Sunday, November 15, 2009

সারমেয় সমাচার

১.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটমেন্ট কখনো ছিল না, এটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়াচাড়া করার লাইসেন্স পাওয়ার ফলে আমি ধারণা করেছিলাম, প্রতিপক্ষকে ট্যাকল করার কৌশলে তারা কিছু বদল আনবে। কিন্তু কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, আওয়ামী লীগের সারমেয়-স্বভাবেরও তেমনি কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রভুদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মাত্র কুকুরের মতো ঝাপিয়ে পড়ার আওয়ামী লীগের পুরনো কৌশল আবারো দেখা গেল আজ।

২.
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম(?)-এর যে কি অবস্থা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র মন্ত্রী-নেতারাই তা খোলাশা করেছেন। তাদের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপস, অডিও টেপ এবং জবানবন্দীমূলক চিঠিপত্র এখনো ইন্টারনেটে সার্চ করলে পাওয়া যায়; ওইগুলোতে স্পষ্ট করেই নেতারা তাদের শীর্ষনেত্রী ও অন্যান্য নেতাদের দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, কবে কার কাছ থেকে কিভাবে ঘুষ নিয়েছেন, চাদাবাজি করেছেন, দুর্নীতি করেছেন, সবকিছুই দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার।

৩.
তারপরেও আমি আশা করেছিলাম, কৌশলে পরিবর্তন আসবে। প্রভুদের বিরুদ্ধে মিছিল দেখলেই দাঁত-নখ বেরিয়ে আসবে, এটা আশা করিনি। পেট্রোবাংলার সামনে গেলে আনু মুহাম্মদ কি করতেন? পেট্রোবাংলায় পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতেন? আমি তো জানি, আনু মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা পেট্রোবাংলাকে পছন্দই করেন; বিদেশী কোম্পানীগুলোকে কাজ না দিয়ে বরং পেট্রোবাংলাকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হোক, এটাই তো তারা চেয়েছেন। সুতরাং আনু মুহাম্মদকে লাঠি দিয়ে না ঠেকালেও হতো। তিনি পেট্রোবাংলার সামনে গেলে আসলে কিছুই হতো না, অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ওখানে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে কিছু বক্তৃতা-টক্তৃতা করতেন এবং একটা নতুন কর্মসূচি দিতেন। খুবই সাধারণ ব্যাপার হতো এটা। কিন্তু হলো না, তার কারণ- রাষ্ট্র।

৪.
আনু মুহাম্মদ-এর ওপর হামলাকে আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলেই মনে করি। প্রথমত, খুবই সাধারণভাবে বলি- আনু মুহাম্মদের ছাত্রজীবন, শিক্ষকতা, লেখালেখি এবং রাজনীতি বরাবর বাংলাদেশের মানুষের পক্ষেই থেকেছে। তিনি আমার কাছে তাই রাষ্ট্রের প্রতীক। ফলে তার প্রতি হামলাকে আমি বাংলাদেশের প্রতি হামলা হিসেবে মনে করি। স্বাভাবিকভাবেই আমি মনে করি, আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ এবং যে পুলিশ ও তাদের নির্দেশদাতা আমলা-রাজনৈতিক এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া উচিত।

৫.
কিন্তু আসলে সেটা হবে না। কারণ রাষ্ট্রের কলকাঠিওয়ালারা ঠিক এইভাবে ভাবেন না। রাষ্ট্র বলতে উনারা বোঝেন উনাদের ক্ষমতা। রাষ্ট্র বলতে কিন্তু আসলে ক্ষমতাটিই বোঝায়। সেই ক্ষমতা হলো- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মোটেই গণতান্ত্রিক নয় এবং এর সংবিধানের অনেক জায়গাতেই গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তা আছে। আওয়ামী লীগ যদিও ভোটের আগে এগুলো নিয়ে কিছু কিছু কথা বলেছে, কিন্তু এখন ভুলে গেছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ হলো, বাংলাদেশের শাসকদল ও গোষ্ঠী রাষ্ট্র বলতে বোঝেন ক্ষমতার ব্যবহার। যে ক্ষমতা জনগণ এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ভূমি ও সম্পদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা, সেই ক্ষমতাকে বিদেশি কোম্পানী ও বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করাটাকেই কেউ কেউ রাষ্ট্র বলে মনে করে।

৬.
বাংলাদেশের জ্বালানী ক্ষেত্র বিষয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একবার দুর্নীতি মামলা হয়েছিল, সেই মামলা থেকে তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে খারিজ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে (২৪ অগাস্ট) তিনি আবার তাল্লু এবং ফিলিপসকে ৫, ১০ ও ১১ নং ব্লক বরাদ্দ দেন। সেই পুরনো কাসুন্দি। বাংলাদেশ পাবে ২০ ভাগ, কোম্পানী পাবে ৮০ ভাগ। আর এই ৮০ ভাগ আবার বাংলাদেশকে কিনতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারদরে। কার্যত, গ্যাসের খনি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে চড়াদামে গ্যাস কিনতে হবে বাইরের কোম্পানির কাছ থেকে। যেন স্বর্ণকারের কাছে গয়না বানানোর জন্য সোনা দেয়ার পর এখন আন্তর্জাতিক দরে ৮০ ভাগ সোনার দাম দিতে হচ্ছে। এমন অসম চুক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। অন্তত গুগলে সার্চ দিয়ে আমি খুঁজে পাইনি।

৭.
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সংজ্ঞা অনুসারে শেখ হাসিনার এই কাজ দেশপ্রেমিকমূলক। কেননা দেশের স্বার্থেই তার সবকিছু করার কথা। দেশদ্রোহীমূলক কোনো কিছুই তিনি করতে পারবেন না, এই শপথ তিনি নিয়েছেন। "রাজা যখন অন্যায় করেন, তখন তিনি আর রাজা থাকেন না" রবীন্দ্রনাথের এই কথা অনুসারে হয় তিনি তার কর্তৃত্ব হারিয়েছেন অথবা তিনি দেশপ্রেমমূলক ও ঠিক কাজটিই করেছেন।

৮.
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমের যে কি হাল, তা আগেই একবার বলেছি। বর্তমান কাজটিও যদি ওই রকমই কিছু হয়ে থাকে, তবে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপদজনক। কেননা সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুসারে এর ফলে রাষ্ট্রটি আসলে খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, বস্তুত ভাঙ্গা। তার পরেও আনু মুহাম্মদের কাজটিকে কেন আমি দেশপ্রেমমূলক বলছি এবং তার ওপর হামলাকে দেশদ্রোহিতা বলছি? তার কারণ আমি এই চুক্তিটিকে যৌক্তিক ও হিতকর মনে করি না- তা নয়। তার চেয়েও বরং এই কারণে আরো বেশি যে, রাষ্ট্র কখনো আসলে শূন্য থাকে না। আনু মুহাম্মদ সেই শূন্যস্থান পূরণ করে একটি দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তই রেখেছেন।

৯.
তাই বলছি, আনু মুহাম্মদের ওপর হামলাকারী পুলিশ এবং নির্দেশদাতা আমলা ও রাজনীতিকেদর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন।

ছবি- রানা রায়হানের ফেসবুক অ্যালবাম থেকে

No comments:

Post a Comment