ডেন্টাল ভাস্করের প্রকৃত নাম ভাস্কর নিবেদন। লাল সালু আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী বলে তার নাম ভাস্কর নিবেদন, নাকি তিনি নিবেদন শব্দটি বেশি উচ্চারণ করেন বলে এই নাম, নাকি এটি তার মাতৃপিতৃপ্রদত্ত নাম, তার কিছুই আমি জানি না। ক্যাম্পাসে আসার পর আমি জেনেছি, তিনি চলে যাচ্ছেন। মানে তার পড়ালেখা শেষ, সুতরাং কয়েকবছরের মধ্যেই তিনি ক্যাম্পাস ত্যাগ করবেন। একজন বিদায়ী কমরেডের নাম-রহস্য উদ্ঘাটন না করে বরং তার কাছ থেকে তার মহোত্তম গুণাবলি অর্জনের চেষ্টাই অধিকতর ফলদায়ী বলে চলমান কমরেডরা পরামর্শ দিলেন।
তার গুণ-রহস্য জানার চেষ্টায় প্রথমেই জানতে পারলাম, তিনি এক মহান দন্ত-বিশারদ। টুথপেস্ট এবং ব্রাশ এ দুটি পণ্য পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক বলে তিনি এই সমস্ত ব্যবহার করেন না। মার্কস ও এঙ্গেলসের মন্ত্রণাগ্রন্থসমূহে দন্তের কোনো মন্ত্র না থাকায় প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব জ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমেই দন্ত-যত্ন-সমস্যার সমাধান করতে হবে, এটিই ছিল তার মত। প্রকৃতির অন্য সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ দাঁতের যত্নে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, মানুষকেও সেই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিই গ্রহণ করতে হবে।
পরে অবশ্য আমি জেনেছি, শেষ দিকে ভাস্কর নিবেদন-এর অপর দু’একটি নাম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, সেগুলো হলো ফোম ভাস্কর, বাবল ভাস্কর ইত্যাদি। কেননা শোনা যায়, বুদবুদ বা ফেনোদ্গম করে (যেমন- টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি) এমন সকল পুঁজিবাদী পণ্যের বিরুদ্ধেই নাকি তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।
শঙ্কু ও শমী বিষয়ক রুদ্ধদ্বার বাহাস যখন ভেতরে চলছিল, হঠাৎ দরোজায় বিকট শব্দে লাথি-ঘুষির শব্দে আমরা চমকিত হলাম। শত্রুলীগ বা শত্রুদলের কে এই অকস্মাৎ আক্রমণ করলো- এই বিষয় নিয়ে কমরেড ন্যান্সি এবং কমরেড পত্তর-এর মধ্যে কিছুটা বিবাদের পর কমরেড মাসুমবাচ্চা দরজা খুলে দেওয়াই শিশুসুলভ কাজ হবে বলে রায় দিলেন। যে কোনো ব্যাপারে শিশুরাই সবচেয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত দিতে পারে বলে কমরেড মাসুমবাচ্চা মনে করেন। তবে বাচ্চা শব্দটি শিশুবান্ধব হয় না বিধায়, কমরেড বাচ্চু বলে তার বিশেষ খ্যাতি ছিল।
এবং ডেন্টাল ভাস্কর। দরজায় দাঁড়িয়েই তিনি নিবেদন করলেন- ‘বিভিন্ন মহল থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে যেসব তথ্য আমার কাছে নিবেদিত হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, এই বিষয়ে আমার কিছু নিবেদন রাখা দরকার’। তিনি আরও নিবেদন করলেন- যেহেতু উভয় কমরেড দৃষ্টিপাত শাস্ত্রের শিক্ষার্থী এবং তিনি নিজেও দৃষ্টিপাত বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সুতরাং এই সমস্যায় তার দৃষ্টি নিবেদন অত্যন্ত জরুরি।
দরজার কাছাকাছি কেদারাসমূহে যেসব কমরেডরা বসেছিলেন, তারা সমস্বরে হাঁচতে হাঁচতে দ্রুত কমরেড নিবেদন-এর জন্য আসন ছেড়ে দিলেন এবং নিজেরা একযোগে দূরবর্তী কমরেড কুদ্দুসের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিষয়টি অস্বস্তিকর দেখালেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এর কোনো বিকল্প ছিল বলে আমার মনে হয় না।
কুদ্দুস পুনরায় মুখ খুললেন- হ্যা শঙ্কু, তুমি বলো- পত্তর অথবা ন্যান্সির সাথে কালুভবনের সামনে বসে না থাকে, কেন তুমি শমীর সাথে বসে থাকো?
কমরেড পত্তর বললেন- এই বিষয়ে শঙ্কুকে একটি কারণদর্শানোর চিঠি দেওয়া হোক।
কুদ্দুস বলেই চললেন- বুঝলাম, তোমরা উভয়েই কালু অনুষদের শিক্ষার্থী, উভয়েই দৃষ্টিপাত বিভাগে একই বর্ষে পড়ো, কিন্তু তাই বলে কালুভবনের সামনে কেন তোমরা একসাথে বসে থাকবা? লাল সালু আন্দোলনে ব্যক্তিবাদের কোনো জায়গা নাই, তোমার যদি কোনো বিশেষ বোধ জাগে, সেই বোধ তুমি ন্যান্সির সাথে আলাপ করো, পত্তরের সাথে আলাপ করো। একটি অষ্টাদশী শিশুর সাথে তোমার আলাপের রহস্য কি? এটি তো শিশু নির্যাতনের সামিল।
পত্তর বললেন- শিশু নির্যাতন বিষয়ে শঙ্কুকে কারণ দর্শানোর জন্য একটি চিঠি দেয়া যেতে পারে।
বাচ্চু এই পর্যায়ে বললেন- এটিকে আপনারা শিশু নির্যাতন না বলে, শিশুদের সাথে সখ্য-ও বলতে পারেন, এবং তাতে আমি তো দোষের কিছু দেখি না।
নূরুল কুদ্দুস হুংকার দিয়ে উঠলেন- কারো ব্যক্তিগত দেখা না দেখা দিয়ে তো আর লালখাতা বাধাই হয়নি। কোটি কোটি বছর ধরে মানুষ তিলে তিলে যে স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্নের দেনাপাওনার হিসেবনিকেশ ওই খাতায়। কোটি কোটি বছর ধরে নির্মিত সেই লালখাতার আমরা ধারক ও বাহক। ব্যক্তিগত ভাললাগা, মন্দলাগা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা এইসব পুঁজিবাদী চিন্তা থেকে আমাদেরকে কোটি কোটি হাত দূরে থাকতে হবে। তুমি একজন মহারাজ হয়ে এমন মহাপাপ করতে পারলে কিভাবে?
এতোক্ষণে আমার বোধোদয় ঘটলো, শঙ্কুর পুরো নাম তো শঙ্কু মহারাজ। তবে কি একদা তিনি অন্য কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন? তাই কি এতো প্রশ্ন? আমাদের রাজ্যে এসেছেন আমাদের রাজকন্যা হরণ করতে? কমরেড কুদ্দুস কতকটা তেমনই ইঙ্গিত দিলেন। এরপর তিনি একে একে বলতে লাগলেন, কি কি পাপাচার তারা করেছে। এক সাথে এক বাসে করে সুদূর ঢাকা পর্যন্ত তারা ভ্রমণ করেছে এবং এই দীর্ঘ ৬* ঘণ্টার ভ্রমণে তারা পাশাপাশি সীটেও হয়তো বসেছে। এবং এটি কি ইঙ্গিত বহন করে? কমরেড চীৎকার করে জানতে চাইলেন- আদিম বিকৃতির প্রকাশ নয় এটা?
পটকা ফাটানোর মতো চীৎকার শুনে ভয়ে, নাকি কথা শুনে লজ্জায়, কেন জানি না এই পর্যায়ে শমী ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল।
*১৯৯৭-৯৯ সালে আরিচা রোড সংস্কারের কারণে ঢাকায় যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগতো।
*** বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই উপন্যাসের ৭ম/৮ম পর্বগুলো সচলে খসড়া আকারে লিখে রেখেছিলাম, আমার নিজের ভুলে না সচলের ভুলে জানিনা, সেগুলো ডিলিট হয়ে গেছে; নতুন করে লেখার কোনো আগ্রহই পাচ্ছিলাম না। ঠাকুরগাঁওয়ে এই মুহূর্তে আমি একটু বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছি, অন্যরা কাজ করছে; কিন্তু আমি অসুস্থতার ভাণ করে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছি। আর সকলেই তো জানেন- অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।
No comments:
Post a Comment