১৮৫৮ সালের ২০ নভেম্বর। পণ্যবাহী এক জাহাজ এসে ভিড়লো কলকাতা বন্দরে। জাহাজে অনেক মালপত্রের সঙ্গে ছিলেন স্কট বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ উইলিয়াম। গ্লাসগো থেকে ভাগ্যান্বেষণে জাহাজে চেপেছেন। ব্রিটিশসিংহ তো বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই দেয়নি, বঙ্গলক্ষ্মী যদি দয়া করেন। বাংলা দেশের তুলা বিশ্ববিখ্যাত, খোদ আলেকজান্ডারের সভাসদরা কাপাসিয়ার কার্পাস তুলার গুণ গেয়েছেন। এখানকার মিহি তুলার মসৃণ সুতায় বোনা মসলিন পড়েন স্বয়ং ক্লিওপেট্রা।
উইলিয়াম ডানকান সেই তুলার কারবারই শুরু করলেন আরেক ব্রিটিশ প্যাট্রিক প্লেফেয়ারের সাথে। ১৮৫৯ সালে ভাই ওয়াল্টার ডানকানকেও নিয়ে এলেন। দুই ভাই আর প্যাট্রিক মিলে শুরু করলেন তুলার কারবার। কোম্পানির নাম হলো মেসার্স প্লেফেয়ার, ডানকান ব্রাদার্স এন্ড কোং, মোকাম ৬৪ ক্লাইভ স্ট্রিট, কলিকাতা।
ক্লাইভ স্ট্রিটের যে বাড়িতে অফিস, ওই একই বাড়িতে আরেক কামরায় বসে চায়ের ব্যবসা করতেন চার্লস লেকি নামের আরেক ইংরেজ। ভারতবর্ষে সবে চায়ের চাষ শুরু হয়েছে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায়। যুদ্ধের জন্য চীনা চায়ের রপ্তানি বন্ধ, এদিকে ব্রিটিশদের বেড টী ছাড়া ঘুমই ভাঙ্গে না। কাজেই হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ আর হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাস করে চায়ের উৎপাদন শুরু হলো ভারতবর্ষে- সিলেটে। সরকারি অনুকম্পা ও আতিশয্যে চার্লসের চায়ের কারবার রমরমা।
১৮৬০ সালের শেষ দিকে চিকিৎসার জন্য বছর খানেকের জন্য বিলেত যেতে হলে ভদ্রলোক ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান ডানকান ভাইদের। সেবারই চায়ের ব্যবসার সাথে ওদের পরিচয়। চার্লস ফিরে এলে ফের শুরু শুধুই তুলার ব্যবসা।
ইত্যবসরে বাংলার তাঁতশিল্পে কোস্পানির থাবা পড়েছে, তা চলছে মহারাণীর আমলেও। মসলিন তাঁতীদের হাত কেঁটে দেয়া হচ্ছে, তুলাচাষীদের বাধ্য করা হচ্ছে নীলচাষে। তুলা ব্যবসায়েও রমরমা ভাব মলিন হচ্ছে। সে ঝড়ের ঝাপটা ডানকান ভাইদের গায়েও লাগলো। ১৮৬৯ সালে ওয়াল্টার ব্যবসা ছেড়ে চলে গেলেন গ্লাসগো। বনিবনা না হওয়াতে প্যাট্রিকের সাথেও যৌথ ব্যবসা টিকলো না, আলাদা হয়ে গেলেন ১৮৭৪ এর ডিসেম্বরে।
মড়ার কলিকাতায় পড়ে রইলেন একা উইলিয়াম, যেভাবে একাই নেমেছিলেন কলকাতা বন্দরে। আর পড়ে রইলো নামসর্বস্ব নতুন কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্স এন্ড কোং। ঠিকানা সেই ৬৪ ক্লাইভ স্ট্রিট (পরে নামকরণ করা হয় নেতাজী সু্ভাষ বোস সড়ক)।
কয়েক বছর তুলা চালাচালি করে হঠাৎ প্রতিবেশি চার্লসের চায়ের ব্যবসার কথা মনে পড়লো। ১৮৮০ সালে ছোট লাটের কাছে কিছু জমির আবদার করলেন, উদ্দেশ্য চা বাগান করবেন। সরকার ভাগ্যবিড়ম্বিত যুবকের অনুরোধ রাখলো, চায়ে সরকারের অতিশয় ভক্তি কিনা! সিলেটের মাধবপুর এবং আশেপাশের এলাকায় পাঁচ হাজার (প্রকৃত আয়তন ৫৮০৬.৯৮ একর) একর জমি অধিগ্রহণ করে দেয়া হলো। সাথে উপহার দেয়া হলো শ্রমিকশোষক আইন, গিরমিট চুক্তি। অর্থাৎ শ্রমিক বংশানুক্রমে শুধু কাজই করে যাবে, কোনো মাইনে পাবে না বললেই চলে।
উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্য হলে যে কোনো ব্যবসাই লাভজনক হতে বাধ্য। আর সে লাভের গুড়ের টানে গ্লাসগো থেকে ওয়াল্টারও উড়ে এলেন মৌমাছির মতো। ডানকান ব্রাদার্স সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মহীয়ান হলো। ৩০ বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার একর জমি পঞ্চাশ হাজার একরে পরিণত হলো, সরকার বাহাদুর একের পর এক জমি অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ ভাইদের দিলেন।
১৯৪৭ সালে সদাশয় ইংরেজ সরকার ভারত শাসনের ভার আর বইতে পারলেন না, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের হাতে দুই দেশ তুলে দিয়ে পালালেন। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। কাজেই হোক ইংরেজ, পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশদের তাড়ালেন না, অধিকৃত জমি আর ব্যবসা যেমন যেমন ছিল, তেমনই রইলো। একাত্তরে পাকিস্তানও গেল, বঙ্গবন্ধু দেশজুড়ে সবই প্রায় জাতীয়করণ করলেন। কিন্তু রাখে খোদা মারে কে, ডানকান ভাইরা রয়ে গেলেন। ১৯৭২ সালে অধিকৃত জমি লীজের মেয়াদ নবায়ন করা হলো।
সব চলছিলো ভালই। গোল বাঁধলো ২০১৫-তে এসে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে করা নির্বাচনী অঙ্গিকার মতো আওয়ামী লীগ চাইছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে, দেশজুড়ে লাখো ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়া সাড়ে সাতশো ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবি এটি। শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, আলাদা শিল্পাঞ্চলও চাইছেন তারা। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা চান আলাদা মুদ্রণ শিল্পাঞ্চল, সফটওয়্যার ব্যবসায়ীরা চান আলাদা সিলিকন ভ্যালী ইত্যাদি। সব করা না গেলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়তো সম্ভব। সে মতেই হবিগঞ্জে ডানকানকে লীজ দেয়া পাঁচশো একর জমির (প্রকৃতপক্ষে ৫১১.৮৩ একর) লীজ বাতিল করে সে জমি সরকার ফিরিয়ে নিয়েছেন। কোম্পানিও তা মেনে নিয়েছে হৃষ্টচিত্তেই, সাড়ে ঊনপঞ্চাশ হাজার একর তো রইলো এখনো!
বিপদে পড়েছে চা-শ্রমিকরা। চা বাগানে যারা গিয়েছেন, শ্রমিকদের ঘরে, চিলতে উঠোনে দু'এক সপ্তাহ থেকেছেন, তারা জানেন, বাগানের পাশে এক ধরনের ঘেটোর মধ্যে থাকেন শ্রমিকরা। এ জীবনযাপনকে মোটেই মানবেতর বলা যাবে না। ওতে মানবেতর শব্দের অবমান হয়। ফার্মের পশুরা তো বিলাসী জীবনযাপন করে, ওদের কথা আলাদা, গৃহস্থ বাড়ির গরুছাগলও থাকে না- এমন বাড়িঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকে চা-শ্রমিকেরা। শুনে হেসে খুন হবেন, এরই মাঝে শ্রমিকের বাচ্চারা স্কুলে যায়, ফুটবল খেলে, নাটক করে, গান গায়। যেবার তথ্যচিত্র করতে গেলাম দীপা নামের চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হলো, সে সিলেট বিভাগীয় নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পুরো টুর্নামেন্ট সিলেটকে ডিফেন্ড করেছে সে, চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সিলেট। কিন্তু এখন দীপাকে ডিফেন্ড করার কেউ নেই। ওরা যে ঘরে থাকে সেখানকার জমি সরকার নিয়ে নিয়েছে। পঞ্চাশ হাজার একর জমির মধ্যে ডানকান শুধু সেই পাঁচশো একর জমিই ছাড়লো যেখানে শ্রমিকদের আবাস। সরকারের ভাষায়, "ওই জমিতে চা চাষ করার কথা থাকলেও, ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি পুরো জমিতে তা করছে না।" (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫)।
গৃহহীন দীপাদের আওয়াজে আসল কথাটিও কেউ কেউ বলছেন- শ্রম শোষণ। গিরমিট চুক্তি এখন আর না থাকলেও শ্রমিকরা আছেন ওই একই প্রথায়। পৃথিবীর কোনো স্বাধীন, সভ্য দেশে এমন কোনো প্রথা থাকতে পারে? গার্মেন্টেসে কমপ্লায়েন্সের অভিযোগে ব্রিটিশ মডেল বাংলাদেশি কাপড় খুলে ছুড়ে দেন, প্রতিবাদের মিছিলে টিভিতে বাইট দেন, তারপর? বাড়ি ফিরে ডানকান চায়ে গলা ভেজান? কিংবা অন্য কোনো কোম্পানির, যা বাংলাদেশ থেকেই গেছে। কই কোনোদিন গরম চায়ের পেয়ালা উইলিয়ামের মুখে ছুঁড়ে মারতে পারলেন না তো! আন্তোনিও হাসেন্তির কথা মনে পড়ে? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? কিংবা সব্যসাচীর আবৃত্তি?
"সেই বিরাট খামারটাতে কখনো বৃষ্টি হয় না
আমারই কপালের ঘাম দিয়ে গাছগুলোকে
তৃষ্ণা মেটাতে হয়
সেখানে যে কফি ফলে, আর চেরি গাছে
যে টুকটুকে লাল রঙের বাহার ধরে
তা আমারই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, যা জমে কঠিন হয়েছে
কফিগুলোকে ভাজা হবে, রোদে শুকোতে হবে,
তারপর গুড়ো করতে হবে
যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের গায়ের রঙ হবে
আফ্রিকার কুলির গায়ের রঙের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ
আফ্রিকার কুলির জমাট রক্তে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।"
আফ্রিকার কফি আর সিলেটের চা-- শ্রমিকের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
ও, বলতে ভুলে গেছি- দীপা নাটকও করে। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে, "আপনি নাটক বানাইলে আমাকে বলবেন, আমি অভিনয় করবো"। আমিও মজা করে বলি, তুই অভিনয় করবি কিরে, তুই তো ঠিকঠাক বাংলায় কথাই বলতে পারিস না। ওর অনুযোগ, "কেন, পাতর (পাত্র) ভাষায় নাটক বানাবেন।" আমি বললাম, বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষা বাংলাদেশের মিডিয়া এমনকি সরকারও অনুমোদন করে না, চাকমা ভাষায় করা অং চাকমার অনুদানের সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছে জানিস না?
দীপারা যেদিন চ্যাম্পিয়ন হলো, সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরেছে ভারতের কাছে। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় চার কলাম ছবি, তিন কলাম খবর; খেলার পাতায় পুরো আট কলামই মুশফিকদের দখলে। খেলার দ্বিতীয় পাতার একদম শেষ খবরটি দীপাদের- এক কলাম দেড় ইঞ্চি। হারুক জিতুক প্রথম আলো পুরুষ ক্রিকেটের সঙ্গে আছে, তারপরেও তো দেড় ইঞ্চি দিয়েছে, অন্য কাগজে তাও নেই।
তাই দীপাদের আন্দোলনের খবরও মিডিয়াতে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও ওদের সাথে নেই। আমি ইকোনোমিক জোনের পক্ষের লোক, এ নিয়ে টিভিতে অ্যাডভোকেসি মার্কা প্রোগ্রামও করেছি, এখনও করছি। কিন্তু সেটা মরার বসতভিটা আর সামনের খোলা জায়গাটুকুতে কেন, যেখানে ফসলের মৌসুমে ওরা খানিক চাষ করে আর শুকনো মৌসুমে দীপারা ফুটবল খেলে, নাটক করে। ম্যানেজারের বাংলো, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলোর আশেপাশে সবমিলিয়ে এরচে' ঢের বেশি জায়গা পড়ে আছে।
তারও বড় প্রশ্ন- চা বাগানে শ্রম শোষণ থামবে কবে?
আমিও খিস্টান হতে ছই
ReplyDeleteআমিও খিস্টান হতে ছাই যোগাযোগের নাম্বার ০১৩২২৪৯৮৪৯২
ReplyDelete