Sunday, November 15, 2009

ফারিয়া, তোমার জন্য...

ফারিয়া

বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, নিজেও আক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তা সত্ত্বেও আমাদের সংরক্ষণ কাজে সবচেয়ে আগ্রহী মানুষটি ফারিয়া। প্রতিদিন এসে কাজের খোঁজখবর নিচ্ছে, আমাদের দলের কে কেমন আছে, অভিভাবকসুলভভাবে দেখভাল করছে। ওর ভাই-বোন (যাদের সাথে থাকে) আমাদেরকে চাচা-মামা ডাকলেও ফারিয়া এসব সাধারণ (কমন) সম্পর্কে আগ্রহী নয়। প্রত্যেকের সাথে তার ওয়ান-টু-ওয়ান সম্পর্ক, প্রত্যেককে কাস্টমাইজড নাম দিয়েছে সে। সাধারণত নামের আদ্যক্ষরটিকেই নাম হিসেবে তার পছন্দ, নিজের নাম বলে ‘ফা‌'। সুতরাং আমাদের দলের অধিকাংশ সদস্যই তার কাছে শা, আ, স ইত্যাদি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ডাক নাম যে চুন্নু, ফারিয়া-র ‘চু' অনুসন্ধান ব্যতীত এটা আমি জানতেই পারতাম না। তবে একই অক্ষর একাধিক হয়ে গেলে অথবা কোনো বিশেষ কারণ থাকলে অন্য কোনো শব্দ বা অক্ষর বেছে নেয় সে। যেমন মামুন-কে ‘বন্ধু’ নামে কাস্টমাইজ করেছে, কেননা ‘মা’ অক্ষরটি অন্য কারো জন্য বরাদ্দ করতে সে আগ্রহী না। আমি যদিও এই দলের সবচেয়ে মুরব্বী সদস্য না, তবে দলনেতা হওয়ার কারণে প্রায়ই মুরব্বী গোছের লোকদের সাথে আমার আনাগোনা থাকায় আমাকেও আদ্যাক্ষর দিয়ে বিভূষিত করা যাবে কিনা, এ বিষয়টি ফারিয়া এখনো নিশ্চিত নয়। তাই ‘এই, ওই, এই যে’ ইত্যাদি ভূষণ নিয়েই আপাতত থাকতে হচ্ছে। আমাদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে তার সুস্পষ্ট বিধিমালা আছে, তা হলো- ফারিয়া থাকা অবস্থায় সিগারেট খাওয়া যাবে না, খেতে হলে দূরে গিয়ে খেতে হবে এবং ফারিয়াকে দেখা মাত্র সিগারেট ফেলে দিতে হবে- এর কোনো ব্যতিক্রম হলে ও আমাদের কাছে আসবে না। আর ওর সঙ্গ পছন্দ করে না, এমন সদস্য আমাদের দলে নেই। আমাদের দলের সদস্যদের তোলা ফারিয়ার ছবির কয়েকটি আমার ফেসবুকের এই অ্যালবামে আছে। (শুধু ফারিয়া-কে নিয়ে পরে একটা আলাদা পোস্ট দিবো, আশা করছি)।

১.
আজ সকালে যখন সাইটে গেলাম, দূর থেকে দেখলাম একটা মিছিল। কাছে গেলে বুঝলাম- একদল স্কুলের বাচ্চা এসেছে আমাদের কাজ দেখতে। প্রতিদিনই শত শত শিশু এখানে আমাদের কাজ দেখতে আসে। আশেপাশের এবং দূরের স্কুল, কিন্ডারগার্টেন এবং মাদ্রাসা থেকে শিশুরা দলবেঁধে কিংবা একা একা আসে। বড়োদের থেকেও ওদের উৎসাহ অনেক বেশি। এবং বড়োদের অনেকের মধ্যে যে অতিলৌকিক সংস্কারগুলো আছে, শিশুদের মধ্যে সেটা নেই। এতো বছরের পুরনো একটি ভবন, যা তৈরি করেছে জ্বীন-পরীরা, সেটা কি মানুষের পক্ষে পুনর্নিমার্ণ করা সম্ভব? এই প্রশ্নের জবাবে বড়োরা অনেক সময় দ্বিধান্বিত হলেও শিশুরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে- এর সংস্কার ও সংরক্ষণ হবেই।

২.
ফারিয়া কখনো এই লেখা পড়ার মতো বড়ো হবে কিনা, জানিনা। কিন্তু ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা একদিন বড়ো হবে। ওরা জানবে, এই দেশ সেই দেশ যে দেশে অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুদ্রা চালু হয়েছে পৃথিবীর সব দেশের আগে। (৬ষ্ঠ খৃস্টপূর্ব শতাব্দীতে উয়ারীতে প্রবর্তিত ইউনিফর্মড মুদ্রাব্যবস্থার আগে বিশ্বের কোথাও মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না)।

পৃথিবীর দেশগুলো যখন বিদ্যালয় কি এই বিষয়টিই জানতো না, তখন আমাদের উপমহাদেশেই প্রথম তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় (তক্ষশিলা)। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খৃস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে আমাদের দেশে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় (মহাস্থানগড়, হরিশচন্দ্র নির্মিত বিদ্যায়তন, সোমপুর বিহার, কুমিল্লার বিহারসমূহ ইত্যাদি), ইউরোপ যখন বিশ্ববিদ্যালয় কি, তা-ই জানতো না।

বর্তমান ডিজিটাল বিশ্ব যে দশমিক পদ্ধতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই দশমিক পদ্ধতি ও শূন্য এই বাংলাতেই আবিষ্কৃত হয়।

আমাদের দেশ এতোই অতিথিপরায়ণ ও সমৃদ্ধ যে এই দেশ অনুপ্রবেশকারী যোদ্ধা এই দেশেই জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন কি নিজের ছেলের সাথে যুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন রাখার চেষ্টা করেছে।

যে আলেকজান্ডারের ভয়ে সারা বিশ্ব কাপঁতো থর থর করে করে, সেই আলেকজান্ডার বাঙালি বীরের (নন্দ) বীরত্বগাঁথা শুনে অস্ত্র সংবরণ করেছিলেন।

এমনি আরো শত শত গল্প এইসব শিশুরা জানবে। শুধু জানা নয়, এইসব ঋদ্ধ অতীত আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছি এটাও ওরা দেখবে।

৩.
এই যে নগর-সংসার ছেড়ে এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে পড়ে আছি, তার প্রধান কারণ- ফারিয়া এবং/অথবা অন্য সব শিশুরা যখন বড়ো হবে, ততদিনে আমরা এই দেশের আরো অনেক স্থাপনা এবং অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণ করতে পারবো। ওরা বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরবগাঁথা গর্ব করে বলবে এবং সেই সাথে এই গৌরবান্বিত অতীত থেকে অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ নিয়ে আরো গর্ব করার মতো ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের যতো প্রয়াস, সব ওদের জন্যই।

No comments:

Post a Comment