Friday, February 5, 2016

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল বিতর্ক প্রসঙ্গে

যমুনা সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচির মূল্যায়ন-সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পে আমি কিছুদিন কাজ করেছি। তখন দেখেছি, সিরাজগঞ্জের হাটীকুমড়ুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত যে রাস্তাটি হয়েছে, সেটির নকশায় কয়েক দফা পরিবর্তন আনা হয় প্রভাবশালীদের বাড়ি/জমি রক্ষার জন্য।

ঢাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করতে গেলে প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ক্যান্টনমেন্ট আর বিডিআর। মাঝে মাঝে অন্য কেউ যদি ওদের মতোই দাপট দেখায়, ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ দর্শক হিসেবে সেসব দেখতে মজাই লাগে।

যেমন ধরুন, মেট্রোরেল প্রকল্প।

আরো দশ বছর আগেই হয়তো মেট্রোরেল হয়ে যেতো যদি দাতা সংস্থা জাইকার সাথে সরকারের আলোচনা আরো গতিশীল হতো। উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়ার স্বাভাবিক রাস্তা হলো এয়ারপোর্ট বনানী হয়ে। স্বাভাবিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ রুটেই মেট্রোরেল করতে জাইকার আগ্রহ ছিল, কিন্তু উত্তরপাড়ার জাঁদরেল বাবুদের সরকার সেই রুটে রাজি করাতে পারেনি। এ নিয়ে টানাপোড়েনে চলে গেছে কয়েক বছর। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতাও বেড়েছে। মেট্রোরেলের প্রধান অর্থ জোগানদাতা জাইকাকেও শেষাবধি উত্তরের কাছে হার মানতে হয়েছে।
প্রভাবশালীদের দাপটে উত্তরা থেকে মিরপুর পল্লবী আগারগাঁও হয়ে ঘুরপথে যে মেট্রোরেল হচ্ছে তা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হোঁচট খেয়েছে।

দর্শক হিসেবে বলতেই হচ্ছে, ‘বিষম মজা’!

তবে যেসব যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে মেট্রোরেলের বিরোধিতা হচ্ছে তা অনেকটাই হাস্যকর।

যেমন একজন লিখেছেন, “অন্য রেললাইনের মত টিএসসির পাশেও কাঁচা বাজারের দোকান বসবে, টিএসসির নাম হবে তখন টিএসসি বাজার, সদরঘাটের কাছে হওয়ায় এ বাজারে মাছের দর কম থাকবে”।

কেউ কেউ অবশ্য এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্ট এবং হিস্টোরিকাল ইমপরট্যান্স সার্ভে রিপোর্টের রেফারেন্সসহ যুক্তি দিয়েও আপত্তিগুলো তুলে ধরছেন।

পত্রপত্রিকায়, অনলাইনে, ফেসবুকে এবং সাধারণ আলোচনায় সবমিলিয়ে মোটামুটি তিনটি আপত্তি দেখা যায়-
এক. শব্দদূষণ ও কম্পন, দুই. ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্থাপনার ক্ষতি, তিন. ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ঝুঁকি।

শব্দদূষণ এবং কম্পনের ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের রুট নিয়ে করা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে নেতৃত্বদানকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হকের একটি উক্তিকে রেফারেন্স হিসেবে হাজির করা হয়। তিনি বলেছেন, “শাহবাগ থেকে টিএসসি, কার্জন হল- এই এলাকাটা ইনস্টিটিউশনাল এরিয়া। এখানে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। এখান দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যেতে হলে সাউন্ড প্রুফ ও ভাইব্রেশন কন্ট্রোলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে রাজু ভাস্কর্যসহ যে সব স্থাপনা আছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি ভেঙে যেতে পারে।” (বিডিনিউজ, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬)

‘সতর্কতা অবলম্বন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের রুট নেওয়া হলে কোনো ক্ষতি হবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক মোজাম্মেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাউন্ড প্রুফ ও ভাইব্রেশন মিনিমাইজ করলে তা হবে না”।’

মোটামুটি এটা যে কোনো পাগলেও বোঝে- শব্দ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণ না করে নির্মাণ কাজ করা হলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো স্থাপনারই ক্ষতি হতে পারে।

এবং এখানেই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন- আপনাদের শব্দ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কী?

প্রযোজক কাজল আবদুল্লাহ যেভাবে বলেছেন, “যে যাই বলুক, একফোটা শব্দ হবে না বা শব্দে এদের সমস্যা হবে না। এটা আমি মানতে রাজি নই”, আমি সেভাবে বলতে চাই না। যুক্তিসঙ্গত, বিজ্ঞানগ্রাহ্য সমাধান থাকলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, পাবলিক লাইব্রেরির পেটের ভেতর দিয়েও মেট্রোরেল চালিয়ে নিতে রাজি আছি। পৃথিবীর বহু দেশেই বহুতল ভবনের ভেতর দিয়ে পর্যন্ত মেট্রোরেল গেছে, সেসব ছবি আজকাল ফেসবুকে বেশ দেখছি।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল কোনো বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রী এবং সরকারের কেউ কেউ জনসভায় কিছু কথা বলছেন, যার অর্থ মেট্রোরেল চুপি চুপি ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে চলে যাবে, কেউ টেরটিও পাবে না।

আবার সরকারের সমর্থক কিছু অ্যাক্টিভিস্ট এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টকে ধরে পরিবেশের (শব্দ ও কম্পন) ক্ষতি ন্যূনতম রাখার ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের ব্যবহৃত ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম বা এমএসএস পদ্ধতিটিকে সামনে হাজির করছেন।

দুই পক্ষের সম্মানজনক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে আগ্রহবশত এ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করলাম। পৃথিবীর প্রথম দিককার মার্ক্সিস্ট পার্টি জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের বিখ্যাত নেতা Hans Georg Wagner, যিনি একজন বিজ্ঞানী এবং জার্মানির স্থপতি ও প্রকৌশলীদের নেতাও বটে, তার একটা লেখা পেয়ে গেলাম। খুবই সহজ ভাষায় লেখা এ প্রবন্ধে তিনি বলছেন, "With well designed, low-tuned floating trackbeds, high vibration attenuation levels can be reliably achieved. Supported on steel springs, long slabs or troughs provide advantages in terms of construction, installation and performance. Several applications are shown. The springs are generally accessible. They allow the fast and easy readjustment of deviated track levels. Being fatigue-proof and provided with an excellent anti-corrosion system, the springs are designed to a long lifetime".
শুধু তা-ই নয়, তিনি মোটামুটি অঙ্ক কষে দেখাচ্ছেন ট্রেনের গতি এবং স্প্রিংয়ের আকারের ওপর নির্ভর করে শব্দ ও কম্পন মাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আরো যারা আগ্রহী তারা ২০০৮ সালে প্রকাশিত Noise and Vibration Mitigation for Rail Transportation Systems edited by Burkhard Schulte-Werning, David Thompson, Pierre-Etienne Gautier, Carl Hanson, Brian Hemsworth, James Nelson, Tatsuo Maeda, Paul de Vos বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অনলাইনে বিনামূল্যেই বইটি পড়তে পারবেন।

কিন্তু আমি বা আপনি এসব বই পড়লে শুধু আমাদের জ্ঞানই বাড়বে। ঢাকা মেট্রোরেলে কী প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো উত্তর মিলবে না।

উত্তরটি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। তাদের জানাতে হবে, কোন্ প্রযুক্তি, কীভাবে তারা ব্যবহার করবেন এবং এটি করলে আসলে কী ক্ষতি হবে কিংবা হবে না।

আর, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা নষ্টের বিষয়টি আপেক্ষিক। রাজু ভাস্কর্য ঐতিহ্য নাকি টিএসসি? টিএসসির সামনে রাজু ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করে টিএসসির ঐতিহ্য, নান্দনিকতা নষ্ট করা হলো কেন? এসব প্রশ্ন থাক।

আমার কাছে মেট্রোরেল বলতেই মনে পড়ে কুড়িল ফ্লাইওভারের বিশালত্ব, মগবাজার ফ্লাইওভারের কর্মযজ্ঞ। যদিও মেট্রোরেল এর চেয়ে অনেক কম জায়গা নিয়ে চলবে এবং এর পিলার ও লাইনের প্রস্থও হবে অনেক কম। কিন্তু সেই কম জায়গাটুকু কতো? তিন ফুট? ছয় ফুট? দশফুট? শাহবাগ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাতের ওপর দিয়েই যদি মেট্রোরেল চলে যায় আমি তো টেরও পাবো না ওপরে কিছু আছে। কিন্তু তা যদি ফ্লাইওভারের মতো ঢাউশ হয়, তবে তা ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে, এমনকি পাশ দিয়ে নিয়ে যেতেও আমার আপত্তি আছে।

মোদ্দাকথা, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে পষ্ট করতে বলতে হবে, রেললাইনের প্রস্থ আসলে কতো? এর পিলারগুলো কতো চওড়া হবে এবং সেগুলো কোন্ কোন্ পয়েন্টের ওপর দিয়ে যাবে আর তার উচ্চতাই বা কী। বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই সারা দেশেরই ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক স্থাপনার দর্শনদারিতে অনেক ক্ষতি উন্নয়নের নামে আমরা নিজেরাই করেছি, উন্নয়নের “স্বার্থে” আরো কিছু ক্ষতি মেনে নিতেও আমরা প্রস্তুত, কিন্তু কতোটা?

তৃতীয়ত, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ঝুঁকি। রেললাইনের পাশে মাছের আড়ত বসলে কিংবা ছিন্নমূল মানুষের বস্তি গড়ে উঠলে নিরাপত্তা আসলেই হুমকির মুখে পড়বে। তবে এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব চিন্তিত নই। কোনো ফ্লাইওভারেই এখন পর্যন্ত মাছের আড়ত বসেনি, বস্তিও হয়নি। উচ্চতার কারণেই সম্ভবত কারওয়ান বাজার বা গুলিস্তান হয়ে ওঠেনি ফ্লাইওভারগুলো। আর মেট্রোরেলের প্রস্থ এবং উচ্চতা কোনোভাবেই সম্ভবত এ ধরনের সম্ভাবনা অনুমোদন করে না। শাহবাগে বাস স্টপেজ থাকলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে না পড়ে, তাহলে মেট্রোরেলের স্টপেজেও পড়বে না।
তবে দোয়েল চত্বরের পাশ দিয়ে শাহবাগের মতো গণপরিবহনের গতায়ত কম। কাজেই সেখানে জনসমাগম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। যদিও দোয়েল চত্বরে স্টপেজ থাকলে বইমেলাগামী মানুষের জন্য তা ভালই হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলায় লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ হলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে না পড়ে তাহলে দোয়েল চত্বরে স্টপেজ থাকলেও সম্ভবত হবে না। উপরন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং সদরঘাটের যাত্রীদেরও উপকার হবে। তবে সরকার চাইলে এই স্টপেজটি দোয়েল চত্বরে না করে আরেকটু এগিয়ে হাইকোর্ট মাজারের সামনে করা যেতে পারে। যদিও প্রেস ক্লাবের সামনে পরবর্তী স্টপেজটি সেক্ষেত্রে অনেকটাই অর্থহীন হয়ে যায়।

অর্থাৎ সব আলোচনার আগের কথা হলো- সরকারের প্রতিক্রিয়া, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য। প্রকল্পের শুরুতেই এ বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা এবং জনমত গঠন প্রয়োজন ছিল। সে নিয়ে একটি কমিটি এবং আলাদা বরাদ্দও ছিল, যতোদূর জানি। কিন্তু সুবিধান্বেষী ডিগবাজ মার্কা এক্সপার্টদের দিয়ে যেমন কোনো কাজ হয় না, এই কমিটিও যে তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি, এখনকার অবস্থা তার একটি প্রমাণ।

No comments:

Post a Comment