Thursday, July 16, 2009

রোবাব রোসান এবং ওয়ান টপ আর্কিওলিজস্ট : তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উত্থান (?)

প্রায় ১৫ লাখ বছরের প্রাচীন এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভূমিরূপের দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ বাংলাদেশের ইতিহাসকে প্রাচীন বলতে নারাজ। এরা বাংলাদেশকে বলেন নতুন ভূমির দেশ, যেন পরশু বিকেলে সমুদ্রের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের জন্ম হলো। এইসব বিষয় নিয়েই এই পোস্টটি।

১.
একটি বানর একটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে ২ ফুট ওপরে ওঠে এবং পরবর্তী মিনিটে ৩ ফুট নিচে নামে। ১০ মিনিট পর বানরটি কোথায় থাকবে? হাস্যকর ঠেকতে পারে, এই ভয় না করেই দশকের পর দশক জুড়ে ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি অংশ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে তৈলাক্ত বাঁশের বানরে পরিণত করেছেন।

২.
কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাস্থানগড়ে খননে লিপ্ত বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ দল জোর দাবি জানালো, মধ্যযুগ নয়, মহাস্থানগড়ের বিকাশ মৌর্যযুগে ঘটেছিল। অদ্ভুত...! মহাস্থানগড়কে মধ্যযুগের সাইট বলে কে দাবি করেছে? মহাস্থানগড় অঞ্চলে যে মৌর্য যুগের অনেক আগেই মানুষের বসতি ছিলো, এমন দাবিই তো বরাবর করে আসছিলেন আমাদের দেশের ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা। যৌথ দলের দাবিটা তো রীতিমতো আপনাকে কয়েকধাপ নামিয়ে একধাপ ওপরে তোলার মতো ব্যাপার। আপনি অলরেডি একজন গ্রাজুয়েট, আর কেউ যদি বলে, আপনি একেবারে নিরক্ষর নন, তাহলেও বোধ করি ব্যাপারটা এতো দুঃখজনক হবে না। কারণ আপনার ব্যাপারটা তো একজন ব্যক্তির ব্যাপার, আর মহাস্থান তো একটি জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের প্রতিনিধি।

৩.
ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের অধিনায়ক জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শালে মহাস্থানকে মৌর্য যুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন (১৯৯৮ পৃ ১৯৩)। তার লেখায় তিনি মহাস্থানের নিচে বাংলাদেশের অপর অংশসমূহকে সমুদ্রে-নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ইতিহাস যে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন হতে পারে, ইউরোপীয় জাতদেমাগী সাদা চামড়ার মানুষেরা তা মানতে আগ্রহী নন। তারা বলছেন, মৌর্য আগ্রাসনের মাধ্যমেই বাংলায় নগর-সভ্যতার সূচনা। তার অর্থ কী এটাই দাঁড়ায় না যে, এর আগে বাংলার মানুষ ছিল অসভ্য? অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়াই তারা বলছেন, বাংলার অধিকাংশ এলাকাই ছিল পানির নিচে নিমজ্জিত। এবং তারাই গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই। কেন? যুক্তি কী? তারা বলছেন, বাংলাদেশ একটি নবগঠিত ব-দ্বীপ, সুতরাং এখানে মানুষ এসেছে অনেক পরে, যখন অন্য সব জায়গায় মানুষ সভ্যতার যুগ শেষের পথে। বাংলাদেশের অনেক ভূমিই গড়ে উঠেছে এই ব-দ্বীপের বিকাশের পর, একথা সত্যি- কিন্তু কত নতুন আমাদের এই দেশ? আসুন একটু ভূগোল ও ভূতাত্ত্বিকরা কী বলেন তা জেনে নিই।

বাংলাদেশের পাঁচটি অঞ্চল গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে। এগুলো হলো- বরেন্দ্রভূমি, মধূপুর গড় অঞ্চল, লালমাই অঞ্চল, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা। পদ্মা ও যমুনাবিধৌত সমভূমি ছাড়া উত্তরবঙ্গের প্রায় পুরোটাই বরেন্দ্রভূমি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও ঢাকা পড়েছে মধুপুর গড় অঞ্চলে, লালমাই অঞ্চলে পড়েছে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই অঞ্চলগুলো, সিলেটের পাহাড়ি এলাকা মানে প্রায় পুরো সিলেট বিভাগের উচু ভূমি আর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা মানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা এবং ফেনি। বাংলাদেশের আর বাকী থাকলো কী? এই পুরো এলাকাটি গঠিত হয়েছে প্লায়োস্টোসিন যুগে, মানে আজ থেকে কমসেকম ১৫ লাখ বছর আগে (সর্বোচ্চ ২৫ লাখ পর্যন্ত বলে থাকেন ভূতাত্ত্বিকরা)। অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা আজ থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ বছর আগে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত ছিল। শুধু উপযুক্ত ছিল বললে কম বলা হবে, কারণ নীল বা সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা বসতি স্থাপনের জন্য ছিল নদী-সহায়তা। মেসোপটেমিয়া ও চীনে অবশ্য কিছুটা অন্য প্রাকৃতিক সুবিধাও ছিল। আর বাংলাদেশে শুধু নদী সুবিধাই নয়, এই অঞ্চলের উচু-নীচু ভূমিরূপ দিচ্ছে তিনটি সুবিধা- এক. উচু ভূমিতে নিরপদে বন্যামুক্তভাবে বসবাস, দুই. মৌসুমী বন্যায় পলিবাহিত নিচু ভূমিতে প্রায় বিনা আয়াসে চাষাবাদ এবং তিন. কাছেই জলাভূমি থাকার কারণে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে ব্যবহার। অন্যান্য সভ্যতার অঞ্চলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশকে ওগুলোর চেয়ে বেটার মনে হয়।

তাহলে কেন আমরা বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি এবং নগর-সভ্যতা খুঁজে পাইনি? কারণ আমরা খুঁজিনি। ইউরোপীয় সাদা চামড়া বলে গেছে, তোমরা তো মাত্র মানুষ হলে... সভ্যতা তোমরা কোত্থেকে পাবে?

অথচ খোঁজা যখন শুরু হলো, তখন কিন্তু পাওয়া গেলো। বাংলার যে পাঁচটি প্লায়োস্টোসিন যুগের অঞ্চলের কথা আগে বলেছি ওই অঞ্চলগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ও অন্যান্য নিদর্শন। ফেনি ও চট্টগ্রামে, সিলেট ও হবিগঞ্জে, কুমিল্লায় এবং উয়ারী-বটেশ্বরে। একমাত্র বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়া অন্য প্রত্যেকটি অঞ্চলে যতটুকু সন্ধান চালানো হয়েছে, তাতেই পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন।

এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরবর্তীতে বাংলাদেশে নগর-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কিনা? মহাস্থান এক ইউরোপীয়-র (কানিংহাম) আবিষ্কার বলে মহাস্থানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এরা মহাস্থানগড়কে মৌর্যযুগের আগে স্থান দিতে আগ্রহী নন। এমনকি তারা মনে করেন মৌর্য যুগের আগে বাংলাদেশে আর কোনো প্রত্নস্থান থাকতে পারে না? কাজেই যখন উয়ারী-বটেশ্বরে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়, তখন তারা একে মেনে নিতে পারেন না। অথচ উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর হাতিয়ার, তাম্র-প্রস্তর যুগের বসতি ও বস্তু-নিদর্শন এবং তারো পরের যুগের নগর-সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। আপনি মেনে নিতে না চাইলে কী করবেন? মাটি যে তার সম্পদ উন্মোচিত করছেই!

বাংলার অবশিষ্ট অংশ- যেটা নব-গঠিত ব-দ্বীপ বলে ফেলনা বলে আমাদের ইতিহাস-চিন্তায় প্রোথিত করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে- সেই অঞ্চলটি কত নতুন? ভূতাত্ত্বিক হোসেন মনসুর এবং আরো অনেকের বইতেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। মাত্র ৬ হাজার বছর আগেও সমুদ্র সৈকত এখন যেখানে আছে, তার থেকে বিশাল ৫ কিলোমিটার দূরে ছিল (অনন্ত দূরত্ব!)। বাংলার ব-দ্বীপ এখন থেকে ৫-৬ হাজার বছর আগেই গঠিত হয়েছিল, একথাই জানাচ্ছেন ভূতাত্ত্বিকরা, তবে বর্তমানের মতো পুরো অঞ্চলটাই যে শুকনো ভূমি ছিল, তা নয়। কিন্তু জাতদেমাগী উপস্থাপনে ওরা আপনাকে বলবে যেন মাত্র গত মঙ্গলবার এই ভূমি জেগে উঠেছিল।

তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই বানরের বাঁশে আরোহনের গল্প ফাঁদা কেন? লক্ষ্য করবেন, এই ঘরানার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তাগণ ভারতবর্ষকে আর্য কর্তৃক সভ্যকরণ তত্ত্ব দেন, যেন আর্যরা না এলে (?) আমরা বর্বর থেকে যেতাম। তারাই পরে বলেন, ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন আমাদেরকে ঐতিহাসিক ভাবে মুক্তি দিয়েছে, আমাদেরকে আধুনিক ও সভ্য করেছে। এদের কেউ কেউ এমনকি পাকিস্তানি শাসনও যে আমাদেরকে অনেক সভ্য করেছে, সেই পর্যন্ত অগ্রসর হন। প্রকৃতপক্ষে শত শত বছর ধরে ইউরোপ সারা বিশ্বে যে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও লুটপাট চালিয়েছে, তাকে বৈধ করার জন্য এবং নিপীড়িত দেশগুলোর মানুষের মনে উপনিবেশের স্মৃতি ও বিরোধিতা মুছে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দেশগুলোর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসকে বিকৃত করে। যেন উপনিবেশ না হলে যে আমরা মানুষ-ই হতাম না। কাজেই সাবেক সকল উপনিবেশ ও আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার মাধ্যমে তারা বর্তমান কালেও যেসব আগ্রাসন ও উপনিবেশিক প্রভাব রয়ে গেছে, তাকে বৈধতা দানের চেষ্টা করে। বর্তমান কালে দেশে দেশে পণ্য, তথ্য, জ্ঞান ও গণমাধ্যমের যে আগ্রাসন চলছে উপনিবেশকে কোমলায়িত করে ও উপনিবেশকে মধুমাখা করে তার বৈধতা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে জড়িত লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপকদের একটি অংশও না বুঝে অথবা ক্ষমতার লোভে এই নব্য-উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

রোবাব রোসানকে এই অবস্থানে আমি একটি পক্ষে ফেলতে চাই। কারো কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন- এমন মতের আমি আগেও বিরোধিতা করেছি, এখনো করছি। তিনি ওই ইউরোপীয় জাতদেমাগি ঘরানার ভাঁজ খেয়েছেন। ওরা তাকে যা বুঝিয়েছে, তিনি সেটুকুকে সত্যি বলে মনে করেছেন। একজন সাংবাদিক সব বিষয়ে জ্ঞানী হবেন, তা আশা করা যায় না। কিন্তু সব মহলের বক্তব্য তুলে ধরবেন, এটা আশা করা যায়। কেবল একটি পক্ষের কথা বলবেন তা কি হয়, বিশেষত যে পক্ষটি আবার বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় একটি জাতদেমাগী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত!

বি.দ্র. ২৭ এপ্রিল ২০০৭ দৈনিক নিউ এজে রোবাব রোসানের একটি প্রতিবেদন বিষয়ে এটা দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া।

কড়ি

আমার মাতামহী পরম সযতনে একটি রূপোর বিছা আমার কোমরে পরিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেদের কোমরের বিছায় কড়ি গেঁথে দিতে হয়, যুগান্তরের এই লোকসংস্কারের নিগুঢ় রহস্য তিনি জানতেন না। সুতরাং আমার শিশ্নছোঁয়া কড়িটির দিক তর্জনি বাড়িয়ে ঘুঙুরের মতো নাচালে সেটি কেবলি আমার শিশ্ন ছোঁয়, শব্দ করে না। ক্রমাগত শিশ্ন আর কড়ির এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় আমি বিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি মায়ের কোলে বসলে আচমকা বুঝতাম আমার শিশ্নের মুণ্ড কড়িতে আটকে গেছে। রেগে গিয়ে বলতাম মাকে, 'মাগো, এই কড়ি ফেলে দাও।' মাতামহী দ্রুত ছুটে এসে বলতেন, সোনারে, ছেলের বিছায় কড়ি যে দিতেই হবে। সুতরাং কড়ি-শিশ্নের ছোঁয়াছুঁয়ি আর কড়িতে শিশ্ন-মুণ্ড আটকে যাওয়ায় আমার বিরক্তি রোজই বাড়তে থাকে।

মাতামহী জানতেন কিনা, কখনও বলেননি। আমিও তো সেদিন জানলাম- কড়ি যোনির চিহ্ন।

গল্প

রায়হান রাইন অদ্ভুত গল্প লেখেন। তার গল্পে ভৌতিক যুগের বিষয়আশয় এসে হাজির হয়। গ্রামে গ্রামে ডানাঅলা ঘোড়া আর অশরীরী চিল দেখা যায়। রায়হান রাইন এই ঘোড়ায় চড়ে সিরাজগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল চলে আসেন। তারপর টাঙ্গাইল থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর যাওয়ার রোডপ্লান দেখার জন্য গড অব স্মল থিংগস খুলে বসেন। অশরীরী চিল তার সফরসঙ্গী ছিল; শরীর না থাকলেও ক্ষুধাতৃষ্ণা বিশেষত কামবোধ এই পাখির প্রবল। সে মিষ্টির দোকানগুলোতে ঢুকে পোড়োবাড়ির চমচম সাবাড় করে দিয়ে রঙমালা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের টিনের চালে বসা এক মেয়ে কবুতরকে ধর্ষণ করে রায়হান রাইনের কাঁধে এসে বসে। রায়হান না দেখেও দেখার ভাণ করে বই ফেলে ঘোড়ায় চড়ে বসেন। জানা গেছে, ক্রমাগত উত্তর দিকে যেতে থাকলে তবেই ১২ দিন ১৩ রাতের পর কালিয়াকৈর পৌঁছানো যাবে। রায়হান রাইন পণ করেছেন সেখানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর একটা শব্দও লিখবেন না। তিনি পৌঁছুতে পারেননি, বলাই বাহুল্য। পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার পণ রক্ষার আর কোন যৌক্তিকতা থাকে না। তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করেন। পরলোকে একমাত্র প্রচার মাধ্যম স্বপ্ন। ইহলৌকিক বাসিন্দারা স্বপ্ন ব্যতীত অন্য কোন মাধ্যমে রায়হানের গল্প পড়তে পারে না। আমি মাঝে মধ্যে দু'একটা পড়ি। তো, যা বলছিলাম, রায়হান রাইন অদ্ভুত গল্প লেখেন। তার গল্পে ভৌতিক যুগের.......।

উপন্যাস

ভাবছিলাম একটা উপন্যাস লিখবো।
একটা মেয়ে যশোর থেকে ঢাকা আসছে,
পথে বিচিত্র যে-সব ঘটনা ঘটবে, সে-সব নিয়েই উপন্যাস।
তারপর ভাবলাম, গল্প লিখবো। সবই ঠিক থাকবে, তবে ঘটনাগুলো কাটছাট করে ঘটবে।
তারপর লিখলাম।
মেয়েটি বাসে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো, জেগে দেখে ঢাকা।

১৬ অক্টোবর ১৯৯৯

জানবিবি

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। তড়িঘড়ি পকেটে ভরে ফেলুন। কাপড় কেটে বুক ছিড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়- সেক্ষেত্রে চোরা পকেটে রাখুন, সহজে হৃদপিণ্ডের নাগাল পাবে কাঁচখণ্ড। হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা কম; থাকলে আপনিই সবচেয়ে প্রথমে পাস করে গেলেন।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। তড়িঘড়ি লুকিয়ে ফেলুন। বাড়ি গিয়ে রূপোর কৌটোয় সযত্নে ভরে রাখুন। মাঝে মাঝে খুলে দেখবেন, মন খারাপ হলে। হতাশ, বিষন্ন, দুঃখবাদী হয়ে গেলে; আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগলে; জগতের সবকিছু অর্থহীন মনে হলে কাঁচের টুকরোটি বার করে দেখবেন সূর্যের আলোয়।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। পকেট না থাকলে, লুকোতে না পারলে, তড়িঘড়ি গিলে ফেলুন। মোক্ষম সুযোগ, সর্বশেষ। চিরকালের জন্য শুদ্ধ হয়ে যাবেন। যারা মৃত্যুর ভয় দেখায়, কাঁচ মুখে পোরার আগে ওদের মুখে একদলা থু থু ছিটিয়ে নিন। কাঁচ খাওয়া মুখের থুথুর যোগ্য সবাই নয়।

এক টুকরো কাঁচ হাতে নিন। হুড়োহুড়ি করে, লুটোপুটি করে সংগ্রহ করুন। পাশের বন্ধুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে, সামনের পেছনের মানুষগুলোর হাতে পা তুলে দিয়ে সকলকে নিবৃত্ত করুন। সজোরে সবেগে সংগ্রহ করুন কাঁচখণ্ড। কাঁচের টুকরো হাতে থাকলে বজ্রমুষ্ঠি হবে আপনার। সচীত্কারে বলতে পারবেন, আমি জানবিবির সন্তান, ধর্ষক নই!


(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা হলগুলোতে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধর্ষণকারী এবং তাদের সহযোগীদের হল থেকে বিতাড়ন করে। এই রণমিছিল চলাকালে আন্দোলনকারী ক'জন ছাত্রছাত্রী হলের তালা এবং কিছু চিহ্নিত ঘরের দরজা-জানলা ভাঙচুর করে। কেউ কেউ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের রক্তমাখা কাঁচ সংগ্রহ করেছিল। জানবিবি আমাদের মা। জানবিবির হল আমাদের প্রিয়, হলের ঘর আমাদের প্রিয়; ঘরের দরজা, জানলা, জানলার কাঁচ আমাদের প্রিয়।)

পেট্রোল

পেট্রোল
০০০০
প্রতি লিটার ২৪.৫০ টাকা

অয়েল স্টেশনে দাঁড়ানো পেট্রোল/ডিজেল/অকটেনের পাম্পকে শিবলিঙ্গের মতো মনে হয়। রঙবেরঙের কচি, বুড়ো, খুকি, মধ্যবয়সী, ঝোলামাই, ডবকামাই, চকচকে, ময়লা- একেকটি গাড়িনারী পাম্পলিঙ্গের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ তোলে, কেউ তোলে না- কিন্তু সকলেই ফুটো উন্মোচন করে। আর পাম্পশিব তার সুবিশাল লিঙ্গ যোনিতে সজোরে প্রবেশ করিয়ে সবেগে সঘন বীর্যঅয়েল ঢেলে দেয়। খেয়াল করলে দেখবেন, গাড়িমেয়ের সঙ্গে পাম্পশিবের এই সঙ্গমক্রিয়া অবলোকনে আরোহী মেয়ে কিংবা মহিলা খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে, আর অপরাপর পুরুষজনেরা তখন উক্ত নারীদের স্তন এবং নাভীমূল সন্ধান করে থাকে সচরাচর।

বিয়ে

রোববার আপুমণির বিয়ে। রাফি ভাই, আপার বান্ধবীর বড় ভাই, সে-ই বর। ওরা খুব ধনী, সুতরাং রাফি ভাইয়ের বাবা বিয়েতে রাজি নন। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে, বিয়ে হবেই, রাফি ভাই-আপা বিয়ে করবেই।

সামনের রোববার আপা বিয়ে করছে। রাফি ভাইই বর, যাকে বিয়ে করবে বলে আপা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে। বাবা রাজি ছিলেন না, কারণ আমরা বড়লোক। রাফি ভাইয়ের বাবাও রাজি ছিলেন না, কারণ ওরা আরও বড়লোক। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছেই, কারণ রাফি ভাইও ঘোষণা করেছিল, সে আপাকেই বিয়ে করবে।

রোববার আপার বিয়ে। রাফি ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা এ বিয়েতে রাজি নন, কারণ রাফি ভাইরা খুব গরীব। রাফি ভাইয়ের বাবাও রাজি নন, কারণ আমরা আরও গরীব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হচ্ছেই, কারণ আপা-রাফি ভাই বিয়ে করবেই।

হাতে গোনা আর চারটে দিন আছে মাঝখানে, এরপর রবিবার- আপার বিয়ে। বাবা ঠিক করেছেন রাফি ভাইয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলে। আমরাও বড়লোক ওরাও বড়লোক, সুতরাং বাবারা বিয়েতে রাজি। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে না- আপা, রাফি ভাই কেউ বিয়েতে রাজি নয়।

আগামী রোববার আপার বিয়ে। বর রাফি ভাই। রাফি ভাইয়ের বাবা এসে বিয়ে ঠিক করে গেছেন, বাবার সঙ্গে কথা বলে। আমরাও গরীব ওরাও গরীব; সুতরাং কোনোমতে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছেন বাবারা। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে না। রাফি ভাই, আপা বিয়েতে রাজি নয়।

রোববার আপার বিয়ে। বর সেই রাফি ভাই। আমাদের বাবা নেই। রাফি ভাইয়েরও বাবা নেই। সুতরাং বিয়েতে বাবাদের কোনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। অতএব বিয়েটা হচ্ছেই, কারণ আপা-রাফি ভাই পরস্পরকে ভালবাসে।

আসছে রোববার আপুমণির বিয়ে। রাফি ভাইয়ের সঙ্গে। রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই কিংবা ঐশ্বর্য নেই। আমাদের দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সুতরাং বিয়েতে ধনী-দরিদ্রের কোনো মৌলিক প্রশ্নও নেই। আর বিয়েটা তাই হচ্ছে, কারণ আপা-রাফি ভাই দুজন দুজনকে ভালবাসে।

আগামী রোববার বড় আপার বিয়ে। বর রাফি ভাই; রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই, ঐশ্বর্যও নেই। বড় আপারও দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সুতরাং বিয়েতে ধনী-গরীব বৈষম্যের মৌলিক কোনো প্রশ্নও নেই। রাফি ভাইয়ের বাবা নেই। বড় আপারও বাবা নেই সুতরাং সমাজের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধেরও কোনো বালাই নেই। অতএব বিয়েটা হচ্ছে, কারণ আপা রাফি ভাইকে ভালবাসে, রাফি ভাই আপাকে ভালবাসে এবং ওরা পরস্পরকে ভালবাসে।

আপুমণির বিয়ে রোববার। রাফি ভাইই শেষপর্যন্ত বর। রাফি ভাইয়ের দারিদ্র নেই, ঐশ্বর্যও নেই। আপুমণিরও দারিদ্র নেই এবং ঐশ্বর্য নেই। সমাজে ধনী-গরীব বৈষম্য নেই বলে বিয়েতে অর্থনীতির কোনো মৌলিক প্রশ্নও নেই। রাফি ভাইয়ের বাবা নেই। আপুরও বাবা নেই। তাই প্রতিক্রিয়াশীলতার বালাই নেই। কিন্তু সমাজে বৈষম্য নেই বলে, প্রতিক্রিয়াশীলতা নেই বলে, সকলে স্বাধীন-সত্তা এবং স্বতন্ত্র চেতনার অধিকারী বলে রাফি ভাই এবং আপুমণি পরস্পরকে ভালবাসে না।

আর তাই যে বিয়েটা হবার কথা সেটি হচ্ছে না।

বাংলা

প্রিয় মেহজাবিন কান্তা, এইবারো বাংলা। এবং পেনসিল। এবং সিগারেটের গন্ধ। এইবারো।

স্প্যানিশ ভুলে গেছি, লিখতে পারি না একদম- যা লিখি নিজেই বুঝি না; সুতরাং বাংলা। গভীর বাংলা। গভীরতম বাংলা। প্রিয় মেহজাবিন কান্তা।

কলম পাচ্ছি না; সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছি। সম্ভবত অন্য অনেক কিছুর, অন্য অনেক জনের মতো। পেনসিল। চলবে? সিগারেটের মতো?

এক প্যাকেট বেনসনের আর তিনটে বাকি। জীবনটাই তো ফাঁকি। তাই না? প্রিয় মেহজাবিন কান্তা!

অবশ্য...হ্যা এখানে একটা অবশ্যের অনিশ্চয়তা থেকে যায়- যেমন তুমি। হ্যা, অবশ্য...। আমার এক বন্ধু, বন্ধুই বোধহয়, না করেছিল প্রচুর সিগারেট খেতে- তোমার মতো। ও বোধহয় ষষ্ঠ বা সপ্তম, যে অ্যাতো আন্তরিক ভাবে বলেছিলো। বলেছিলো আরো অনেক কথা। যেমন- রাত দুটোয় যেন আমি মেহজাবিন কান্তাকে না লিখি। তুমিও বলতে, একসময়। কিন্তু রঞ্জু তেমন-ই রয়, চিরকাল। এক বিরক্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক, হাত-পিপাসু, অবোধ বালক কিংবা মনুষ্য-আকৃতিবিশিষ্ট বালকসদৃশ। ইশ! অনেকদিন- কতো দিন? কুচকুচে (এখন বাজে আড়াইটা, প্যাকেট আর দুটো সিগারেট এবং পেনসিল এবং বাংলা) কালো, বিশ্রী, তিলভর্তি, লোমশ, ঘিনঘিনে, গা রি রি করা, এক জোড়া হাত আমি ধরি না। প্রিয় মেহজাবিন কান্তা!

পর সমাচার এই যে, দুটি বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া গত তিন মাসে আমার মধ্যে ঘটেনি- এমন কোনো সুসমাচার বাইবেলে লেখা নাই। সুতরাং এইবার তুমি ডন কুইক্সোট পড়া শুরু করতে পারো। হ্যা, অবশ্যই, মূল স্প্যানিশে।

তারপর বাংলা। ডন কুইক্সোট পার্ট টু- এইবার শূন্য লড়াই করবে ডন কুইক্সোটের বিরুদ্ধে। লড়াইটা শেষ হলেই লেখাটা শুরু করবো।

বি.দ্র. কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে এই গল্পের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর মিল থাকলে তা কাকতালমাত্র।

প্রাণীকোষ

আবুল কাশেম স্যার কেবল নবম শ্রেণীতেই জীববিজ্ঞান পড়ান। তিনি স্যুটেড বুটেড হয়ে স্কুলে আসেন; পারতপক্ষে ব্লাক বোর্ডের ধারে কাছে ঘেঁষেন না- চকের গুড়ো লেগে স্যুট টাই নোংরা হয়ে যায়।

কিন্তু আজ তিনি ক্লাসে এসেই চক নিয়ে সোজা বোর্ডে গেলেন; আমাদের দিকে দূরে থাক, নিজের জুতো-টাইয়ের দিকেও একবার তাকালেন না।

পুরো চল্লিশ মিনিট ধরে, কপালে চিক চিক ঘাম তৈরি করে আবুল কাশেম স্যার ব্লাক বোর্ডে একটি প্রাণীকোষের চিত্র আঁকলেন। প্রাণীকোষটির বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করে আমাদের বোঝাতে পারলেন না, কারণ বাইরে বারেক মোল্লা স্যার দাঁড়িয়ে আছেন- আবুল কাশেম স্যার পাঁচমিনিট লেট।

আমরা কেউই প্রাণীকোষটি খাতায় তুললাম না, কারণ বইয়ে, গাইডবইয়ে এর চাইতে আকর্ষণীয়, রঙিন প্রাণীকোষের ছবি এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে। তাছাড়া বহু আগেই প্রাইভেট টিউটর আমাদেরকে প্রাণীকোষ চিনিয়েছে। মতিঝিল স্কুলের ছেলেমেয়েরা ক্লাসে প্রাণীকোষ বোঝার অপেক্ষায় বসে থাকে না।

স্যুট, টাই, প্যান্ট এমনকি জুতোভর্তি চকের গুড়ো নিয়ে আবুল কাশেম স্যার টিচার্স লাউঞ্জের দিকে চলে গেলেন।

বারেক মোল্লা স্যার ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকলেন, বোর্ডে গেলেন, ডাস্টার দিয়ে প্রাণীকোষ ঝেড়ে ফেললেন, চকে লিখলেন 'কপোতাক্ষ নদ', বললেন 'মাইকেল মধুসূদনই ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম বিদ্রোহী সাহিত্যিক......'

জীবন

জীবন মানে দুঃখ রোয়া এক সমুদ্র বুক
জীবন মানে সাগর পাড়ে রক্তিম ঝিনুক।