Thursday, February 15, 2024

আর্কাইভ: শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রথম আলো ১৩-১১-২০০৯

               
চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে পলাতক থাকা অবস্থায় সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি কখনো আত্মসমর্পণও করেননি।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আব্দুল্লাহ আবু বুধবার প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মন্তব্য চাওয়া হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল প্রথম আলোকে টেলিফোনে বলেন, ‘এ তথ্য আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম।’ তিনি বিষয়টি আগামী রোববার তাঁর দপ্তরে গিয়ে বিস্তারিত জানবেন বলে উল্লেখ করেন।
অবৈধ সম্পদের বিবরণী মামলায় শাহাদাব আকবর ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ধারায় দুই বছর এবং ২৭(১) ধারার আওতায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এ ছাড়া ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৫ ও ১৬৬ ধারার আওতায় যথাক্রমে এক বছর ও পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তাঁকে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শাহাদাব আকবরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার পুরোটাই রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন। তবে দুদক আইনের আওতায় এর আগে বাজেয়াপ্ত হওয়া তাঁর সম্পদ ও অর্থ আর ফেরত দিতে হবে না বলে জানা গেছে।
আওয়ামী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পিপি আব্দুল্লাহ আবু এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের দণ্ডাদেশ দেওয়ার পর কোনো পলাতক ব্যক্তি যদি আত্মসমর্পণ না-ও করেন, তাহলেও রাষ্ট্রপতি তাঁর দণ্ড মওকুফ করতে পারেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা রয়েছে।’
সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ বইয়ে অভিমত দিয়েছেন, ‘অন্যান্য ক্ষমতার মতো দণ্ড মওকুফের ক্ষমতা প্রয়োগেও রাষ্ট্রপতি স্বাধীন নন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই তাঁকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।’
সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত আইন-শব্দকোষে বলা আছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ও ৪০২ ধারা অনুসারে সরকারও অনুরূপ ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারে।’ তবে গত ৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা শাখা-২-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব রুখসানা হাসিনের সই করা এক পত্র থেকে দেখা যায়, শাহাদাব আকবরই নিজের দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করেছিলেন।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক গতকাল বলেন, ‘আমাদের দেশের ক্ষমতাধররা যে আইনের ঊর্ধ্বে, তা এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো। পলাতক দণ্ডিত দোষী ব্যক্তি আইন ও সংবিধানের কোনো সুবিধা নিতে পারেন না এবং তাঁকে অনুরূপ সুবিধা দেওয়াও রাষ্ট্রের কারও এখতিয়ারে পড়ে না। নিকট অতীতে রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির রয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে এই ক্ষমতা প্রয়োগে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার দরকার আছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।’
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তাঁর ওই বইয়ের ৩২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ‘সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় রাষ্ট্রপতি কখন-কীভাবে তাঁর ওই ক্ষমতার অনুশীলন করবেন, তা আদালতে পরীক্ষণীয়। আদালত রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতার প্রকৃতি, সীমা ও পরিসর পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত চিঠি ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে পরদিন পৌঁছায়। জেলা প্রশাসক তখন তা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকারকে দেন। এরপর তা অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২ নভেম্বর বিশেষ আদালতে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, পলাতক অবস্থায় কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় ও দণ্ড ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট আদালত দণ্ডিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘কনভিকশন ওয়ারেন্ট’ বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরোয়ানা জারি করেন। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত শাহাদাব আকবরের বিরুদ্ধেও ওই পরোয়ানা জারি ও বহাল ছিল। এখন তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য আর কোনো পরোয়ানার কার্যকারিতা নেই। কারণ বিশেষ আদালত তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
পিপি আব্দুল্লাহ আবু জানিয়েছেন, চলতি মাসের শুরুতে ওই পরোয়ানা প্রত্যাহারে ঢাকার দুটি বিশেষ আদালতের বিচারক মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারক মো. আবু হানিফের আদালতে তিনি পৃথক দরখাস্ত পেশ করেন। সরকারের নির্দেশেই তিনি এটা করেন বলে উল্লেখ করেন। জানা গেছে, ওই দরখাস্তের ওপর দুটি আদালতেই পৃথকভাবে শুনানি হয়। কিন্তু শুনানিকালে দণ্ডিত পলাতক ব্যক্তির সাজা মওকুফসংক্রান্ত কোনো আইনগত প্রশ্ন আলোচনায় আসেনি।