লিকা নিয়ে আসেন এবং ঐ রেপ্লিকার ছবির পেছনে যদি অধিদপ্তরের পরিচালক ‘পুরাকীর্তি নয়’ লিখে দেন এবং ঐ ব্যক্তি যদি এরপর রেপ্লিকা রেখে মূল বস্তুটি নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির হন, তখন কাস্টমস অফিসার কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের ছাড়পত্রকে সম্মান দেখিয়ে বস্তুটিকে ছাড় করে দেন। এভাবেই পুরাকীর্তি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কাস্টমস অফিসারদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অথবা বন্দরগুলোতে পুরাকীর্তি বিষয়ে বিশেষ শাখা/কর্মকর্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ২৪ নং ধারায় খনিজ আহরণ ও পাথর (পাহাড়) কাটা বিষয়ক যে বিধির উল্লেখ করা হয়েছে তাতে শুধু সংরতি পুরাকীর্তি বা জ্ঞাত প্রত্নস্থানের ক্ষেত্রে খনিজ আহরণ, পাথর কাটা, উৎখনন, বিস্ফোরক ব্যবহার করে উৎখনন, ভারী যানবাহন চলাচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপের কথা বলা হলেও উপরোক্ত কাজের জন্য লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের কোন প্রয়োগ আছে বলে জানা নেই। বিশেষ করে, সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের অজ্ঞাতসারে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায় এশিয়া এনার্জি যে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তা সুস্পষ্টভাবে এই আইনের লঙ্ঘন। এশিয়া এনার্জি ছাড়াও অন্যান্য সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে তেল-গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধানের জন্য ব্যাপকভাবে যে খনন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রত্নস্থানের পাশ দিয়ে যে ভারী যানবাহন চলছে, তা এই আইনটির অকার্যকারিতা প্রমাণিত করে। এতদসংক্রান্ত আইনের ধারায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল ও হাস্যকর। এখানে বলা হয়েছে যে, এই আইন লঙ্ঘনকারীকে ১ বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু কথা থেকে যায়। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্নস্থানের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে যে অপূরণীয় তি হয় তা কি এই সামান্য শাস্তি দিয়ে পূরণ করা সম্ভব!
- ২৬ নং অনুচ্ছেদে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি বা তার অংশবিশেষের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু হরহামেশাই জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ সাধারণ দর্শক ও গবেষকদের আলোকচিত্র গ্রহণে বাধা দিয়ে থাকেন। আমরা মনে করি, প্রত্নসম্পদের যথাযথ আলোকচিত্র ও রেপ্লিকা তৈরি করে বহুল প্রচার করলে প্রকারান্তরে তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা এবং জাতীয় সম্পদের প্রতি আগ্রহকেই বৃদ্ধি করবে। এমনকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও পুরাকীর্তির রেপ্লিকা তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আইন ১৯৮৩-তেও জাতীয় জাদুঘরের কার্যাবলিতে রেপ্লিকা তৈরি করা ও তার প্রচারের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই আইনের আলোকচিত্রও গ্রহণ সংক্রান্ত ধারাটি এমনকি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্যও নানা জটিলতার সৃষ্টি করে।
No comments:
Post a Comment