Sunday, November 15, 2009

আমার ডলফিনগুলো-১

শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম আমার। শৈশব কেটেছে ওই নদীকে কেন্দ্র করেই। বৃষ্টি হলেই কেন যেন নদীটা টানতো আমায়। সবার অলক্ষ্যে একটা পানশি অথবা কোশা (কুশা) নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম নদীতে। জাল থাকতো নৌকাতেই, না হলে নিয়ে যেতাম সঙ্গে করে। তারপর জাল ফেলে মাছ ধরা। তখন মাছ-ও পাওয়া যেত বেশ। জাল ফেললেই মাছ। পুটি আর ছোট চিংড়ি পেতাম বেশ। তবে অন্য মাছ-ও পেতাম। এমনকি রুই কাতলা বোয়ালের মতো পোষা মাছ-ও পাওয়া যেত। একবার তো বিরাট একটা কালো কুচকুচে তেলতেলে মাছ উঠলো জালে। এই মাছ খাওয়া যায় কিনা, এটা সাপ জাতীয় কিছু কিনা, এই নিয়ে আমি আর সহ-জেলে চাচাতো ভাই গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু করলাম। পরে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম, এটা আসলে শিশুর বাচ্চা। সুতরাং আমরা এটাকে নদীতেই আবার ছেড়ে দেওয়া যাক।

শিশু মাছের নামটা কেন শিশু মাছ হলো, এটা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেবার চনপাড়া থেকে ইছাখালি পর্যন্ত নৌকা করে আসছিলাম আমরা। গয়না নৌকা - ছৈ দেয়া। মা, আমরা তিন ভাইবোন আর আমার খালু। যদিও খালু, কিন্তু তিনি আবার আমার নানার ভক্তশিষ্য। আমার নানা ছিলেন বাউল ধরনের মানুষ। নিজেই গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। স্বভাবতই তার কিছু শিষ্য জুটেছিল। চনপাড়া থেকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষন পরেই নতুন চরে এসে মাঝিরা নৌকা ভিড়িয়ে দিল। অনেক দূরের পথ, সুতরাং কিছু খাওয়া দাওয়া করা দরকার। খালু, আমি এবং মাঝিদের একজন চললাম নতুন চরের অস্থায়ী বাজারে। কতো জাতের যে মাছ উঠেছে! শীতলক্ষ্যা যেখানে মেঘনার সাথে মিশেছে, সেটা বেশি দূরে না হওয়াতে সদ্য আহরিত ইলিশ-ও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। আমরা বেছে বেছে শেষমেষ ইলিশ-ই কিনলাম। আরো কিছু বাজারসদাই করে, চরেই রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে আমরা রওনা হলাম। ঠিক তখনই কয়েকটা বিশাল মাছ লাফিয়ে উঠলো নদীতে, মাকে জিজ্ঞেস করলাম- এই মাছের নাম কি? মা বলে, এদের নাম শিশু। এতো বড়ো মাছের নাম কেন শিশু, তার জবাব মা, খালু বা মাঝিরা কেউ দিতে পারলো না। আমরা তিন ভাইবোন ছৈ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু মাছেদের খেলা দেখতে লাগলাম। বিশেষ করে চেইন করে করে যে লাফগুলো দিচ্ছিলো, তা ছিল অসাধারণ। মাঝিরা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছিলো- এতো কিনারে যাইও না, পইড়া যাইবা। মাঝিরা বলে বলে পনেরোটা, বিশটা শিশু আছে নদীতে; আমার অবশ্য পরে মনে হয়েছে শত শত শিশু আছে নদীতে।

তখনো আমরা টেলিভিশনে ডলফিনের ব্যাপার স্যাপারগুলো বুঝে উঠতে পারিনি। ডলফিনের বাংলাই যে শুশুক এবং তার স্থানীয় বিকৃতি যে শিশু তা-ও আমাদের মাথায় ঢোকেনি। তবু এতো বিশাল বিশাল মাছেদের এতো শিশুসুলভ কাণ্ডকারখানা আমাদের মুগ্ধ করতো।

বৃষ্টি হলেই তাই নদীতে ছুটতাম। মাছ ধরা তো আছেই, শিশুগুলোর কাণ্ডকীর্তি দেখাও একটা উপলক্ষ ছিল। একবার তো মাছ ধরে যেই না নদীর এক বাঁকে এসেছি, দেখি কি আমার পচাঁত্তরোর্ধ্ব নানা বৃষ্টির মধ্যে নদীর পাড়ে বসে একমনে শিশুর খেলা দেখছে। আমি “ও-ও-ও-ও নানা, একলা একলা বইসা কি করোগো নানাআআ?” বলে যেই না হাঁক দিয়েছি, অমনি তিনি “তফাৎ যা, তফাৎ যা” বলে চেচিয়ে উঠলেন। নানা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, সুতরাং তার এই অকস্মাৎ রূঢ় ব্যবহারে দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও, মোটেই দুঃখ পেলাম না। বরং এই ঘটনার কথা চিন্তা করে সেদিন-ও মজা পেয়েছি, এখনো হাসি পায়। বুড়া একটা লোক ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একা একা বসে শিশুর খেলা দেখে! নৌকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে আমি দ্রুত তার চোখের আড়ালে চলে গেলাম। সেদিন-ও একগাদা মাছ ধরেছিলাম। ঢাকায় এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে না দিলে আমি হয়তো জেলেই হতাম একটা। নানা জাত বেজাতের মাছ ধরে সেগুলোকে নতুন চরের বাজারে বিক্রি করে লবন, তেল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মাকে বলতাম- নে মা তোর মাছ, তেল, লবন; শিং মাছ আর উচ্ছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খাব আজ।

জেলে হওয়া আর হলো না, তবে সুযোগ পেলেই শিশুগুলোকে দেখতে যেতাম। কয়েকদিন আগেই তো রাজকুমার* সমভিব্যহারে বাড়ি গেলাম। যদিও এখন অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে, এখন আর নৌকা করে কেউ যায় না, তবু শিশু দেখার লোভে আমি আর রাজকুমার নৌকা ভাড়া করলাম। পৃথিবীর সব নোংরা আর দুর্গন্ধ সহ্য করতে সক্ষম বলে জানতাম যে রাজকুমারকে, সে-ও পুরো নৌযাত্রাটিতেই রুমাল দিয়ে নাক চেপে রাখলো। আমি কিন্তু নাকে রুমাল দেইনি। কারণ আমি জানি, এই রাস্তা এই ব্রীজ এই কলকারখানা এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার বাবা, মামা, খালুরা কতোবার যে মন্ত্রী এমপি-দের কাছে গেছে, রাস্তা করেন, ব্রীজ করেন, ঢাকার এতো কাছে অথচ শিল্পায়ন হলো না, একটু শিল্পায়নের উদ্যোগ নেন, কতো দেন দরবার নিয়ে। অবশেষে রাস্তা হলো, ব্রীজ হলো, শিল্পায়ন হলো, নদীর নতুন চরে এডিবল তেলের কারখানা হলো। আর আমার শিশুরা পচে গলে মিশে গেল শীতলক্ষ্যার পানির সাথে। আমার নিজের অপরাধে আমার শৈশবের সঙ্গীদের মৃত্যু হলো, আর আমি তার পঁচা গলা শরীর মেশানো পানির গন্ধে নাকে রুমাল দেই কিভাবে?

*রাজকুমার সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

1 comment: