ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে তৈরি মসজিদটিকে মুঘল আমলের তৈরি বলে মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি নির্মিত হয় আরও অনেক পরে। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় বঙ্গাব্দ ১৩১৭ সালে। স্বভাবতই প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম, মসজিদটি হয়তো ১০০ বছরেরও কম সময় আগে নির্মিত। কিন্তু নির্মাণকারী মেহের বক্শ সরকার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এবং মসজিদটির দেয়ালের কিছু অংশ খোলার পর বেরিয়ে আসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। প্রথমত, মসজিদের নির্মাতা মেহের বক্শ সরকারের কবরেও তার মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা আছে ১৩১৭ সাল। মেহের বক্শের মৃত্যুর সময়েই যদি মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে (যেমনটি স্থানীয় মানুষেরা আমাদের বলেন), তবে তা কোনোভাবেই ১৩১৭-এ নির্মিত হতে পারে না। মেহের বক্শ এর পরিজনরা আমাদের জানান, মেহের বক্শ মসজিদটি নির্মাণ করার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি নিয়ে আসেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্তির আগেই স্থপতি মারা গেলে মসজিদের কাজ থেমে যায়। বেশ কয়েক বছর স্থগিত থাকার পর, মেহের বক্শ স্থানীয় নির্মাতাদের নিয়ে নিজেই মসজিদের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু শেষ করার আগেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। এ পর্যায়ে আরো কয়েক বছর মসজিদের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। মেহের বক্শের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারো উদ্যোগ নেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নির্মাণকাজ সমাপ্ত না করেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় মানুষ এবং মেহের বক্শ-এর পরিবারের কাছে এভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যায় যে, এই মসজিদটি সম্পন্ন হবার নয়, কেননা এটিতে অশুভ ছায়া রয়েছে। কাজেই শতাধিক বছর ধরে পরিত্যক্ত হয়ে জনমানসের আড়ালে বৃক্ষ ও শ্বাপদের আশ্রয়ে পরিণত হয়। এই তথ্য থেকে মনে হয়, মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগেই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। অপর দিকে, সংরক্ষণ কাজের অংশ হিসেবে ফাটল ধরেছে এবং আলগা হয়ে পড়েছে এমন একটি অংশকে আমাদের খুলে ফেলতে হয়েছে। দেয়ালের যে অংশটি খোলা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মসজিদের ১১ ইঞ্চি গভীরে অলঙ্করণবিহীন হুবুহু একই নকশার একটি স্থাপনা। পুরো মসজিদেই এই ১১ ইঞ্চি দেয়ালের ভেতরের স্থাপনাটি আছে, যা পূর্ববর্তীকালের নির্মিত। শুধু তাই নয়, এই ভেতরের স্থাপনাটির ইটের আকৃতি, গঠন এবং মর্টারের সাথে পরবর্তীতে নির্মিত ইটের আকৃতি, গঠন ও মর্টারের পার্থক্য রয়েছে। স্পষ্টই এই দুয়ের নির্মাণকালের পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে। তবে তা কতো আগের তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই তথ্যসমূহ মিলিয়ে আমরা মসজিদটির প্রাক্কলিত বয়স নির্ধারণ করেছি, ১২০ বছর। তবে (ব্যয়বহুল বলে) বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স এই ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি।
মেহের বক্শ-এর মৃত্যুর পর যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং প্রচলিত মিথ ও ভীতির কারণে মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি অথবা এটিকে কোনো রকম যত্ন-আত্তিও করা হয়নি। অযত্ন-অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে মসজিদের বিভিন্ন অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমগ্র দেয়াল জুড়ে পাকুড় ও অন্যান্য জাতের গাছপালা, মস, শৈবাল, ছত্রাক রয়েছে, নোনা ধরেছে এবং ফাটল রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মসজিদ উপকরণের অপব্যবহার এবং খোঁচাখুঁচি ও ঝাঁকানোর কারণেও মসজিদটি তিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় ইট ক্ষয়ে গেছে, আলগা হয়ে গেছে, কোণা ভেঙ্গে গেছে অথবা ফেটে গেছে। ছাদের লেবেলে কয়েকস্তর ইট খুলে পড়ে গেছে। মর্টারের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষনীয়। অনেক জায়গায় মর্টার ক্ষয় হয়ে ইট খুলে পড়েছে। গাছের শিকড়ের কারণে প্রায় সব অলঙ্করণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং যেগুলো টিকে আছে তা-ও দেয়াল থেকে আলগা হয়ে আছে। অলঙ্কৃত স্তম্ভগুলোতেও ফাটল ধরেছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্তম্ভসহ দেয়ালের ওপর থেকে নিচ বরাবর লম্বালম্বি ভাবে ফেটে গেছে।
ইট ও মর্টারের ফাঁকে এবং দেয়ালের ফাটলে বসতি স্থাপন করেছে সাপ, বিছা, চিকা, শেয়াল, খাটাস, মাকড়সা, টিকটিকি, পিঁপড়া ও নানা ধরনের পোকামাকড়; আর স্কুইঞ্চগুলোতে কয়েকটি মৌচাক।
এই রকম একটি অবস্থাতেই আমাদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে পুনঃনির্মিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। বাংলাদেশে বিজ্ঞানসম্মত প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে এটি একটি। বলা বাহুল্য অপর উদ্যোগগুলোও আমাদেরই। (চলবে)
No comments:
Post a Comment