Sunday, November 15, 2009

বাংলাদেশের স্থাপত্য সংরক্ষণের হালচাল

বাংলাদেশে স্থাপত্য (মনুমেন্ট) সংরক্ষণের ব্যাপারটা একেবারেই ঘোলাটে প্রক্রিয়ায় চলছে। কয়েক ধরনের ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন এই সংরক্ষণ। প্রথমত, সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তাদের নিজেদের কোনো স্থপতি নেই, এবং সাধারণত তারা স্থপতি ভাড়াও করে না। তাদের কোনো কনজারভেটর নেই এবং সাধারণত কনজারভেটর ভাড়াও করে না। কী সব কনজারভেশন হচ্ছে, তা পাহাড়পুর, ময়নামতি এমনকি বাগেরহাটেও এবিসি লেখা ইট দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন। নকশার যে কি বারোটা বাজিয়েছে, তা নিয়ে অনেক গণমাধ্যমের মধ্যে ডেইলী স্টারেরটা আমার কাছে বেস্ট, ওখানে দেখা যাচ্ছে, আগে যেখানে স্থাপত্যটির চারটি দরজা ছিল, এখন সেখানে হয়ে গেছে তিনটি।

পানাম সিটি সংরক্ষণের আগে ও পরে

পানাম সিটি সংরক্ষণের আগে ও পরে

আরেক দল সংরক্ষণ করছেন, উনারা মূলত স্থপতি এবং প্রকৌশলী। প্রধানত বুয়েটের দখলে এর বাজার, তবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পাস করা শিক্ষার্থীরাও আছেন। উনাদের একজন (নাম বলছি না, কারণ উনাকে অন্তত এই ব্লগের প্রায় সবাই চেনে) সেদিন আমাকে বললেন, "তুমি কি বলো এইসব? আমি তো দোতলা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের ওপর চারতলা বসিয়ে দিয়েছি, কোনো সমস্যা হয় নাই।" নির্মাণ প্রকৌশলের দিক থেকে হয়তো সমস্যা হয় নাই, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে সমস্যা হয়েছে। যে মনুমেন্টটি দোতলা করে বানানো হয়েছিল, সেটিকে সংরক্ষণের নামে চারতলা বানানো আসলে বিকৃতিরই নামান্তর। উনাদের দলের সমস্যার প্রধান কারণ হলো- তাদের দলে ইতিহাসবিদ বা প্রত্নতাত্ত্বিক অথবা সংরক্ষকদের কোনো জায়গা নাই।
(ছবি আছে, কিন্তু দেখাচ্ছি না, বেশি গোমর ফাঁস করে ব্যবসা নষ্ট করতে চাই না)
তৃতীয় যারা সংরক্ষণ করছে, তারা হলো আমরা। আমি নিজে কনজারভেটর, তবে তার চেয়েও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক। আমাদের দলে তাই আমরা বিশেষজ্ঞ সংরক্ষক রেখেছি। রেখেছি মানে আমরা একসাথে মিলেই কাজটা শুরু করেছিলাম। সমস্যা হলো, আমাদের দলে বিশেষজ্ঞ স্থপতি বা প্রকৌশলী নেই, যারা আছেন, তারা ৪/৫ বছর আগে পাশ করেছেন, এখনো তেমন যশ নেই। এই পোস্টটাই দিতাম না যদি তাদের যশ থাকতো। আজকে সকালে একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে হয়েছে, যেখানে ওই ডিসিপ্লিনগুলোর বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। উনাদের সাথে আমার যে কথোপকথন হয় তা হুবুহু তুলে ধরছি-

- তোমাদের সাথে বিশেষজ্ঞ স্থপতি এবং প্রকৌশলী রাখোনি কেন?
- স্যার, এটাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়।
- খরচ বেশি পড়লে তোমরা তোমাদের ক্লায়েন্টদের কাছে বিল করো।
- স্যার, আমি তো ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেই না, আমরা বিনা পয়সায় কাজ করি; বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্টরা তো স্যার বিনা পয়সায় কাজ করতে চায় না।
- তোমরা তো এভাবে মার্কেট নষ্ট করছো, একে তো কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে না, অন্যদিকে... ইত্যাদি ইত্যাদি।

উনাদের কথার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, সেটি হলো, সত্যিই মনুমেন্ট কনজারভেশনের জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ স্থপতি/প্রকৌশলীদের সাথে বিশেষজ্ঞ কনজারভেটরদের আর প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা সমন্বয় দরকার। গত ২/১ বছর ধরে আমরা সেটার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সমস্যাটা টাকার ক্ষেত্রে, আমরা যেমন বিনা দ্বিধায় দেশের ঐতিহ্য দেশের ঐতিহ্য বলে ডিপিএস ভাঙ্গিয়ে ভবন রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়ি, স্থপতি বা প্রকৌশলীরা তেমনটি করতে পারেন না। তাদের কাজের বাজার আমাদের কাজের বাজারের তুলনায় ভালো বলেই এটা হচ্ছে। সেই সাথে জ্ঞান ডিসিপ্লিনের এলিটিক জায়গাও আছে কিছুটা। এতো এলিট একটা ইউনিভার্সিটিতে এতো এলিট একটা ডিসিপ্লিনে পড়ে আমি কিনা ঝোপজঙ্গলে তাবুর ভিতরে পড়ে থাকবো???? আমাদের সাথের এক প্রকৌশলী তো পোকার কামড়ে (পোকা বিষয়ে আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম) অসহ্য হয়ে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে চলে গেছেন।

যেমনটি বলছিলাম, গত ২ বছরে আমাদের নড়াচড়ার ফলে আমরা কিছু অদ্ভূত অদ্ভূত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। একটা বলি, সমন্বিতভাবে কাজ করার কারণে আমরা প্রায়ই ছাড় দিয়ে কাজ করি। ছাড়ের মাত্রা এমন হয়েছে যে, একটা ভবন সংরক্ষণে যে বাজেট করা হয়েছে, তার ১ শতাংশ রাখা হয়েছে আমাদের দলের জন্য অর্থাৎ সংরক্ষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য এবং ৯৯ শতাংশ রাখা হয়েছে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের জন্য। তা সত্ত্বেও আমরা হাসিমুখেই কাজটা করে যাচ্ছি, তবু যদি সমন্বয় হয়।

সত্যি বলতে কি, ইউরোপে এমনকি ইন্ডিয়াতেও মনুমেন্ট কনজারভেশনের জন্য আলাদা ডিসিপ্লিন-ই আছে, এই ডিসিপ্লিনের নাম বিল্ডিং কনজারভেশন অথবা আর্কিটেকচার কনজারভেশন। সাধারণত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা আর্কিটেকটার বিভাগের শিক্ষার্থীরা এটি পড়েন এবং অন্য ডিসিপ্লিন (এমনকি আর্কিওলজি) থেকেও কেউ পড়তে চাইলে তাকে এক বা দুই বছর স্থাপত্য বিষয়ে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়। আমাদের দেশে এই বিষয়টি পড়ানো হয় না, বুয়েটে আর্কিটেকচার কনজারভেশন বলে একটা বিষয় আছে, এবং সেই বিষয়ে শিক্ষক-ও আছেন, কিন্তু গত চার বছরে সেখানে মাত্র একজন ছাত্র ওই কোর্সটি নিয়েছিলেন। আমরা যারা দেশ বিদেশ থেকে কনজারভেশনে ডিগ্রি নিয়েছি, আমরা ওই ২ বছরের ফাউন্ডেশন কোর্সের ভয়ে (অথবা অহেতুক কেন সময় নষ্ট করবো ভেবে) সাধারণ কনজারভেশনেই পড়াশোনা করেছি। এর ফলে একটি ভবনকে কেটে টুকরা টুকরা করে দিলে আমি সেটিকে সংরক্ষণ করতে পারি ঠিকই, কিন্তু একটি স্থাপনার দাঁড়িয়ে থাকার কারিগরি বিষয়টি আমি জানি না। আর সেজন্যই আমাদেরকে প্রকৌশলী ও স্থপতিদের শরণাপন্ন হতেই হয়।

শেষ করে দেই, অনেক বড়ো হয়ে গেল। একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি কখনো গুগলে বাংলাদেশের স্থাপনা সংরক্ষণ বিষয়ে সার্চ দিয়েছেন। একবার দিয়ে দেখুন। একগাদা খবর পাবেন। আমি একবার ১৭টা ভবন সংরক্ষণের খোঁজ পেয়েছিলাম, বলা বাহুল্য সবগুলোই করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিংবা স্থপতি অথবা প্রকৌশলীরা। আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছি, সবগুলো ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যের ব্যাপারটি ওভারলুক করা হয়েছে। এই ব্লগে যারা স্থপতি বা প্রকৌশলী আছেন, তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, নিজেরা না পারলেও অন্তত জুনিয়রদের আর্কিটেকচার কনজারভেশন বিষয়টি পড়তে উৎসাহিত করুন। কারণ, না পড়েও উনারা কাজ ঠিকই করছেন, পড়ে করাটাই ভালো নয় কি? আর আমরা যারা প্রত্নতত্ত্ব বা কনজারভেশন পড়ছি, আমাদের জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা, সেটি নিয়ে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেখা যাক কি হয়।

*****অনেক দ্রুত লিখলাম, বাস ছেড়ে দিবে। অনেক ভুলভ্রান্তি রয়ে যেতে পারে, ক্ষমা করলে বাধিত হবো।*****

No comments:

Post a Comment