Sunday, November 15, 2009

জাতের নামে বজ্জাতি সব

আমি শুনেছি ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকে নাকি এখনো বাংলাদেশ-কে পাকিস্তানের অংশ মনে করেন, কেউ কেউ ভারতের একটা প্রদেশ-ও ভাবেন। বাংলাদেশের মানুষকে অবলীলায় ইন্ডিয়ান বা অন্য কোনো জাতীয় হিসেবে চালিয়ে দেন। কিংবা অনেক বাংলাদেশিও নিজেকে বাংলাদেশি না বলে প্রথম পরিচয়টা ইন্ডিয়ান বা এই ধরনের কিছু বলেন। আর মুসলিম? ‘দুইপাতা ইংরেজিপড়া' মুসলমানদের অনেকেই ইসলামী রীতি তো দূরের কথা পারলে বাংলার ইতিহাস থেকে মুসলিম শাসনের ৭০০ বছর-ও মুছে দিতে চান।

অবস্থা কতোটা ঘোরতর বুঝবেন, যখন সরকারপ্রধান '৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তনকেই এইদেশের উন্নয়নের জন্য জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দেখুন প্রথম আলোর সংবাদ। ব্যক্তিগতভাবে আমি '৭২-এর সংবিধান পছন্দ করি না, তবে আমার পছন্দ করার চেয়েও অনেক বেশি করে সেটি পছন্দ করেন না এই দেশের অবাঙালিরা। কারণ এখানে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে, মহান নেতা বলেছেন- তোমরা সব বাঙালি হ'য়া যাও। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলামিয়া কলেজের নাম বদলে হবে নজরুল কলেজ কিন্তু নটরডেম, হলিক্রস, রামকৃষ্ণ কলেজের নাম থাকবে যেমনছিলতেমন। যেন বাঙালিত্বেই সব জাতীয়তাবাদ, যেন অনৈসলামেই সব ধর্মনিরপেক্ষতা।

জাতীয়তা আসলে কি? সমাজবিজ্ঞান এমন এক অদ্ভুত বিজ্ঞান যা কোনো কিছুর স্থির ব্যাখ্যা দিতে পারে না। জাতীয়তার ধারণা এমনভাবে বদলে গেছে বিভিন্ন সময়ে, এক সময়ের ধারণা অন্য সময় প্রায় উল্টো। তিনটি সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারণার কথা আমরা বলি প্রায়ই- একটা হলো মৌলবাদী, আরেকটা যন্ত্রবাদী আর তৃতীয়টা নির্মাণবাদী। মৌলবাদী ধারণাটা এখন সমাজবিজ্ঞানে সবচেয়ে অচল, কিন্তু ওইটাই আমরা সবচেয়ে বেশি বলি। আমার বাপ-দাদা যেই জাত আছিলো, আমি কি সেই জাত না? আমি কি এই দেশের আদিবাসী না? মণিপুরীরা তো আইছে বিদেশ থেকে, আমার দাদা-পরদাদারা এই দ্যাশের আসল আদিবাসী ইত্যাদি ইত্যাদি এটিই মৌলবাদী ধারণা। অর্থাৎ প্রধানত রক্তের সম্পর্ককে ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদী ধারণা গড়ে উঠেছে, সেটিই হলো মৌলবাদী জাতীয়তাবাদ। অনেকে একে মূলবাদী, অনেকে প্রাথমিকবাদী অনেকে আদ্যবাদী বা আদিবাদী ইত্যাদি ভাবে বঙ্গায়ন করেছেন। এই তত্ত্বে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো- বংশগরিমা। প্রথমে সৈয়দ পরিবার সেরা, পরে সৈয়দ বংশ সেরা, পরে সৈয়দপুরবাসী সেরা, পরে সৈয়দস্তান-এর মানুষ পৃথিবীর সেরা জাতি, তারপর সৈয়দদের গায়ের রঙ যেহেতু কমলা, সুতরাং পৃথিবীর সকল কমলা মানুষ-ই সেরা, এইভাবে এটা একটা পুরা রেসিস্ট জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়। ব্রিটিশদের হাতে রোপিত হলেও জার্মানদের হাতে এই বৃক্ষ ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুস্তাফ কোসিনা এই ক্ষেতের মূল চাষী; হাইনরিখ হিমলার এবং আলফ্রেড রোজেনবার্গ কিছুটা কামলা দিছে।

যন্ত্রবাদী ধারণাটি হলো জাতীয়তা নির্ণয়ের একটা যন্ত্র নির্ধারণ। অর্থাৎ স্বাতন্ত্রসূচক একটা উপাদান (যন্ত্র) খুঁজে বের করে ওইটার সাপেক্ষে জাতীয়তাবাদ নির্ণয়। ওরা যেহেতু বাংলায় কথা বলে সুতরাং ওরা সব বাঙালি, ওরা যেহেতু সব বাইবেল পড়ে সুতরাং ওরা খ্রিস্টান জাতি, ওরা যেহেতু সব লাল পুঁতির মালা পরে সুতরাং ওরা সব লালমালা* জাতি। এইভাবে একটা কিছু খুঁজে বের করে ঐক্য তৈরি করা। কাঠামোবাদী, উপযোগিতাবাদী ইত্যাদি নানা নামে একে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নামের সাথে মিলিয়ে সংজ্ঞার সামান্য হেরফের আছে, মূল ঘটনা এক-ই। যাই হোক এই সংজ্ঞাও কার্যত অকার্যকর। কারণ দেখা গেছে, একই ভাষায় কথা বললেও ইংরাজগুলা মোটেই এক জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। অথবা এক ধর্ম হইলেও মুসলমানগুলা সব ফাঁক পাইলেই স্বাধীন হইয়া যায়। এইসব নানা কিসসা কাহিনী দেইখা সমাজবিজ্ঞানীরা কইলো, না থাউক, এইভাবে হইবো না, অন্য রাস্তা দেখি।

নির্মাণবাদীরা এইবার ধরলো ব্যক্তিকে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি কিভাবে সর্বব্যাপী ও সাধারণ ব্যক্তি হয়, তার চেষ্টা। দৈহিক গড়ন, নাম, ভাষা, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি নানা ধরনের যাতাকলে পিষ্ট করে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে কোথায় সবচেয়ে বেশি খাপ খায় সেই বিষয় জানার চেষ্টা করে। এইভাবে ব্যক্তির বিভিন্ন চর্চা, সংস্কৃতি, পরিপ্রেক্ষিত, ইতিহাস ইত্যাদির আলোকে একই সমাজে নানা স্তরায়ন করে জাতীয়তাকে ভাঁজে ভাঁজে সাজাইলো। এর ফলে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলামান, বাংলাদেশি বাঙালি, ভারতীয় বাঙালি, বাংলাদেশি মুসলমান বাঙালি, বাংলাদেশি হিন্দু বাঙালি, বাংলাদেশি নিম্নবর্গের মুসলমান বাঙালি ইত্যাদি নানা ভাবে জাতীয়তাকে চিহ্নায়নের চেষ্টা করে। এর থেকে ‘তোমার দেশ কই?- নোয়াখালী, তোমার জাত কি?- জাইল্যা' এইটা অনেক বেশি যুৎসই মনে কইরা, সমাজবিজ্ঞানীরা কি করি কি করি একটা ধান্দায় পড়ে গেল।

(চলবে)

*লালমালা জাতি নামে আসলেই একটা জাতি চিহ্নিত করা হয়েছিল।

No comments:

Post a Comment