বখতিয়ার খলজি (আসলে ইখতিয়ার খিলজি)-র ‘বঙ্গবিজয়’ বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল মিনহাজ-ই-সিরাজ রচিত তাবকাত-ই-নাসিরি; এই গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক বলছেন- ‘এই গ্রন্থের তথ্যসমূহ একেবার নির্ভুল, অকাট্য ও প্রামাণ্য, কেননা এখানে সরাসরি সেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যিনি এই কাহিনী শুনেছেন তার নানার কাছে এবং তার নানা এটি শুনেছেন সেই ব্যক্তির কাছে, যার সাথে দেখা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তির যিনি বখতিয়ার খলজির কোনো এক অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন’। এতোই প্রামাণ্য সেই ইতিহাস!
রাজকুমারের সোনালী রঙের চামড়ার ব্যাগটার ভেতর কী কী জিনিস আছে, তা নিয়ে আমার জানা বৃত্তান্ত অনেকটা তাবকাত-ই-নাসিরির মতোই, পরম্পরায় শুনেছি ওই ব্যাগের ভেতর নাকি রাজকুমার সাপ পুষতেন, প্রয়োজনের সময় সাপের বিষ জিবের ডগায় নেয়ার জরুরত ছিল। রাজকুমার নিজেও ওই ব্যাগের সাবধানতা বিষয়ে যারপরনাই সচেতন ছিলেন। আমি একবার কি একটা জিনিস খুঁজতে কাছে গিয়ে ওই ব্যাগ ছোঁয়ামাত্র রাজকুমার তেড়ে আসলেন, ব্যাগের ভিতরে কি আছে না জেনে ব্যাগ খুলতে যাস কোন্ সাহসে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং তারপর বৃত্তান্ত শুনে সন্তর্পণে ব্যাগের এক কোণা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আরো সন্তর্পণে জিনিসটা বের করে আনলেন। প্রত্যক্ষদর্শীর মনে হবে, সত্যিই হয়তো ব্যাগের ভেতরে সাপখোপ আছে, না হলে এতো সাবধানতার কারণ কী? আমার সন্দিগ্ধ মন অবশ্য বলে, প্রায় দুই দশক ধরে ব্যবহারের কারণে ব্যাগের চেইনের অবস্থা ছিল শোচনীয়, ফলে একবার খোলা হলে তা লাগাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় বলে রাজকুমার যারপরনাই সতর্কতার সাথে ব্যাগের চেইন খোলা-লাগানোর কাজ করতেন এবং অন্য কাউকে ব্যাগ খুলতে দিতেন না। এবং সেই সাথে ফুটনোট দিয়ে দিচ্ছি, রাজকুমার সম্পর্কে যদি কেউ কখনোও কোনো অভিযোগ আনেও রাজকুমার অলস ছিল, এই অভিযোগ কেউ আনতে পারবে না। ফলে আলস্যের কারণে ব্যাগের চেইন বদলানো হয়নি, ব্যাপারটা তা না। আসলে ব্যাগের চেইন সারানোর মতো ১৫ টি টাকা হয়তো রাজকুমারের হাতে কখনো আসেনি। যদি আসতোও তা দিয়ে যে সে কি করতো তা খোদাই মালুম, কেননা মাত্র ১ টাকা পকেটে নিয়ে এই লোক ঢাকা থেকে ইন্ডিয়া ভ্রমণ করে এসেছেন। সেই গল্পেই যাচ্ছি।
রাজকুমার আর আমি ছাড়াও তখন আমাদের বাড়িতে গরু, ছাগল, বাঞ্ছিত কুকুর ও অবাঞ্ছিত বিড়াল, কবুতর এবং হাঁসের পাশাপাশি একগাদা মোরগ-মুরগিও ছিল। বাড়িতে ডিম খাওয়ার মানুষ নেই দেখে সেই ডিম ফুটে ফুটে বাচ্চা হতে হতে মুরগির পাল-ও হয়েছিল বিশাল। একটা মোরগ তো আমার ঘরেই থাকতো, প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত এবং সন্ধ্যা হলে গৃহপ্রবেশ। মজার ব্যাপার ছিল, ওই মোরগটা কখনও আমার ঘর নোংরা করেনি, লক্ষ্মী ছেলের মতো বসবাস করতো। (এই গল্প পরে অন্য একদিন বলবো)
রাজকুমার আমাকে বললেন, জন্মান্তর হলে মুরগির বাচ্চা হবো রে!
-বাচ্চা? কিন্তু বাচ্চা তো চিলে নিয়ে যায়।
-আরে, মা আছে কি করতে? চিল তো চিল, স্বয়ং ***** আসলেও...। বাচ্চা নেওয়ার সময় মুরগির রি-অ্যাকশন দেখছিস?
-রি-অ্যাকশন দেখে কি হবে? বাচ্চা যদি নিয়েই যায়?
-আরে, সবসময় মুরগির পাখনার নিচে লুকিয়ে থাকবো রে!
-কিন্তু বড়ো তো হয়ে যাবা, রাজকুমারদা!
-আরে না, বড়ো হবো ক্যান্? বাচ্চা হয়েই থাকবো। ভগবানের যদি জন্মান্তর-দানের ক্ষমতা থাকে, চিরকাল তবে বড়ো হতে না দেওয়ার ক্ষমতা-ও থাকা উচিৎ।
বাবরি মসজিদ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডকারখানার পর রাজকুমার পরিবার ভিটেমাটি ও চাষাবাদের জমিজমা বিক্রি করে মামার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলো, দেশমাতা নাকি জন্মদাত্রী মা এই বিতর্ক রাজকুমারের মনে এসেছিলো কিনা জানিনা, তবে তরুণ রাজকুমার তখন বাবা-মা-পরিবার-আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে ইন্ডিয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং সেই থেকে বাংলাদেশে ভূমিহীন, পরিবারহীন এক সংখ্যালঘু পরিণত হলেন।
কিন্তু প্রায়ই রাতের বেলা রাজকুমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে মা বলে চেচিয়ে দেশমাতৃকা না মা দুর্গা না জন্মদাত্রী মাতা, কার কথা ভাবতেন এটা বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি বলে, পকেটে এক টাকার একটা কয়েন নিয়ে একদিন শাহবাগ থেকে রওনা হলেন রাজকুমার। অনেকেই হয়তো জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর আসতে বাসভাড়া লাগে এক টাকা। ভক্ত-বন্ধুদের খাতিরে পকেটের এক টাকা পকেটে রেখেই রাজকুমার ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছুলো এবং তারপর শুরু করলো মানিকগঞ্জ যাবার ভাড়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান, বেশি না মাত্র ১০ টাকা হলেই শুভ যাত্রা বা নবীনবরণে মানিকগঞ্জ যেতে পারে। জন্মভূমিতে শৈশবের বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আরো ১০-১৫ টাকা ম্যানেজ করে আরিচা ঘাট, পদ্মা পেরুলেই রাজবাড়িতে আত্মীয়ঘর। সেখান থেকে কিছু জোগাড় করে কোনো মতে ঝিনেদায় গোলাম রসুলের কাছে যেতে পারলেই সে-ই বেনাপোল হয়ে বর্ডার পাড় হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। অদূরপ্রসারী পরিকল্পনা উপস্থাপনের কৌশলে শামীম, বিশ্বসহ কতিপয় ভক্তঅনুরাগী তার সাথে আরিচা ঘাট পর্যন্ত রওনা হলো; একটা ভ্রমণ-ও হলো, রাজকুমারেরও একটা গতি হলো। আরিচা ঘাটে রাতের আড্ডা সেরে শামীমরা ক্যাম্পাসে আর রাজকুমার পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মায়ের দর্শনে চললো। আমরা শুনেছি, বর্ডারের গ্রামগুলোতে তাকে ২-৩ দিন থাকতে হয়েছিল এবং কোনো কোনো সময় তাকে একটানা ২৪ ঘণ্টাও হাটতে হয়েছিল। এবং প্রথমবার মামাবাড়ি গিয়ে সে দূরে দাঁড়িয়ে তার মায়ের কাছে খবর পাঠায়- রাজকুমার এসেছে। দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের কারণে বাবার প্রতি যে ক্ষোভ ছিল তার, তা প্রথমবার ভারতভ্রমণে প্রকাশ করে রাজকু বাবার সঙ্গে দেখা না করে। মায়ের সাথে ১ ঘণ্টার মতো দেখা করে আবার যে পথে গমন ওই পথেই প্রত্যাবর্তন করে ক্যাম্পাসে। গোলাম রসুল তাকে ব্যাপক সাহায্য করেছে বলে শুনেছি। তবে, এই রীতিতে ভারতভ্রমণের ক্ষেত্রে এরপর সে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে, এমনকি পকেটে কোনো টাকা না থাকলেও তার পক্ষে ইন্ডিয়া গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসাটা পানির মতো সহজ কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। তবে সর্বশেষ ইন্ডিয়া গমন তার দীর্ঘস্থায়ী, সবুজ বাঘের ভাষায় “পরচিম বঙ্গের ডুয়ার্সের চাবাগানে হে নাকি আমোদেই আছে। কুলি কামিনগো নগে চা পাতা ছিড়ে আর মদ গাঞ্জা খাইয়া সাধুর নগাল পইড়া থাকে”।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি, তুমি কি শেষ পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা হতে পারলে রাজকুমারদা?
No comments:
Post a Comment